চীনভিত্তিক ‘এশীয় ব্যাংকে’ই বাংলাদেশের আগ্রহ: মুহিত

‘ব্রিকস’ ব্যাংকের চেয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের উদ্যোগে প্রস্তাবিত এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংককে (এআইআইবি) বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদক, ওয়াশিংটন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Oct 2014, 06:50 PM
Updated : 14 Oct 2014, 06:50 PM

রোববার ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের ৭০তম বার্ষিক সভার শেষ দিনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে একথা জানান।

ইতিমধ্যে এআইআইবির সদস্য হওয়ার বিষয়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চীন সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) স্বাক্ষর করতে আগামী ২৪ অক্টোবর অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল চীন সফরে যাচ্ছেন।

অর্থমন্ত্রী বলেন, “ব্রিকস ব্যাংকের গতি খুবই স্লো (ধীর)। আমরা (সরকার) এটা নিয়ে এই মুহূর্তে খুব একটা ভাবছি না। যখন এটার গতি পাবে তখন আমরা ওটা নিয়ে ভাবব। আমরা এখন চীনের নেতৃত্বে প্রস্তাবিত এআইআইবি নিয়েই বেশি আগ্রহী।

“ইতিমধ্যেই আমরা এআইআইবির সদস্য হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ২৪ অক্টোবর আমাদের অর্থ প্রতিমন্ত্রী এবং ইআরডির কর্মকর্তারা চীন যাবেন এ বিষয়ে এমওইউ স্বাক্ষর করতে। আশা করছি, এআইআইবির বড় ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।”

বাংলাদেশ এআইআইবির সদস্য হলে বিশ্ব ব্যাংক বা এডিবির সঙ্গে সম্পর্কের কোনো অবনতি হবে কী না জানতে চাইলে মুহিত বলেন, “না তা হবে কেন? বিশ্ব ব্যাংকের বিষয়টি তো একেবারেই আলাদা। তারা সারা বিশ্বে বিনিয়োগ করে থাকে। এআইআইবি তো দক্ষিণ এশিয়ার অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করবে।

সে প্রেক্ষাপটে এডিবি কিছুটা বিচলিত মনে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এতো বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন যে, আমরা এআইআইবির সদস্য হলে এডিবি মোটেই আমাদের উপর মন খারাপ করবে না। সে কারণে তাদের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্কের কোনো অবনতি হবে না।”

‘সাত-আট শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির জন্য বড় বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন’ উল্লেখ করে মুহিত বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমরা ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধির ফাঁদে (গ্রোথ ট্রাপ) আটকে আছি। অনেক চেষ্টা করেও সাত শতাংশে যেতে পারছি না। একবার মাত্র ছয় দশমিক সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। তারপর সেই ছয় শতাংশ।

“বাংলাদেশ এখন বড় বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত। সে কারণে বিশ্ব ব্যাংক-এডিবির বাইরেও অন্যান্য উন্নয়ন সংস্থার কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া গেলে সেটা আমরা সাদরে গ্রহণ করব। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ-বাণিজ্য সম্পর্ক এখন বেশ ভালো। আমাদের কয়েকটি বড় প্রকল্পে তারা বিনিয়োগ করছে। সে কারণে তাদের নেতৃত্বে প্রস্তাবিত এআইআইবির সদস্য হলে আমরাই লাভবান হব।”

গত ১৭ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এআইআইবির সদস্য হওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ।

১০০ বিলিয়ন ডলার পরিশোধিত মূলধনের (পেইড অব ক্যাপিটাল) এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংকে চীন সরকার একাই দেবে ৫০ বিলিয়ন ডলার। বাকি ৫০ বিলিয়ন ডলার সদস্য দেশগুলো যোগান দেবে।

এই ব্যাংকের সদস্য হতে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশসহ ২২টি দেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে মুহিত জানান।

“এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি সম্পদশালী দেশও রয়েছে।”

এশিয়া অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে গত বছর এশিয়া প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন সামিটে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক গঠনের ঘোষণা দেন।

এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও ইউরোপের সঙ্গে স্থলপথের সংযোগ স্থাপন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে অর্থায়ন করার মূল লক্ষ্য নিয়ে চলতি বছরের শেষের দিকে এই ব্যাংকের যাত্রা শুরু হবে বলেও তখন ঘোষণা দিয়েছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট।

এশিয়ার অনেক দেশই এতে যোগ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে কেউ এগিয়ে না এলেও চীন একাই সামনের দিকে যাবে। ইতিমধ্যে চীন ১০টি দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকও সই করেছে।

ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চীন ইতিমধ্যে এডিবির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চায়না সার্বভৌম সম্পদ তহবিলের সাবেক চেয়ারম্যান জিন লিকুনকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে, যিনি এর মধ্যেই কাজ শুরু করেছেন।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) তথ্য অনুযায়ী, এশিয়ার অবকাঠামো খাতে এখন থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ৮০ হাজার কোটি ডলারে বিনিয়োগ প্রয়োজন। অথচ সংস্থাটি বছরে মাত্র এক হাজার কোটি ডলার ঋণ দিয়ে থাকে।

মুহিত বলেন, “এ থেকেই অনুমেয় যে এডিবি, এআইআইবির মতো আরো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে।”

অন্যদিকে পশ্চিমা প্রভাবিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারকে নতুন আকৃতি দিতে ১০০ বিলিয়ন ডলারের একটি উন্নয়ন ব্যাংক ও জরুরি মুদ্রা তহবিল গঠনের চুক্তি করেছে ‘ব্রিকস’ জোটভুক্ত পাঁচ উদীয়মান অর্থনীতির দেশ।

নতুন এই উন্নয়ন ব্যাংকের সদর দপ্তর হবে চীনের সাংহাইয়ে। আর ভারত ব্যাংকের প্রথম সভাপতির দায়িত্ব পালন করবে।

‘ব্রিকস’ জোটের পাঁচ সদস্য ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা সমানভাবে এই ব্যাংকের জন্য তহবিল যোগাবে, যারা সম্মিলিতভাবে বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ জিডিপির অধিকারী।

গত ১৬ জুলাই ব্রাজিলের ফোর্তালেজায় ব্রিকস সম্মেলনে ‘ব্রিকস’ ব্যাংক গঠনের ঘোষণা দেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রৌসেফ।

তবে পরে ‘ব্রিকস’ ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে নিউ ডেভলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) করা হয়েছে।

প্রাথমিকভাবে ব্যাংকটি চালু হবে ৫০ বিলিয়ন ডলার মূলধন নিয়ে। আর জরুরি মুদ্রা তহবিলেও থাকবে ১০০ বিলিয়ন ডলার। উন্নয়নশীল দেশগুলো তারল্য সঙ্কট কাটাতে স্বল্পমেয়াদে ওই তহবিল থেকে ঋণ নিতে পারবে।

আর এর মধ্য দিয়ে  ব্রিকস ব্যাংক বিশ্ব অর্থ বাজারের দুই মোড়ল বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফকে প্রতিযোগিতার মুখে ফেলে দেবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফে উন্নয়নশীল দেশগুলোর যথেষ্ট ভোটাধিকার না থাকায় বেশ কিছুদিন ধরেই এ দুটি সংস্থার সমালোচনা করে আসছিলেন ব্রিকস নেতারা।

তাদের নতুন এই ব্যাংকের অন্যতম লক্ষ্য হবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আরো বেশি ঋণ দেয়া, যাতে তারা অবকাঠামো উন্নয়ন এগিয়ে নিতে পারে।