পদ্মার ‘তিক্ত স্মৃতি ভোলাবে’ বিশ্ব ব‌্যাংক প্রেসিডেন্টের সফর

পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে বিশ্ব ব‌্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের যে তিক্ত স্মৃতি রয়েছে, জিম ইয়ং কিমের সফর তা মুছে দেবে বলে আশা করছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

আবদুর রহিম হারমাছি ওয়াশিংটন থেকে ফিরেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Oct 2016, 08:22 AM
Updated : 16 Oct 2016, 09:53 AM

দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্য দেখতে রোববার ঢাকায় আসছেন বিশ্ব সংস্থাটির প্রধান জিম। ‍দুই দিনের এই ‘বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস’ বাংলাদেশে পালনের পাশাপাশি ঢাকায় একটি বক্তৃতাও দেবেন তিনি।

এক দশক পর বিশ্ব ব‌্যাংকের কোনো প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে করতে এলেও কিমের এই সফরকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে ‘বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস’ পালন বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৃষ্টান্ত হিসেবে মেলে ধরবে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

সর্বশেষ ২০০৭ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন বিশ্ব ব‌্যাংকের তখনকার প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সংস্থাটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম‌্যাকনামারা এসেছিলেন ঢাকায়, এরপর ঘুরে যান পল উলফোভিৎজ ও জেমস উলফেনসন।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সম্মেলন শেষ করেই ঢাকায় আসছেন দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আসা দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক কিম।

গত ৭ থেকে ৯ অক্টোবর ওই সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থমন্ত্রীরা যোগ দিয়েছিলেন; ছিলেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী মুহিতও। সংস্থা দুটির বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরাও অংশ নেন এই সম্মেলনে।

এবারের বার্ষিক সম্মেলনে জিম ইয়ং কিম

ভারতে বিশ্ব ব‌্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে সম্প্রতি দায়িত্ব নেওয়া বাংলাদেশের নাগরিক জুনাইদ কামাল আহমেদ ওয়াশিংটনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে যে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ ঘটনা ঘটেছিল, তা এই সফরে দূর হবে বলে তিনি আশাবাদী।

পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব‌্যাংকের অর্থায়নের কথা থাকলেও প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে টানাপড়েনের এক পর্যায়ে তাদের বাদ দিয়েই দেশের বৃহত্তম এই সেতুর কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার।

বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে সংস্থাটিকে উন্নয়ন অংশীদার করতে বাংলাদেশ ওই সময়কার তিক্ত অভিজ্ঞতা দূরে রেখে নতুন উদ্যমে কাজ করবে বলে আশা রাখছেন জুনাইদ।

কয়েক বছর আগে পদ্মা সেতু নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার পর গত অর্থবছরে বিশ্ব ব‌্যাংক আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশকে ঋণের অর্থ বেশি ছাড় করেছিল।

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশকে ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে। এর আগে কখনও সংস্থাটি একবছরে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ ছাড় করেনি।

ওয়াশিংটনে বিশ্ব ব্যাংকের সদর দপ্তরে প্রেসিডেন্টের চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালনের কারণে কিমকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন জুনাইদ।

তিনি বলেন, “উনি (কিম) খুবই পজিটিভ মাইন্ডের একজন মানুষ। একজন আশাবাদী মানুষ।”

ওয়াশিংটনে বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে ভারতে বিশ্ব ব‌্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি জুনাইদ কামাল আহমেদ

 

বাংলাদেশকে কী চোখে দেখেন কিম- জানতে চাইলে জুনাইদ বলেন, “পাঁচ বছর আগে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে আসছেন।

“এই পাঁচ বছর তিনি বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। আর সেই সাফল্য-অর্জন সরেজমিনে দেখতেই বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছেন।”

বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্টের সফর যেহেতু বিশ্ব সংবাদ মাধ‌্যমেও শিরোনাম হবে, সেহেতু তা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে বলেও মনে করেন জুনাইদ।

ওয়াশিংটনে বিশ্ব ব্যাংকে বাংলাদেশের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন ভূইঞাও বলেন, “বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ভালো কাভারেজ পাওয়া যাবে। এতে বাংলাদেশের সুনাম বাড়বে।”

কর্মসূচি

রোববার বিকাল ৫টা ২০ মিনিটে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় পৌঁছানোর  পর র‌্যাডিসন হোটেলে উঠবেন জিম ইয়ং কিম।

সোমবার সকালে অর্থমন্ত্রী মুহিতের সঙ্গে বৈঠকের পর বিকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্বে বাংলাদেশ’ শীর্ষক পাবলিক লেকচারে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা দেবেন তিনি।

ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ পল রোমার। বিশ্ব ব্যাংক সাউথ এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যানেট ডিক্সনও বক্তৃতা করবেন।

বাংলাদেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী হাবিব ওয়াহিদ ‘এন্ড পোভার্টি’ শীর্ষক গান গাইবেন অনুষ্ঠানে। এ পর্বের শেষে #প্রসপার বাংলাদেশ (#ProsperBangladesh) শিরোনামে একটি মাল্টিমিডিয়া প্রেজেনটেশন হবে।

সেখানে ‘এন্ড গ্লোবাল পোভার্টি বাই ২০৩০: শেয়ারিং বাংলাদেশ’স এক্সপেরিয়েন্স’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায়ও বক্তৃতা করবেন বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট।

মঙ্গলবার সকালে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়িত কয়েকটি প্রকল্প পরিদর্শনের জন্য বরিশাল যাবেন কিম। ফিরে এসে একান্ত বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। বিকালে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন শেষে বিদায় নেবেন তিনি।

কেন গুরুত্বপূর্ণ

বিশ্ব ব‌্যাংকের পঞ্চম প্রেসিডেন্ট হিসেবে কিমের এই বাংলাদেশ সফর কেন গুরুত্বপূর্ণ, তার ব‌্যাখ‌্যায় অর্থমন্ত্রী বলেন, তার উপস্থিতিতে ‘বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস’ পালন করে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

ওয়াশিংটনে বৈঠকের ফাঁকে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দারিদ্র্য বিমোচন এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে (এমডিজি) বাংলাদেশের সাফল্যে বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট অভিভূত।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত

“তাই নিজের আগ্রহেই আমাদের দেশ সফর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। উপলক্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছেন বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস। বাংলাদেশে তাই এবার দিবসটি ভিন্ন আঙ্গিকে পালিত হবে।”

কিমের আসন্ন ঢাকা সফরকে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল‌্যের ‘স্বীকৃতি’ হিসেবে দেখছেন মুহিত।

“বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর আমাদের জন্য একটি গর্বের বিষয়। আমরা দারিদ্র্য বিমোচনে যে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছি, সেটা সরেজমিনে দেখতেই তিনি বাংলাদেশে যাচ্ছেন।”

বাংলাদেশের অর্জনের প্রশংসা করছেন ঢাকায় বিশ্ব ব‌্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি চিমিয়াও ফানও।

ওয়াশিংটনে সম্মেলনের ফাঁকে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “‍যেভাবে বাংলাদেশের অগ্রগতি হচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে দারিদ্র্যের হার ৩ শতাংশে নেমে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।”

নিজের সংস্থার প্রেসিডেন্টের সফর নিয়েও আশাবাদী বাংলাদেশে বিশ্ব ব‌্যাংকের মিশন প্রধান।

“বিশ্ব ব্যাংকের আইডিএ-এর খুব ভালো ব্যবহার করেছে বাংলাদেশ। আর সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে, দেশটির দারিদ্র্য বিমোচনে অভাবনীয় সাফল্য দেখে। সেজন্যই তো বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে সফরের জন্য বেছে নিয়েছেন।”

বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে, ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে অতি দারিদ্র্যের হার মোট জনসংখ্যার ১২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে ২০০৯-১০ অর্থবছর শেষে এ হার ছিল সাড়ে ১৮ শতাংশ।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা শূন‌্য থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।

দ্রুত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপর গুরুত্ব দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, আমাদের দারিদ্র্য শূন‌্যে নামিয়ে আনতে কোনোমতেই ২০৩০ সাল লাগবে না। তার আগেই আমরা সে লক্ষ্যে পৌঁছে যাব।”