জয়েও আনন্দ নেই মমতার

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিম বাংলার ৪২টির মধ্যে ৩৪টি আসনে জয় এক নজিরবিহীন ঘটনা। কারণ তিন বছর আগ পর্যন্ত যেই বামফ্রন্ট রাজ্যের ক্ষমতায় ছিল, তারা এই নির্বাচনে মাত্র দুটি আসন পেয়েছে।

সৈয়দ বশির, বিশ্লেষকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 May 2014, 07:09 AM
Updated : 17 May 2014, 07:19 AM

তবে মমতার সঙ্গে যারা দেখা করেছেন, তারা নেত্রীকে মোটেও ‘খোশ মেজাজে’ দেখেননি। ঘনিষ্ঠদের উনি নাকি বলেছেন- “এক আপদ গেলো, এক আসলো, বাংলায় এদের শেষ নেই।”

তিনি যেদিকে ইঙ্গিত করেছেন তার মানে দাঁড়ায়- বামফ্রন্ট গেলো, এলো বিজেপি। এবার পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে- যেটা নজিরবিহীন।

১৯৯৯ সালে বিজেপি এবারের মতো দুটি সংসদ আসন দখল করেছিল পশ্চিম বাংলায়। তবে ভোট পেয়েছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০০৯ সালের সংসদ নির্বাচনে তারা ভোট ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এবার যা প্রায় তিনগুণ বেড়ে গিয়েছে।

অনেকেই এর জন্য মোদি সুনামিকে দায়ী করবেন, যেটা খুব একটা ভুল হয়তো নয়। কিন্তু মোদি দেশ চালাবে আর আরএসএস- বিজেপি এমন একটি রাজ্যে চুপ করে বসে থাকবে যেখানে তাদের আসন না বাড়লেও ভোট বেড়েছে অভূতপূর্বভাবে- এটা কি ভাবা যায়?

পশ্চিম বাংলার আরএসএস প্রধান অতুল বিশ্বাস বললেন, “মোদিজি দেশ চালাবে আর তার সাথে তাল মিলিয়ে আমরাও সংগঠন বাড়াবো এখানে।”

আরএসএসের বর্তমানে পশ্চিম বাংলায় ৬০০০০ স্বেচ্ছাসেবক, যা তারা দ্বিগুণ করতে চাইছে এক বছরের মধ্যে।

মূলত অ-বাঙালি প্রধান অঞ্চলে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চলে তারা এখন জোর দিচ্ছে, পরে অন্যত্র ফোকাস করা হবে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরএসএস নেতারা জানান।

তাই বিজেপি পশ্চিম বাংলার সভাপতি রাহুল সিনহা যখন আনন্দে আত্মহারা, ঠিক তখনই কোলকাতায় এসে হাজির আরএসএস প্রধান মহান ভগওয়াত।

উনি চলেছেন উত্তরবঙ্গে রায়গঞ্জের পথে। সেখানে নবাগত আরএসএস স্বেচ্ছাসেবকের জন্য ২০ দিনের প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করা হয়েছে, যা নিজ দায়িত্ব পরিচালনা করবেন ভগওয়াত।

ভারতে আরএসএস হল হিন্দুত্ববাদি রাজনীতির মূল সংগঠন, যদিও তার নেতৃত্ব সব সময় আরএসএস কে সাংষ্কৃতিক সংগঠন বলে তুলে ধরতে চায়। কিন্তু বিজেপি নেতারা আরএসএসের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করে না, আর নরেন্দ্র মোদি তো আরএসএস ঘরের ছেলে।

মোদি বাংলাদেশ থেকে কথিত অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে আসাম অথবা বাংলায় বিজেপি ভোট বাড়িয়েছেন, কিন্তু বাংলায় ২৮ শতাংশ মুসলমান ভোটারদের ১২ শতাংশ মমতার সমর্থনে চলে আসায় তৃণমূলের অভূতপূর্ব জয় সম্ভব হয়েছে।

কিন্তু আরএসএস-বিজেপি যেভাবে মমতার “সংখ্যালঘু তোষণে” বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে এবং তার যে রকম ফল নির্বাচনে হয়েছে তাতে মমতার চিন্তার কারণ আছে বৈকি।

এবার দেখা যাক দক্ষিণ কলকাতা আসন, যেখান থেকে বহু বছর সংসদে নির্বাচিত হন মমতা।

এবার সেখানে তার ঘনিষ্ঠ সুব্রত বকশি জয়ী হলেন বটে কিন্তু সেখানে দু নম্বরে বামফ্রন্ট বা কংগ্রেস নয়, উঠে এলেন বিজেপির তথাগত রায় ২৪ দশমিক ৮১ শতাংশ ভোট পেয়ে। আর এ সংসদ অঞ্চলে ভবানীপুর বিধান সভা কেন্দ্র, যেখান থেকে ২০১১ সালে মমতা জয়ী হয়ে বিধানসভায় যান, সেই ভবানীপুরে তথাগত রায় সুব্রত বকশির চেয়ে অনেকটা এগিয়ে।

মমতার নিজ আসন বিজেপির কাছে হাতছাড়া ভাবা যায়!

অনেকের মতে আরএসএস সংগঠন যতো ছড়াবে ততই বিজেপি জায়গায় জায়গায় মমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে, বামফ্রন্টের পতনের ফলে যে শূন্যতা, তার সুযোগ নিয়ে।

তারা জায়গায় জায়গায় মমতার সংখ্যালঘু তোষণের বিরুদ্ধে জিগির তুলবে আর হিন্দু সমর্থন পেতে প্রয়োজনে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ সৃষ্টি করবে- যেরকম উত্তর ভারতে দেখা গিয়েছে গত দুই দশকে।

তার ফলে মমতা যদি সংখ্যালঘুদের সংরক্ষণের পথ থেকে পিছিয়ে আসে, তাদের সমর্থন হারাবার ভয় থাকবে।

২০১৬ সালে রাজ্যে আবার বিধান সভা নির্বাচন। মমতার ভাষায় ‘ফাইনাল’ ম্যাচ।

যেখানে দুর্বল হয়ে পড়া লাল যোদ্ধা নয়, মমতার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়তো হবে আরএসএস-বিজেপি গৈরিক বাহিনী। যা রুখতে তার একমাত্র ভরসা, বাঙালি খণ্ড-জাতীয়তাবাদ।

কিন্তু পশ্চিম বাংলার জন্য ভালো আর্থিক প্যাকেজ দিয়ে মোদি যদি কেন্দ্র বিরুদ্ধে প্রচারের রাস্তা বন্ধ করে দেয়, তাহলে? কারণ একাজ মোদি করলে তার ফসল তুলবে মমতা নয়, তার লাভ হবে বিজেপি-আরএসএস এর গৈরিক বাহিনী।