তার কথার প্রমাণও পাওয়া গেছে টাঙ্গাইল-৩ আসনের নির্বাচনী এলাকা ঘাটাইল উপজেলা ঘুরে। উপজেলার প্রায় প্রতিটি সড়কে ঝুলছে নৌকার পোস্টার, ব্যানার। বিভিন্ন নির্বাচনী কার্যালয়ে আড্ডা দেন নৌকার কর্মীরা। অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহনে চড়ে প্রচার চালিয়েছেন তারা। নৌকার পক্ষে গণসংযোগও চলে পুরো দমে।
অপরদিকে নৌকার প্রধান প্রতিপক্ষ ধানের শীষের প্রার্থী লুৎফর খান আজাদ আগে তিন দফায় এ এলাকায় সাংসদ নির্বাচিত হলেও তার পক্ষে কোনো প্রচার-প্রচারণা চোখে পড়েনি।
কোথাও ধানের শীষের পোস্টার দেখা যায়নি। নির্বাচনী অফিসও চোখে পড়েনি কোথাও। বিএনপির অভিযোগ, তাদের প্রার্থীকে এলাকায় ‘ঢুকতেই দেয়নি’ নৌকার কর্মীরা।
টাঙ্গাইলের মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলায় দীর্ঘ দিন ধরে কারাবন্দি আমানুর রহমান রানা। তার অপর তিন ভাই সহিদুর রহমান খান মুক্তি, জাহিদুর রহমান খান কাকন ও সানিয়াত খান বাপ্পাও এই মামলার আসামি, তারা পলাতক আছেন।
এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক শহীদুল ইসলাম লেবু, ব্যবসায়ী সৈয়দ তুহিন আবদুল্লাহ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কামরুল ইসলাম ইসলাম।
তবে ঘাটাইলে রানার বাবা আতাউর রহমানকে প্রার্থী করায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের সবাই তার পক্ষে কাজ করছেন বলে নেতারা জানিয়েছেন।
এ আসন ধরে রাখতে তাকে মনোনয়ন ‘না দিয়ে উপায় ছিল না’ বলে মনে করেন রানা মুক্তি সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক শহীদুল ইসলাম খান হেস্টিংস।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রানা হিন্দুদের কাছে দেবদূত, এ আসনে হিন্দুদের ৫৮ হাজার ভোটের সবই রানা পাবে। মুসলমানদের কাছে সে খলিফা। তারাও তাকে ভোট দেবেন। এছাড়া আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরেও এখানে ২০ ভাগ ভোটার আছে যারা দল নয়, ব্যক্তি দেখে ভোট দেয়। বেশিরভাগই গরিব শ্রেণির এই ভোটাররা নৌকায় ভোট দেবে শুধু রানার জন্য।”
তবে প্রচারে পিছিয়ে থাকলেও ভোটাররা সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারলে ধানের শীষের বিজয় হবে বলে আশাবাদী বিএনপি নেতাকর্মীরা।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর থেকেই নেতাকর্মীরা ঘাটাইলে যেতে পারেননি বলে অভিযোগ টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মমিনুল হক খান নিক্সনের।
তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনের সহায়তা চাইলেও পাওয়া যায়নি। তারা চৌদ্দটা ইউনিয়নে আমাদের অফিস ভেঙে ফেলেছে। সব পোস্টার ছিড়ে ফেলেছে, মাইক নিয়ে গেছে।”
প্রচারের শেষ দিকেও মাঠে নামতে পারেননি জানিয়ে এই বিএনপি নেতা বলেন, “সেনাবাহিনী নামায় মাঠ লেভেল প্লেয়িং হয়েছে- এই চিন্তা করে আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা ঘাটাইলের সীমানায় ঢুকে দেড় কিলোমিটারও যেতে পারি নাই। আমাদের গাড়িবহরে হামলা করেছে।”
স্থানীয়রা জানান, আতাউর রহমান খানের ছেলেদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ নানা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগ থাকলেও ঘাটাইলে তারা এসব কিছুই করেননি। ঘাটাইলে রানা ও আতাউর রহমান দুজনের ভাবমূর্তিই ভালো। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের বেশিরভাগই রানার বাবার পক্ষে কাজ করছেন।
নিজের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী আতাউর রহমান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘাটাইলের মানুষ আমাকে গ্রহণ করেছে, এটুকুই আমি বলতে পারি। কিছু লোক আমাকে ভালো না বললেও খারাপ বলার কিছু নাই। আমি আশাবাদী ইনশাল্লাহ, হান্ড্রেডে হান্ড্রেড।”
নিজের তেমন পরিচিতি না থাকলেও ছেলের জনপ্রিয়তাই তাকে জয়ী করবে বলে মনে করেন তিনি।
নিজে সব সময় স্বচ্ছতার সঙ্গে চলার চেষ্টা করেছেন জানিয়ে নৌকার প্রার্থী বলেন, “আমার বড় ভাই তিনবার এমপি ছিল। তার জন্য কাজ করেছি। কিন্তু নির্বাচনের পর একদিন ঘাটাইলে আসিনি, যেন লোকে মনে না করতে পারে আমি টেন্ডারবাজি করতে এসেছি। ছেলে যখন এমপি ছিল, আমি একদিনও ঘাটাইলে আসিনি।”
আতাউর রহমান নিজেকে স্বচ্ছ চরিত্রের লোক দাবি করলেও তার কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে হামলা-হয়রানির অভিযোগ করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী আজাদ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার ওপর এর আগে হামলা হয়নি, কিন্তু এখন হচ্ছে। তারা প্রকাশ্যে বলেছে, যারা ধানের শীষের পক্ষে নির্বাচন করতে যাবে তাদের হাত-পা কাটবে। মামলা দিয়ে জেলে ভরবে, তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেবে। এ অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন তো দূরের কথা, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এজেন্ট আদৌ থাকতে পারবে কি না সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। তারা ডাকাতি করবে, আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখব। ‘ফ্রি-ফেয়ার নির্বাচন’ এসব কথা অভিধান থেকে মুছে ফেলাই ভালো।”
তার অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে আতাউর রহমান বলেন, “বিএনপির প্রার্থীকে ঘাটাইলে ঢুকতে না দেওয়ার কথা ঠিক নয়। ঘাটাইলে ‘এসডিএস’ কেলেঙ্কারির পর লোকজনের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে আজাদ সাহেব উল্টো তা আত্মসাৎ করেছেন। মানুষের টাকা পরিশোধ করার কথা বলে গারোবাজারে এসডিএসের একটা জমি নিজের নামে করে নেন। আজ পর্যন্ত একটা টাকাও দেয় নাই। এ কারণে লোকজন তাকে এলাকায় ঢুকতে দিচ্ছে না।”
নৌকার প্রার্থী আতাউর রহমান খান এবং ধানের শীষের প্রার্থী লুৎফর রহমান খান আজাদের বাড়ি ঘাটাইলের দিগড় ইউনিয়নের বাগুন্তা গ্রামে। তারা সম্পর্কে পরস্পরের ভাই। বর্তমান সাংসদ আমানুর রহমান খান রানার চাচা হন আজাদ।
তবে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী মতিউর রহমানের কাছে হেরে যান আজাদ। সাংসদ মতিউর রহমান খান ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মারা যান।
এরপর উপ-নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন আমানুর রহমান খান রানা। পরে ২০১৪ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের টিকেট পান তিনি। বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে জয়ী হন রানা।
এর আগে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামসুর রহমান খান শাহজাহান ১৯৭০, ১৯৭৩ ও ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে বিএনপির শওকত ভূঁইয়া, ১৯৮৮ সালের ভোটে জাতীয় পার্টির সাইদুর রহমান খান মোহন সাংসদ হন।
ভোটারের ভাষ্য
আমানুর রহমান রানা ঘাটাইলে কোনো সন্ত্রাসী কাজ করেননি বলে দাবি করেন আনেহলা ইউনিয়নের বাসিন্দা শাহনেওয়াজ।
তিনি বলেন, সাংসদ রানা এখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গেছেন।
“রানার একটা ভাইকে নিয়ে কথা আছে। কিন্তু রানা প্রকৃত অর্থে একটা ভালো মানুষ। রানার বদনাম তার ছোট ভাইয়ের কারণে হতে পারে। আবার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেও হতে পারে। রানা ঘাটাইলে কোনো অন্যায় কাজ করে নাই। আমরা দেখি নাই। একটা মানুষ বিপদে পড়ে আসছে, দশ মিনিটের মধ্যে সমস্যা সমাধান করে দিয়েছেন।”
দিগড় ইউনিয়নের মোগলপাড়ার গ্রামের অটোরিকশা চালক নাজমুল হোসেন বলেন, তার ভোটটা নৌকাকেই দেবেন।
“এমপি রানার কাইজকাম ভালা লাগছে। চৌদ্দুগুষ্টি থেইকা নৌকা কইরা আইছি। খারাপ হইলেও নৌকা, ভালা হইলেও নৌকা।”
সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এই আসনে বিএনপির প্রার্থীরও ভালো সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন জামুরিয়া ইউনিয়নের অলিপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. বিপ্লব হোসেন।
তিনি বলেন, রানার বাবা মনোনয়ন পাওয়ায় আওয়ামী লীগ কিছুটা এগিয়ে।
“রানা ভাইয়ের আব্বা মনোনয়ন পাওয়ায় ভালো হয়েছে। নাইলে আওয়ামী লীগ ফেল করত। তিনি মুরুব্বী মানুষ। তাকে ভোট দেওয়া যায়। তবে সঠিকভাবে ভোট হলে বিএনপিরও চান্স আছে।”
এই ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের কৃষক আকতার হোসেন মনে করেন, বিএনপির প্রচারণায় বাধা দেওয়া ঠিক হয়নি।
“বিএনপিরে মাইক মারতে দেয় না। পোস্টারও মারতে দেয় না। খালি কাজ দেকলেই হব? কইসিলো ১০ ট্যাকা সের খিলাইব, কতা তো রাকবার পারে নাই। সবদিকই দেখা নাগে”
“সত্য কতা যেইডা, কেউ তো পোস্টার নাগাবারই আহে না। আমি তো কই পোস্টার লাগাইলে কেডা ছিড়ব তাত দেখমু। আমরা কৃষক, এহেকবার এহেকজনের ভোট দেই। ভোট তো মনে করেন যে একবারে যদি নিরপেক্ষ হইত তাইলে তো মনে অয় বিম্পি পাশ করত। তারা তো আহেই না ভোট চাবার, কারে ভোট দিমু।”
সেখানকার দোকানদার হাবিবর বলেন, ঘাটাইলের নির্বাচনও অন্যান্য জায়গার মতো হচ্ছে। বিএনপির লোকজন বের হতে পারে না।
“এইহানে মারামারি অয় নাই। মারামারি অইব ক্যামনে, হেরা বাইরই অয় না। মারব ক্যাডা।”
তিনি বলেন, “এমপি আছিল যে, হেয় খালি গরিব মাইনষের কাছে বইছে। চাঁদর কিন্না নিজেই গরিব মানুষের গায়ে দিয়া দিছে। কোনো দালাল ধরে নাই। আমরা এমপি সাবেরে খুব পছন্দ করি।”
সারা জীবন নৌকায় ভোট দিয়েছেন, এবারও ব্যতিক্রম হবে না- বললেন চৌডাল গ্রামের ইদ্রিস আলী।
“এইবার ভোটে শেখ সাহেবরেই ফাস্টে থেইকা দিয়া আইছি। শেখের মার্কায়ই দিমু যতদিন বাইচা আছি। মইরা গেলে তার দিয়া পারমু না।”
মার্কা নয়, ব্যক্তি দেখে ভোট দেন মন্তব্য করে গুইয়া গম্ভীর গ্রামের ভ্যানচালক মামুন বলেন, এবার আতাউর রহমান খানকে তার ভালো লেগেছে।
“আমাদের সন্ধানপুরে মারামারি হানাহানি নাই। যারে আমরা কাজে পামু তারেই ভোট দিমু। যেমন আমাদের সন্ধানপুরে বিএনপির লোকরে আমরা চেয়ারম্যান বানাইছি। সে খুব ভালো লোক, আওয়ামী লীগ-বিএনপি দেহি নাই। খান সাহেব হাজী মানুষ, ভালো মানুষ। বাপের সমতুল্য। আমরা গরিব মানুষ, তাদের কাছে গেলে মনে হয় সুবিধা পামু।”
ঘাটাইল উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন, একটি পৌরসভা এবং একটি ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড নিয়ে টাঙ্গাইল-৩ আসন। এই আসনে মোট ভোটার তিন লাখ ১৮ হাজার ৫৪৬ জন। নারী ভোটার এক লাখ ৬৯ হাজার ৭৬৯ জন এবং পুরুষ ভোটার এক লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৭ জন।