মৌলভীবাজার-২: মুখ সেই দুটোই, বদলে গেছে মার্কা

দীর্ঘদিন ধরে বিএনপিতে থেকেও ধানের শীষ প্রতীক না পেয়ে বিপরীত মেরুর নৌকাতেই চড়ে বসলেন সাবেক বিএনপি নেতা ও সাংসদ এম এম শাহীন। অপরদিকে টানা তিনবার নৌকার প্রার্থী হওয়া সুলতান মনসুর অবস্থান বদলে এবার ধানের শীষের প্রার্থী।

ফয়সাল আতিকও বিকুল চক্রবর্তী, মৌলভীবাজার থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Dec 2018, 05:10 PM
Updated : 25 Dec 2018, 05:49 PM

মৌলভীবাজার-২ আসনে নেতাদের অনুসরণ করে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরাও ব্যাপক হারে দল বদল করছেন। পরিবর্তনের এই স্রোতেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে পাহাড়, টিলা, হাওর-ছড়ি আর সমতল নিয়ে গঠিত কুলাউড়া জনপদের নির্বাচন।

ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে প্রচারণার গতিও বাড়িয়ে দিচ্ছেন প্রার্থীরা। পাশাপাশি একে অন্যের বিরুদ্ধে চালিয়ে যাচ্ছেন বাকযুদ্ধ। অপেক্ষকৃত শান্ত সিলেট অঞ্চলের এই আসনে পাল্টাপাল্টি হামলা ও কার্যালয় ভাংচুরের অভিযোগও আছে।

বিএনপি ছেড়ে বিকল্প ধারায় যোগ দিয়েই নৌকার প্রার্থী হয়েছেন সাবেক সাংসদ এম এম শাহীন

স্থানীয় সাংবাদিক সঞ্চয় কুমার দে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কুলাউড়ায় প্রতিদিনই দৃশ্যপটে বৈচিত্র্য আসছে। ভোটের মাঠে সুনাম-দুর্নাম, দল-বদল, ভোটারের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনায় উভয় প্রার্থী সমানে সমান, যদিও ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মনসুরের পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে।

পালাবদলের এমন মৌসুমেও মৌলভীবাজারের-২ আসন কুলাউড়ায় প্রধান দুই জোটের প্রার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপির সাবেক নেতা তার অনেক সমর্থক নিয়ে নৌকায় উঠেছেন, আর নৌকার অনেক নেতাকেও পরিবর্তনের হওয়ায় ধানের শীষের গুণগান করতে শোনা যাচ্ছে।

দল বদলের সমীকরণ

১৯৯১ সাল থেকে টানা তিনবার নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মনসুর। প্রথমবার জাপা প্রার্থী নওয়াব আলী আব্বাসের কাছে হারলেও ১৯৯৬ সালে বিজয় নিশ্চিত করেন।

২০০১ সালে হারেন বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বী এমএম শাহীনের কাছে। শাহীন সেবার ধানের শীষের মনোনয়ন না পেয়ে ফুটবল প্রতীকে বিএনপি কর্মীদের সমর্থন নিয়ে জেতেন।

২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত পাওয়া সুলতান মনসুর ২০০৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি। ওই নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকের আলী আব্বাস খানকে প্রার্থী করে  আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। এরপর থেকে রাজনীতিতে অনেকটা নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েন সুলতান মনসুর।

ধানের শীষের প্রার্থী হয়েও নিজেকে ‘বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ কর্মী’ দাবি করছেন সুলতান মনসুর

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে ধানের শীষের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর দেশ পরিচালনা নীতির ঘোরবিরোধিতায় আছেন সুলতান মনসুর। তার পোস্টারে শোভা পাচ্ছে বিএনপি চেয়ারপারসনের খালেদা জিয়ার ছবি।

এদিকে ২০০১ সালে বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসাবে ফুটবল প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন এমএম শাহীন। ২০০৮ সালেও মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন তিনি। তবে সেবার হেরে যান মহাজোটের প্রার্থী আলী আব্বাসের কাছে। বিএনপির প্রার্থী আবেদ রাজা তৃতীয় হন। আলী আব্বাস খান মহাজোটের লাঙ্গল না পেয়ে এবার সুলতান মনসুরের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন।

২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন জাপা-আওয়ামী লীগের সমঝোতার নির্বাচনে জাপার নতুন প্রার্থী করা হয় মুহিবুল কাদির চৌধুরীকে। তবে আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী আব্দুল মতিন আনারস প্রতীকে জিতেছিলেন।

সাবেক বিএনপি নেতা শাহীন নৌকার পক্ষে নিয়েছেন বিএনপি নেতাকর্মীদের একাংশকে

এবার নির্বাচনী তোড়জোড়ের মধ্যে বিকল্প ধারায় যোগ দেওয়ার আগে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ছিলেন শাহীন।        

হাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উপজেলা বিএনপির সাবেক প্রচার সম্পাদক আব্দুল বাসিত বাচ্চু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করার সময় যেসব বিএনপিকর্মী শাহীনের সঙ্গে ছিলেন তাদের ৭০ ভাগ এখনও আছেন। মাঝখানে যোগ হয়েছে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ফলে তার জয় সুনিশ্চিত।”

বর্তমান উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ তোফাজ্জল হোসেন তফই, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আজিজ চৌধুরী শামীম বিকল্প ধারার প্রার্থী শাহীনের হয়ে কাজ করছেন বলে জানান তিনি।  

অপরদিকে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী সুলতান মনসুর বলেন, “এলাকার সর্বস্তরের মানুষ আমার সঙ্গে আছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও পরোক্ষভাবে আমার পক্ষে কাজ করছে। বিএনপিকর্মীরা নিজ উদ্যোগে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করছে।”

‘মুজিব কোট’ পরেই ধানের শীষের প্রচারে যাচ্ছেন সুলতান মনসুর

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে কোনো দলের হয়ে নয়; ব্যক্তি হিসাবেই মুজিব কোট পরে ধানের শীষে নির্বাচন করছেন সুলতান মনসুর। ভোটারদের কাছে পরিচয় দিচ্ছেন ‘বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ কর্মী’ হিসাবে। প্রথম দিকে তার নির্বাচনী পোস্টারে খালেদা জিয়ার ছবি না থাকলেও নতুন করে খালেদার ছবি দিয়ে পোস্টার ছাপানো হয়েছে।

সুলতান মনসুর বলেন, মঙ্গলবারও কুলাউড়ার বিভিন্ন এলাকায় প্রচারণা চালিয়েছেন তিনি।

“প্রচারণার সময় প্রতিপক্ষের কর্মীদের তুলনায় বেশি বাধার মুখে পড়েছেন পুলিশের।”

পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

এমএম শাহীনের সহকারী জসিম চৌধুরী অভিযোগ করেন, সুলতান মনসুরের লোকজন তাদের চার-পাঁচটি অফিসে হামলা চালিয়েছে।

“জামাত-শিবির ও বিএনপি কর্মীরা একত্রিত হয়ে এসব কাজ করছে।”

কাদীপুর ইউনিয়নের ডুলিপাড়া বাজার, রবির বাজারে, হাজিপুর ইউনিয়নের মনু এলাকায়, ভাটারা বাজার অফিসে হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

অপরদিকে সুলতান মনসুরও পুলিশ এবং প্রতিপক্ষ শাহীনের অনুসারীদের বিরুদ্ধে তার প্রচারে হামলা চালানোর অভিযোগ করেছেন। এমনকি সেনা মোতায়েনের পরও পরিস্থিতির উন্নয়ন হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।

“পরিস্থিতি যতই খারাপ হয় আমি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী কাজ চালিয়ে যাব। ভোট যদি সুষ্ঠু না হয় তাহলে ঐক্যফ্রন্ট কেন্দ্রীয়ভাবে যে সিদ্ধান্ত নেবে সে অনুযায়ী কাজ করব,” বলেন তিনি।