বৃহত্তর ফরিদপুরের প্রায় সব এলাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকতে পারলেও নিজের আসনে ঘাম ঝরে যাচ্ছে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহর।
Published : 24 Dec 2018, 11:08 PM
ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা-সদরপুর-চরভদ্রাসন) আসনে গতবার স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সন চৌধুরীর কাছে হারের পর এবারও কোনঠাসা অবস্থায় রয়েছেন জাফর উল্যাহ।
এই আসনে প্রচার-প্রচারণায় সিংহ প্রতীকের নিক্সনের কাছে ম্রিয়মান দেখাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে। স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের হলেও তারা কাজ করছেন সিংহের পক্ষে।
নিক্সনের বিরুদ্ধে জাফর উল্যাহ একের পর এক অভিযোগ দিয়ে যাচ্ছেন নির্বাচন কমিশনে; তবে নিক্সন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তাকে চাপে রাখতে এই কৌশল নিয়েছেন জাফর উল্যাহ।
বঙ্গবন্ধুর এলাকা বৃহত্তর ফরিদপুরে বরাবরই আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান; ফরিদপুর-৪ আসন থেকেও বরাবরই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই জিতে আসছেন। সাম্প্রতিককালে ১৯৯১ সালেই নৌকার বাইরে কেউ জিতেছিলেন। ওই নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থী জেতেন ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়ার ছেলে চৌধুরী আকমল ইবনে ইউসুফ। এরপর থেকে আসটি আবার আওয়ামী লীগের।
আওয়ামী লীগের একচেটিয়া আধিপত্যের মধ্যে জাফর উল্যাহ ২০০৮ সালে নির্বাচন করতে না পারায় তার স্ত্রী নিলুফার জাফর হন এমপি।
এরপরই আবির্ভাব ঘটে মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের (নিক্সন চৌধুরী)। বঙ্গবন্ধুর বোন ফাতেমা বেগমের নাতি তিনি। নিক্সনের বাবা ছিলেন মাদারীপুরের শিবচরের সংসদ সদস্য। তার ভাই নূরে আলম চৌধুরী (লিটন চৌধুরী) এখন ওই আসনের এমপি।
পৈত্রিক এলাকায় ভাই নির্বাচন করায় নিক্সন বেছে নেন লাগোয়া আসনটি, যা ফরিদপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও প্রথম নির্বাচনেই চমক দেখাতে তাকে খুব বেগ পেতে হয়নি।
২০১৪ সালের বিএনপিবিহীন নির্বাচনে জাফর উল্যাহকে হারানোর পর এবারও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন তিনি।
চরভদ্রাসন ও সদরপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে নিক্সনময় প্রচার। বেশ কিছু স্থানে ছেঁড়া পোস্টার দেখা গেছে। ওই এলাকার লেগুনাচালক বললেন, এগুলো জাফর উল্যাহর পোস্টার ছিল।
মোহাম্মদ আনিসুর রহমান খান নামে এক ভোটার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা ভাঙ্গা ও চরভদ্রাসনে দুটি প্রচারণায় আসলেও আওয়ামী লীগ জিততে পারেনি। এবারও তেমনি মনে হচ্ছে।”
আওয়ামী লীগে নিক্সনপ্রীতি
আগে শুধু ভাঙ্গা উপজেলা ছিল ফরিদপুর-৪ আসনে; ২০০৮ সালে চর ভদ্রাসন ও সদরপুর উপজেলাও এতে যুক্ত হয়।
স্থানীয়রা জানিয়েছে, বর্তমানে চরভদ্রাসনে বিএনপির বেশ কিছু সমর্থক আছে। এছাড়া ভাঙ্গা ও সদরপুরের আওয়ামী লীগ নেতারাও নিক্সনের সঙ্গে।
সদরপুরের ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে কৃষ্ণপুর বাদে বাকি ৮টি ইউনিয়ন ফরিদপুর-৪ আসনে পড়েছে। এই ৮টি ইউনিয়ন পরিষদের ৬ জন চেয়ারম্যানই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের হারিয়েছে। তারা নিক্সনের সমর্থন দিচ্ছে।
বাকি দুজন চরমানাইয়ের ইউনিয়ন পরিষদের আইয়ুব আলী ও চরবিষ্ণুপুরের মোয়াজ্জেম হোসেন মিয়া আওয়ামী লীগ সমর্থক হিসেবে জাফর উল্যাহর সমর্থন দিচ্ছেন।
গত বছর ভাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বরখাস্ত করা হয় নিক্সনকে সমর্থন দেওয়ার কারণে।
বর্তমান সভাপতি সাইফুর রহমান মিরন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অপজিশনের (নিক্সন) সাথে গোপন আঁতাত ও সংগঠনবিরোধী ভূমিকার কারণে, শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সভাপতি কাজী হেদায়েতুল্লাহ সাকলাইন ও সাধারণ সম্পাদক ফাইজুর রহমাকে বরখাস্ত করা হয়।”
গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ‘দুর্বল প্রার্থীদের’ নির্বাচনে দাঁড় করানোর সুপারিশ করে আওয়ামী লীগকে হারানো হয় বলে তার অভিযোগ।
সদরপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো. হারিজুল রহমান ও জিনিয়া নাজনীন কল্পনা আওয়ামী লীগের হলেও সমর্থন দিচ্ছেন নিক্সনকে। হারিজুল উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বর্তমান কমিটিতে আছেন।
নিক্সনকে সমর্থনের কারণ হিসেবে হারিজুল রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নৌকার মাঝি নিয়ে বিতর্ক। তাকে (নিক্সন) বাদ দেয় নাই, তাই আমরা কাজী জাফর উল্যাহর সাথে নাই। মানুষের চাওয়া থাকে। আমরা উনার মাধ্যমে কিছু দিতে পারি নাই মানুষকে।”
বিএনপির মধ্যেও নিক্সন
সত্তরের বেশি বয়সী অবসরপ্রাপ্ত জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল কালাম শামসুদ্দিন আগে বিএনপির সমর্থক ছিলেন। কিন্তু সর্বশেষ নির্বাচনে তিনি নিক্সনকে ভোট দেন।
কেন তিনি তা করলেন- এর জবাবে শামসুদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিএনপি গত নির্বাচনে ভুল করছে। টিকে থাকতে পারছে না। আর আওয়ামী লীগ কোনো কাজ দেখাতে পারে নাই। তাই বিএনপিকে বাদ দিয়ে নিক্সনকে সমর্থন দিছি। .. এবারও দেব।”
লিমা একজন চাকরিজীবী নারী। তিনিও আগে বিএনপির সমর্থক ছিলেন। কিন্তু দলটির প্রতি সমর্থন ছেড়ে তিনি সিংহ প্রতীকে ভোট দিবেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “বিএনপি ফিল্ডে কাজ করতে পারছে না।”
এলাকার উন্নয়নকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তিনি নিক্সনের সমর্থক হয়েছেন বলে জানান।
কেন নিক্সন?
সৌদি প্রবাসী মো. দেলোয়ার সম্প্রতি দেশে এসেছেন। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভাসানচর ইউনিয়নে আগে বিদ্যুৎ ছিল না। এখন বিদ্যুৎ এসেছে। আখুটের ইউনিয়ন পরিষদে মাটির রাস্তা পাকা হয়েছে।
মুসল মণ্ডল প্রায় ৬০ বছর ধরে রিকশা চালান। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি মানুষ দেখে ভোট দেই। রাস্তা-ঘাটে গাড়ি চালাই। এখন রাস্তাঘাটের অনেক কাজ হইছে।”
১২ বছর ধরে গাড়ি চালানো মীর বলেন, “নিলুফারের (জাফরউল্লাহর স্ত্রী) চেয়ে নিক্সনের কাজ বেশি। দেশের কথা চিন্তা করলে নৌকায় ভোট দিতে চাই। কিন্তু এলাকার উন্নয়নের কথা মনে হইলে নিক্সনরে ভোট দেওয়ার কথা চিন্তা হয়।”
সদরপুর থেকে চরভদ্রাসন লেগুনায় যেতে পাঁচজনের সাথে কথা হয় যারা সবাই নিক্সনের গুণগান গাইছিলেন। তারা বলছেন, জাফর উল্যাহর সময় উন্নয়ন হয়নি, নিক্সনের সময় হচ্ছে।
তবে নির্বাচনী প্রচারে কাজী জাফর উল্যাহ দাবি করছেন, গত নির্বাচনে নির্বাচিত না হয়েও তিনি ১ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকার কাজ করেছেন।
কিন্তু স্থানীয়রা তার বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতা, এলাকায় কম আসা, তার কাছে পৌঁছাতে না পারার অভিযোগ করেছে।
জাফরের নির্বাচন প্রচার কমিটির চেয়ারম্যান এ কে এম মতিউর রহমান বলছেন, এসব অভিযোগ ‘মিথ্যা’।
তার দাবি, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জাফর উল্যাহ ৬৫ শতাংশ ভোট পাবেন।
গতবার বিএনপি না থাকাতে নিক্সন সুবিধা পেলেও এবার সহজ হবে না বলে মনে করেন লেগুনাচালক মীর।
“গতবার লাঙ্গল, বিএনপিসহ অনেক ভোটই তো পাইছে নিক্সন। এইজন্যই আগায়া গ্যাছিল। এবার সেটা পাবে না।“
ওয়াজেদ মোল্লা নামের চর ভদ্রাসনের একজন দোকানি বলেন, যেহেতু আমি আগে থেকেই আওয়ামী লীগ করি, তাই আওয়ামী লীগকেই এবার ভোট দেবো।
সংঘর্ষ: নিক্সন বনাম জাফর
গত ১৬ ডিসেম্বর নিক্সনের সমর্থক সদরপুর উপজেলার ঢেউখালী ইউনিয়নের মো. ওমর ফারুক ব্যাপারী ও আওয়ামী লীগ সমর্থক মো. শিশু খানের কর্মীদের মাঝে সংঘর্ষ হয়। উভয় পক্ষের প্রায় ৩০ জনের মতো আহত হন।
এর মাঝে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা বেশি আহত হয় বলে জানান নিক্সন সমর্থক হারিজুল রহমান।
পুলিশ ফারুককে আটক করলে সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সদরপুর থানা অবরুদ্ধ করে রাখে নিক্সন সমর্থকরা। এরপর আচরণ বিধি ভঙ্গের দায়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে এমপির মুচলেকায় ছেড়ে দেওয়া হয় ফারুককে।
এছাড়া গত ১৮ ডিসেম্বর নিক্সনের বিরুদ্ধে ত্রাস ছড়ানোর অভিযোগ ইসিকে জানায় জাফর উল্যাহ শিবির। আওয়ামী লীগ কর্মীদের গুলি করা, প্রচারণায় বাধাদানসহ সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন-রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে ও থানায় ২০টির মতো অভিযোগ করেছেন জাফর সমর্থকরা।
কী বলছেন নিক্সন
গতবারের মতো এবারও ভোটে জিততে ‘১০০ ভাগ’ আশাবাদী স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সন। তার দাবি, ৮০ শতাংশ ভোট তিনি পাবেন।
কেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছেড়ে দিয়েছিলাম। নমিনেশন জাফর উল্যাহকে দেবে দেখে আমি নমিনেশন চাইনি।”
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর অভিযোগের বিষয়ে নিক্সন বলেন, “এগুলো জাফর উল্যাহর ষড়যন্ত্র। সে ইচ্ছে করেই ঝামেলা পাকাতে চাচ্ছে। কারণ তার ভোট নাই। ষড়যন্ত্রে কাজ হবে না। জনগণ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। ষড়যন্ত্রকারীদের ভোট হবে না।”
তিনি উল্টো অভিযোগ করেন, “আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রেসারে রাখা হচ্ছে।”
সুবিধায় নেই বিএনপি
স্থানীয়রা জানায়, একে তো চরভদ্রাসন ছাড়া বিএনপির তেমন কোনো ভোটার নেই। তার উপর বিএনপির অনেক সমর্থকই নিক্সনকে অনেকটা প্রকাশ্যেই সমর্থন দেওয়ায় বেকায়দায় দলটি।
চরভদ্রাসন ও সদরপুর উপজেলা ঘুরে বিএনপির পোস্টার চোখে পড়েনি। চরভদ্রাসন ছাড়া অন্য দুই উপজেলার বিএনপির খুব একটা সমর্থন নেই বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
তবে সদরপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম রব্বানী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুধু সদরপুরের সব ইউনিয়নের জন্য ১ লাখ পোস্টার ছাপিয়েছিলাম। এখন একটা পোস্টারও নাই। সব ছিঁড়ে ফেলেছে রাতের বেলা। এখন আপাতত পোস্টার লাগানো বন্ধ করে দিয়েছি।”
রিটার্নিং কর্মকর্তাকে অভিযোগ করেননি- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের কথা কেউ শোনে না। সবাই শুধু আই ওয়াশ করে।”
বিএনপির প্রার্থী খন্দকার ইকবাল হোসেন সেলিম অভিযোগ করেন, তাদের ক্যাম্পে এসে হুমকি দেওয়া হয়।
কিন্তু কারা দিয়েছে- এ প্রশ্নে কারও নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, “আমাদের কর্মীদের হুমকি দিয়ে বলা হয়, নৌকা করেন, নইলে ঘরে বসে থাকেন।”
এই আসনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া নিয়ে নিরাশা প্রকাশ করে ধানের শীষের প্রার্থী বলেন, “সেনাবাহিনী নামলে ও সিইসি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করলে আমি জিতব।”
আসনটিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ মিয়া (হামিদ মাস্টার) রয়েছেন, তার হাতপাখা প্রতীকের পক্ষে মাইকিং চলতে দেখা গেছে, তবে পোস্টার খুব একটা চোখে পড়েনি।
হামিদ অভিযোগ করেন, চরমানাইর ইউনিয়নে তার একটি নির্বাচনী ক্যাম্পে কিছু লোকজন বাধা দিয়েছিল। কিন্তু কারা বাধা দিয়েছিল, সে বিষয়ে তিনি কিছু বলতে চাননি।
এছাড়া ভাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক অপু এবং চরভদ্রাসন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইসাহাক মিয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে থাকলেও তারা ফলাফলে কোনো প্রভাব ফেলতে পারবেন না বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।