আওয়ামী লীগের ‘হেভিওয়েট’ যারা কঠিন লড়াইয়ের সামনে

টানা দুই মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার পর তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনে আওয়ামী লীগ আশাবাদী হলেও ক্ষমতাসীন দলটির বেশ কয়েকজন নেতাকে নিজ এলাকায় শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হচ্ছে।

কাজী মোবারক হোসেন নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Dec 2018, 06:16 PM
Updated : 18 Dec 2018, 07:00 PM

আওয়ামী লীগের এই ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থীদের মধ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও রয়েছেন; আছেন আমির হোসেন আমু, কাজী জাফর উল্যাহ, রমেশ চন্দ্র সেন, মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মতো বর্ষীয়ানরাও।

আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল অংশ নেওয়ায় তাদের জিতে আসাটা কষ্টকর হবে বলে আগের ভোট বিশ্লেষণ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের দলের হেভিওয়েট কিছু নেতাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা তো আছেই। কিছু কিছু নেতা ঝুঁকির মধ্যে আছে।”

তবে শেখ হাসিনার দিকে চেয়ে ভোটাররা নৌকায় ভোট দিলে সেই সমস্যা কেটে যাবে বলে আশা করছেন দলটির এই নেতা।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী কাদেরের আসন নোয়াখালী-৫ (কোম্পানীগঞ্জ) এ তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক মন্ত্রী মওদুদ আহমদ।

এই আসনটিতে দুজনই পালাক্রমে জয়ী হয়ে আসছেন। ১৯৯১ সালে মওদুদ, ১৯৯৬ সালে কাদের, ২০০১ সালে মওদুদ এবং ২০০৮ সালে কাদের জয়ী হয়েছিলেন।

সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে (২০০৮ সালে) ওবায়দুল কাদের জিতেছিলেন মাত্র ১ হাজার ৩৭১ ভোটে। কাদের পেয়েছিলেন ১,১২,৫৭৫ ভোট আর মওদুদ আহমেদ পেয়েছিলেন ১,১১,২০৪ ভোট।

এবার আসনটিতে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকে একজন প্রার্থী রয়েছেন, জামায়াতেরও কিছু ভোট রয়েছে আসনটিতে। যা বিএনপি প্রার্থী মওদুদকে সুবিধা দেবে বলে স্থানীয়রা বলেছেন।  

এসব মিলিয়ে ১০ বছর পর ভোটে দাঁড়িয়ে এবার মওদুদ জয়ের বিষয়ে বেশ আশাবাদী। কারণ তিনি যে কবার জিতেছেন, বড় ব্যবধানেই জিতেছেন; হারের ক্ষেত্রে ব্যবধান ছিল কম।

তবে কাদের আশাবাদী নিজের জয়ের বিষয়ে। সম্প্রতি এলাকায় প্রচার চালিয়ে এসে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন,  “সেখানে আমি যা দেখেছি অভূতপূর্ব, এমন জনস্রোত আমি ২০০৮ সালেও দেখিনি।”

নিজের এলাকায় ভোটের প্রচারে প্রায়ই ছুটে যাচ্ছেন ওবায়দুল কাদের

ঝালকাঠি-২ (সদর) আসনে নৌকা প্রতীকে ভোট করছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমু। বিএনপির জীবা আমিন ধানের শীষ প্রতীকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।

আওয়ামী লীগের এক সময়ের প্রভাবশালী নেতা আমু ভোটের লড়াইয়ে বরাবরই পিছিয়ে। ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে টানা হারের পর ১৯৯৬ সালে ঝালকাঠি-২ আসন থেকে উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসেন তিনি।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আমু ১,০৪, ৪৪১ ভোট পেয়ে জয়ী হন; বিএনপির প্রার্থী ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো হেরেছিলেন ৭৩, ৮৫৩ ভোট পেয়ে।

ভোটের ইতিহাসই পিছে টানছে আমুকে; সেই সঙ্গে এবার তার গলার কাঁটা হয়ে আছেন জাতীয় পার্টির একজন প্রার্থী। আসনটিতে বরাবরই লাঙ্গল প্রতীক ১৫-২০ হাজার ভোট পেয়ে আসছে।

ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা-সদরপুর-চরভদ্রাসন) আসনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহর সমস্যা ভিন্ন রকম; বঙ্গবন্ধুর এলাকায় তার আত্মীয় মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন ঝামেলা নিয়ে এসেছে তার জন্য।

এই আসনে ২০০১ সালে জাফর উল্যাহ জয়ী হওয়ার পর ২০০৮ সালে তার স্ত্রী নিলুফার জাফরও জয়ী হয়েছিলেন। এরপরই আবির্ভাব ঘটে নিক্সনের।

২০১৪ সালের বিএনপিবিহীন নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়েও স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সনের কাছে হারতে হয়েছিল জাফর উল্যাহকে। এবারও সিংহ প্রতীকে নিক্সন স্বতন্ত্র প্রার্থী। ফলে জাফর উল্যাহর ক্ষেত্রে গতবারের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা দেখছেন স্থানীয় অনেকে।

তারপরও নিজের জয়ের বিষয়ে আশাবাদী জাফর উল্যাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০১৪ সালে এখানে অন্য দলের কোনো প্রার্থী ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নাতি বলে পরিচয় দিয়ে গতবার জয় পেয়েছে নিক্সন। এবার নৌকার লোকেরা নৌকাকেই ভোট দেবে বলে আমি আশা করি। আমি মনে করি জয় আমিই পাব।”

জাফর উল্যাহর জয়ের আশায় বড় বাধা স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সন চৌধুরী

তবে সারাদেশে যেখানে বিএনপির প্রার্থীরা নানা অভিযোগ দিয়ে আসছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিরুদ্ধে; সেখানে স্বতন্ত্র নিক্সনের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ ইসিতে দেওয়া হয়েছে জাফর উল্যাহর পক্ষ থেকে।

ঠাকুরগাঁও-১ আসনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীই তার জন্য প্রধান সমস্যা। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই আসনে প্রার্থী।

২০০৮ সালের নির্বাচনে রমেশ ১,৭৭,১০১ ভোট পেয়ে হারিয়েছিলেন ফখরুলকে (১,২০,৪১১ ভোট)। তার আগে ২০০১ সালের নির্বাচনে ৯৬, ৯৪৮ ভোট পেয়ে হেরেছিলেন রমেশ; ফখরুল সেবার জিতেছিলেন ১,৩৪,৯১০ ভোট পেয়ে।

খালেদা জিয়ার বন্দি হওয়ার পর বিএনপির কেন্দ্রে থেকে ফখরুলের যে পরিচিতি গড়ে উঠেছে, তাতে তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া এবার রমেশের জন্য কঠিন হবে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

চাঁদপুর-১ (কচুয়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের জন্য লাঙ্গল কাঁটা হয়ে দেখা দিতে পারে। 

২০০১ সালের নির্বাচনে ৬২,৫৩৭ ভোট পেয়ে বিএনপির প্রার্থী এহছানুল হক মিলনের (৮৫,৫০৭ ভোট) কাছে হেরে গেলেও পরের নির্বাচনে ১,০৭,৪১৬ ভোট পেয়ে জেতেন মহীউদ্দীন আলমগীর।

বিএনপি প্রার্থী বদলে ধানের শীষ দিয়েছে অনেকটাই অচেনা মোশাররফ হোসেনকে। তা নিয়ে মিলন সমর্থকদের ক্ষোভ মহীউদ্দীন আলমগীরকে সুবিধা দিলেও জাতীয় পার্টির এমদাদুল হক প্রার্থী হয়ে তাতে ভাটা তৈরি করতে পারেন বলে স্থানীয়দের অভিমত।

ঢাকা-১ (দোহার) আসনে নৌকার প্রার্থী, আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে এসেছেন ওই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য সালমা ইসলাম।

এবার নৌকার প্রার্থী সালমান এফ রহমানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র সালমা ইসলাম

আসনটি দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির কব্জায় ছিল। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের আবদুল মান্নান খান বিজয়ী হলেও ২০১৪ সালের বিএনপিবিহীন নির্বাচনে তাকে হারতে হয় জাতীয় পার্টির সালমার কাছে।

যমুনা গ্রুপের কর্ণধার নুরুল ইসলাম বাবুলের স্ত্রী সালমা এবার জাতীয় পার্টির মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও তাকে ফেলে দেওয়ার কাতারে ফেলছেন না স্থানীয়রা। আর সালমান এখনও সংসদ নির্বাচনে জয়ের দেখা পাননি।

ফলে সেখানে দুই ধনাঢ্য প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাসই মিলছে।

কুমিল্লা-১১ (চৌদ্দগ্রাম) আসনে আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রেলমন্ত্রী মজিবুল হকের জয় পেতেও কাঠখড় পোহাতে হবে।

এই আসনে বিএনপি-জামায়াত আলাদাভাবে ভোট করায় ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জিতেছিলেন মুজিবুল। অন্যগুলোতে হারতে হয়েছিল তাকে।

২০০৮ সালে জয়ী হওয়ার পর ২০১৪ সালের বিএনপিবিহীন ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া মুজিবুল তার পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী সৈয়দ আবদুল্লাহ তাহেরকেই পাচ্ছেন এবার। তবে অন্য বার তাহের দাঁড়ি পাল্লায় ভোট করলেও এবার তার প্রতীক ধানের শীষ।

নিবন্ধন না থাকায় বিএনপির প্রতীকে ভোট করতে আসা তাহেরকে আগের মতোই শক্তিশালী ভাবছেন স্থানীয়রা। ২০০১ সালে তাহের ১,০৮,৪০৭ ভোট পেয়ে জিতেছিলেন, তার প্রায় অর্ধেক ভোট পেয়েছিলেন মুজিবুল। ২০০৮ সালে মুজিবুল ১,০১,২০১ ভোট পেয়ে জিতেন, তাহের পান ৭৭,৯২৪ ভোট।

শক্ত পাল্লার তাহেরের পাশাপাশি জাতীয় পার্টির খায়ের আহম্মেদ ভুইয়া লাঙ্গল প্রতীকে ভোটের লড়াইয়ে থাকায় সেটাও মুজিবুলের জন্য পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে।

চাঁদপুর-৩ (সদর) আসনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। আসনটিতে ঐক্যফ্রন্টের ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করছেন শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক।

দীপু মনি টানা কয়েকবার এই আসনে জিতে এলেও এবার দলের মধ্যেই শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়েছিলেন। সেই লড়াইয়ে জিতে নৌকা প্রতীক পেলেও কোন্দল মিটিয়ে জয় ঘরে তোলাই এখন তার মূল চ্যালেঞ্জ।

আওয়ামী লীগ নেতারা আশা করছেন, শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা কাটিয়ে দেবে নৌকার প্রার্থীদের দুর্বলতা

নরসিংদী-১ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম হীরু। এই আসনটি ‘বিএনপির দুর্গ’ বলে পরিচিত। বিএনপির প্রার্থী এখানে খায়রুল কবির খোকন।

দীর্ঘদিন পর ২০০৮ সালে সাবেক সেনা কর্মকর্তা হীরু আসনটিতে নৌকাকে জয়ী করলেও ভোটের ব্যবধান ছিল ১৭ হাজারের মতো।

প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে ১০-১৫ হাজার ভোট পেয়ে আসা জাতীয় পার্টির শফিকুল ইসলাম ভোটের লড়াইয়ে থেকে নৌকার হীরুর জয়ের পথে কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছেন। 

ভোলা-৪ (মনপুরা-চরফ্যাশন) আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপমন্ত্রী আব্দুলাহ আল ইসলাম জ্যাকবকে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করতে হবে বিএনপির নাজিম উদ্দিন আলমের সঙ্গে।

কয়েকবারের সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিনকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ১,৩৪,৮৩১ ভোট পেয়ে হারিয়েছিলেন জ্যাকব। ডাকসুর সাবেক এজিএস নাজিম উদ্দিন আলম পেয়েছিলেন ৯৫,৭৩২ ভোট।

তার আগে ২০০১ সালে জ্যাকব হেরেছিলেন নাজিমের কাছে। জ্যাকব পেয়েছিলেন ৫১,৯৩৬ ভোট, জয়ী নাজিমের ভোট ছিল ৯৪,২২৬।

মাগুরা-২ আসনে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদারকে বিএনপির নিতাই রায় চৌধুরীর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হবে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাদের ভোটের পার্থক্য ছিল ৫ হাজারের মতো।

জয়পুরহাট-২ আসনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপনকে এবার মোকাবেলা করতে হবে বিএনপির আবু ইউসুফ খলিলুর রহমানকে। ধানের শীষ প্রতীকের এই প্রার্থী তিনবার জেতার পর মাঝে বিরতি দিয়েছিলেন।

২০০৮ সালে আসনটিতে নৌকার স্বপন হেরেছিলেন বিএনপির গোলাম মোস্তফার কাছে। ২০১৪ সালের বিএনপিবিহীন নির্বাচনে প্রথম সংসদ সদস্য হন স্বপন।

এবার খলিলুর ধানের শীষ নিয়ে ফিরে আসার পাশাপাশি জাতীয় পার্টির আবুল কাশেম প্রার্থী থাকায় বেকায়দায় রয়েছেন স্বপন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আশাবাদী, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের উন্নয়ন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরদের দুর্বলতা ঢেকে দেবে।

তিনি বলেন, “গ্রামের মানুষ শেখ হাসিনাকে হারাতে চায় না। এই উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে গ্রামের মানুষ আবারও শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চায়।”