যে পথ ধরে দেশকে উচ্চ আয়ের কাতারে নিতে চায় আ. লীগ

বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার যে স্বপ্ন আওয়ামী লীগ দেখিয়ে আসছে, তার এক ধরনের রূপরেখা এসেছে এক দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা দলটির নির্বাচনী ইশতেহারে। 

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Dec 2018, 02:18 PM
Updated : 18 Dec 2018, 03:48 PM

আর সেই স্বপ্ন পূরণে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারও নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে টানা তৃতীয়বারের মত আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের ইশতেহার ঘোষণা করে ভোটারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমি কথা দিচ্ছি, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আরও সুন্দর ভবিষ্যত নির্মাণ করব। জাতির পিতার কাঙ্ক্ষিত ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতামুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলব।”

২০২১ সালের রূপকল্প সামনে তুলে ধরে নবম সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন শেখ হাসিনা। পাঁচ বছর পর দশম সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে তিনি ঘোষণা দেন, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় গেলে রূপকল্প-২০৪১ ঘোষণা করা হবে, যা বাংলাদেশকে ২০৫০ সালের মধ্যে নিয়ে যাবে উন্নত দেশের তালিকায়।

আওয়ামী লীগের এই দুই মেয়াদে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭.৮৬ শতাংশ হয়েছে। মাথাপিছু আয় ৪২৭ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭৫১ ডলার।

এর ফলে বিশ্ব ব্যাংক ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে তাদের তালিকায় নিম্ন মধ‌্যম আয়ের দেশের কাতারে তুলে এনেছে। কিন্তু উচ্চ আয়ের দেশের কাতারে পৌঁছাতে হলে মাথপিছু আয় হতে হবে বছরে ১২ হাজার ৫৬ ডলারের বেশি।

 

২০৪১ সালে বাংলাদেশকে ওই পর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে আগামী দিনগুলোতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে হবে দুই অংকের ঘরে। কীভাবে তা সম্ভব তারই একটি ‘কৌশল ও পরিকল্পনা’ এসেছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে।

শেখ হাসিনা বলেন, “উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে যুগোপযোগী কৌশল দাঁড় করিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির ধারাকে অগ্রসর করে নেওয়াই আমাদের চ্যালেঞ্জ।

আওয়ামী লীগ বলছে, ক্ষমতায় গেলে তারা ২০১৯-২৩ সময়কালের লক্ষ্যমাত্রা ও কর্মসূচির সঙ্গে ভবিষ্যত উন্নয়ন পরিকল্পনা ও লক্ষ্যমাত্রাকে এমনভাবে সমন্বয় করবে, যাতে দেশ ‘ধারাবাহিকভাবে সুদূরপ্রসারি লক্ষ্য অভিমুখে অগ্রসর’ হয়।

এই কৌশল ও পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশকে পরিচালনা করা গেলে ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে পৌঁছাবে এবং পরের ১১ বছরে তা ধারাবাহিভাবে দুই অংকের ঘরে থাকবে বলে আওয়ামী লীগ আশা করছে।

এই প্রাক্কলন ঠিক থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হবে ৫৪৭৯ ডলার; আর ২০৪১ সালে হবে ১৬৯৯৪ ডলার। অর্থাৎ, ততদিনে বাংলাদেশ উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হবে বলে আওয়ামী লীগের প্রত্যাশা।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআই এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার এই আকাঙ্ক্ষা ইতিবাচক।

“অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি রূপরেখাও এখানে এসেছে। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুই অংকে নিয়ে যেতে রাজস্ব আহরণ কতটা কীভাবে বাড়বে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো দিক নির্দেশনা এখানে দেখা যায়নি।” 

মঙ্গলবার ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

কৌশল ও পদক্ষেপ

ইশতেহারে বলা হয়েছে, উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্যপূরণ করতে হলে ২০৪১ সালের মধ্যে বিনিয়োগের হার জিডিপির ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। পর্যাপ্ত অবকাঠামো নির্মাণ ও সেবার ব্যবস্থা করতে হবে। রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ব্যাংক ও বীমা খাতের সেবা সম্প্রসারণ, দক্ষতা ও দায়বদ্ধতাও নিশ্চিত করতে হবে।

আওয়ামী লীগ বলছে, এসব পরিকল্পনা ব্স্তবায়নে তারা পুঁজি বাজারের সম্প্রসারণ ও গভীরতা বাড়ানোর কাজ অব্যাহত রাখবে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা নেবে।

অর্থনীতির চাকা আরও দ্রুত ঘোরাতে মোট জনসংখ্যায় কর্মক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যার আনুপাতিক সুবিধাকে পুরো মাত্রায় কাজে লাগাতে চায় আওয়ামী লীগ। সেই লক্ষ্যে ক্ষমতায় গেলে তারা ‘শোভন কাজের’ পরিসর বৃদ্ধি করবে, শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে এবং নতুন প্রযুক্তির বিকাশে গুরুত্ব দেবে।

পাশাপাশি ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সঞ্চয়কে বিনিয়োগে রূপান্তরের সুযোগ তৈরির প্রতিশ্রুতি রয়েছে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে। 

তরুণ জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বাড়াতে উপজেলায পর্যায়ে বাস্তবায়নে থাকা ১১৯টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের সঙ্গে একই ধরনের আরও ৩৮৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পরিকল্পনার কথা বলেছে আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি শিল্পনির্ভর প্রবৃদ্ধির জন্য ‘জ্ঞান ও প্রযুক্তি ভিত্তিক’ উৎপাদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা রয়েছে ইশতেহারে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে রপ্তানি বাড়াতে বিভিন্ন প্রণোদনার কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করে সংস্কার ও সমন্বয় করবে। শিল্প বিকাশের জন্য শুল্ক-করে দেওয়া হবে বিশেষ ছাড়। তাতে তরুণদের মধ্যে থেকে দক্ষ উদ্যোক্তা শ্রেণি সৃষ্টি হবে।

আয়কর, ভ্যাট ও সম্পূরক শূল্কের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে। সেখানে বলা হয়েছে, মূসক আইন নিয়ে জটিলতা সারিয়ে বাস্তবায়নযোগ্য করা হবে। আয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে আয়করের পরিধি ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হবে।

ক্ষমতায় গেলে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে আওয়ামী লীগের। তাতে বয়স্ক পুরুষদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সার্বিক দারিদ্র্যের হার শূণ্য শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে তারা কাজ করবে।

চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অব্যাহত রাখার পাশাপাশি শিল্প-কৃষি খাতে কোটি মানুষের কর্মসংস্থান, ২০২০ সালের মধ্যে সকলের জন্য বিদ্যুত, অবকাঠামোর উন্নয়নসহ বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এসেছে তাদের ইশতেহারে।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) দ্বিগুণ করার জন্য জাতীয় আয়ের ৯ শতাংশ এডিপিতে খরচ করতে চায় আওয়ামী লীগ। সেজন্য বাজেট কৌশলে ‘সমন্বয়’ করবে তারা। একটি শক্তিশালী বেসরকারি খাত যাতে আরও বেশি রাজস্ব যোগানোর সক্ষমতা অর্জন করতে পারে, সেই লক্ষ্যে পরিকল্পনা সাজাবে।

ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার এবং দেউলিয়া আইন বাস্তবায়নের টেকসই ও কার্যকর পদ্ধতি খুঁজে বের করার কথা বলা হয়েছে ইশতেহারে।

আগামীবার ক্ষমতায় গেলে ঋণসহ ব্যাংক জালিয়াতি ‘কঠোর হস্তে ’দমন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঋণ গ্রাহক ও দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আওয়ামী লীগ, যা নিয়ে তাদের গত দশ বছরে বিস্তর সমালোচনা সইতে হয়েছে।