‘তুরুপের তাস’ হয়ে উঠতে পারে তরুণ ভোটার

ভোটার তালিকায় গত ১০ বছরে যুক্ত হয়েছেন সোয়া দুই কোটি তরুণ ভোটার; একাদশ সংসদ নির্বাচনে ফলাফলের নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারেন তারা।

মঈনুল হক চৌধুরীও তাবারুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Dec 2018, 04:06 AM
Updated : 18 Dec 2018, 04:11 AM

এ বিষয়টি মাথায় রেখেই নির্বাচনী ইশতেহার সাজাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো; তাদের প্রতিশ্রুতির তালিকায় থাকছে তরুণ ভোটারদের তুষ্ট করার নানা উপকরণ।

ছবিসহ ভোটার তালিকা হওয়ার পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনে ভোটার ছিল ৮ কোটি ১০ লাখের বেশি। নিবন্ধিত ৩৯টি দলের মধ্যে ৩৮টিই সেবার ভোটে ছিল।

বিএনপি ও সমমনাদের ভোট বর্জনের মধ্যে মাত্র ১২টি দল দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। তাতে ১৫৩ আসনে একক প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন; বাকি ১৪৭ আসনে ভোট হয়।

পাঁচ বছরের মাথায় আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত ৩৯ দলের সবগুলোই থাকছে। আর এবারের ১০ কোটি ৪২ লাখ ভোটারের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই বয়সে তরুণ যুবা।

৩০ ডিসেম্বরের ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী রয়েছেন ১৮৪৮ জন

৩০০ আসনের কোথাও একক প্রার্থী নেই

৩৯টি দলের প্রার্থী রয়েছেন ১৭৪৯ জন; ৯৯ জন হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী

নবম সংসদ নির্বাচনের পর যারা ভোটার হয়েছেন তাদের ‘তরুণ ভোটার’ হিসাবেই বিবেচনা করতে চান নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক আব্দুল আলীম।

তিনি বলেন, “এ তরুণ ভোটাররা শিক্ষা ও প্রগতিশীলতার চিন্তা ধারণ করে। অনেক চিন্তাভাবনা করেই ভোটকেন্দ্রে যাবেন তারা। বলা যায়, আগামী সংসদ নির্বাচনে এ তরুণ ভোটাররা একটা বড় নিয়ামক হবেন।”

২০০৮ সালের পর যারা ভোটার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন, তাদের বয়স এখন ১৮ থেকে ২৮ বছর। তাদের পক্ষে টানতে প্রতিশ্রুতির ডালি সাজাচ্ছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো।

আওয়ামী লীগ

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরুণ ও নারী ভোটাররা আওয়ামী লীগের বিজয়ে প্রধান ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

মঙ্গলবার সকাল ১০টায় রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ ইশতেহার ঘোষণা করবে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের স্লোগান ছিল ‘দিনবদলের সনদ’। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে ছিল ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’।

এবারের ইশতেহারে দেশকে এগিয়ে নিতে তরুণ প্রজন্মকে কাজে লাগানোর নানা পরিকল্পনার কথা থাকছে বলে ইশতেহার প্রণয়ন উপ কমিটির সমন্বয়ক, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, “আগামী দি‌নের তরুণ সমাজ‌দের নি‌য়ে আমরা কী ভাব‌ছি, এই  তরুণ সমাজ‌কে উন্নয়‌নের সঙ্গে, দেশ প‌রিচালনার সঙ্গে কীভা‌বে সম্পৃক্ত করা যায়, তা জনগ‌ণের সাম‌নে তু‌লে ধরা হবে।”

ঐক্যফ্রন্ট

ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা কামাল হোসেনের উপস্থিতিতে সোমবার ঢাকার হোটেল পূর্বাণীতে ৩৫ দফা প্রতিশ্রুতি রেখে জোটের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করা হয়।

তাতে বলা হয়- পুলিশ ও সামরিক বাহিনী ছাড়া সরকারি চাকরিতে বয়সের কোনো সময়সীমা রাখবে না ঐক্যফ্রন্ট। অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী ছাড়া সরকারি চাকরিতে আর কারও জন্য কোটা থাকবে না।

৩০ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষিত বেকারদের জন্য ভাতা চালু করতে একটি কমিশন গঠন করা হবে ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় গেলে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পর বিএনপিও আলাদাভাবে ইশতেহার দেবে। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকার গুলশানের লেইক শোর হোটেলে এ ইশতেহার প্রকাশ করা হবে।

জাতীয় পার্টি

তরুণ ভোটারদের দিকে মনোযোগ কাড়তে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবার দলকে ডিজিটাল প্রচার মাধ্যমে এনেছেন।

এরশাদের বিশেষ সহকারী এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার শুক্রবার ইশতেহার ঘোষণার সময় বলেন, “নতুন প্রজন্মের জন্য আগামী অর্ধ শতাব্দী সময়কে সামনে রেখে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জাতীয় পার্টি নতুনভাবে এই ১৮ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।”

সিপিবি

‘ভিশন মুক্তিযুদ্ধ-৭১’ শিরোনামে সিপিবি ইশতেহারে নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলো ৩০টি দফা ও ১৫১টি উপ-দফায় বর্ণনা করা হয়েছে।

সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ইশতেহার ঘোষণায় বলেন, “আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তাদের অক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। এমনকি এই দুটি দলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা দ্বি-দলীয় রাজনৈতিক কাঠামো দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বরং যারাই ক্ষমতায় এসেছে, তারা ক্রমান্বয়ে আরও কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছে।”

বিকল্প অর্থনৈতিক নীতি ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য হ্রাস করা, ঘুষ-দুর্নীতি-লুটেপাটের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করা হবে এ বাম দলের লক্ষ্য।

তরুণ ভোটারদের প্রত্যাশা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী তানজিমুল ইসলাম বলেন, “আমাদের বড় ভাইদের অনেকেই পড়ালেখা শেষ করে বসে আছেন। তারা চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আমি চাই না পড়ালেখা শেষে একদিনও বসে থাকতে। নতুন করে যারা ক্ষমতায় আসবেন তাদের কাছে এক নম্বর দাবি থাকবে কর্মসংস্থানের পরিধি বাড়ানোর। এ জন্য নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে হবে।”

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শক্ত অবস্থান’ নিতে নতুন সরকারের কাছে কঠোর আইন চান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে আরফাতুর রহমান পাপ্পু।

তিনি বলেন, “আমার দাবি হল- যে ব্যক্তি দুর্নীতি করবেন তার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রের কোষাগারে নিতে হবে। একই সাথে দুর্নীতির সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন করতে হবে।”

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি সরকারি কলেজ থেকে পাস করা ঝুমা রাণী দাশের চাওয়া, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করতে হবে।

“সবাই যোগ্যতা নিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করবে, এতে বয়সের কারণে যদি কেউ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে না পারে তাহলে সেটা দুঃখজনক। আমরা অনেকেই এবার চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিলাম, কিন্তু সাড়া পাইনি। এবার নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো এই বিষয়টি বিবেচনা করে তাদের ইশতেহারে রাখবে বলে আশা করি।”

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শৈবাল চন্দ্র বণিক বলেন, “যারা নতুন করে ক্ষমতায় আসবে তাদের মনে রাখতে হবে প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে, কিন্তু এর সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেও সাজানো উচিত। প্রযুক্তিতে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার মত ব্যবস্থা তাদের নিতে হবে।”

মিরপুরে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে ১০টি সেলাই মেশিন বসিয়েছেন তরুণ উদ্যোক্তা মুহতাসিম আল মামুন। সেখানে নারীদের পোশাক তৈরি করে দোকানে দোকানে বিক্রি করেন তিনি।

মামুন বলেন, “সবাই চাকরির পেছনে দৌড়ায়। আমার স্কুল জীবন থেকেই স্বপ্ন ছিল ব্যবসায়ী হব। তবে এখানে টিকে থাকা কঠিন, অনেক পরিশ্রম দরকার। আমার প্রত্যাশা থাকবে, নতুন যারা সরকারে আসবেন, তারা নতুন ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দিতে প্রণোদনার ব্যবস্থা করবেন। এতে কর্মসংস্থান বাড়বে।”