রাষ্ট্রের মালিকানা ‘ফিরিয়ে দেওয়ার’ প্রতিশ্রুতি ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গেলে ‘রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার’ প্রতিশ্রুতি এসেছে ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Dec 2018, 06:40 AM
Updated : 17 Dec 2018, 06:40 AM

বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে দুই মাস আগে গঠিত এই জোট বলছে, ২০১৪ সালে ‘নির্বাচনের নামে প্রহসনের’ মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণ হারিয়েছিল। সেই মালিকানা তারা ৩০ ডিসেম্বর ভোটে জিতে আবার ‘সকল জনগণের’ হাতে ফিরিয়ে দিতে চায়, যার মধ্যে পরাজিতরাও থাকবে।    

ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা কামাল হোসেনের উপস্থিতিতে সোমবার ঢাকার হোটেল পূর্বাণীতে ৩৫ দফা প্রতিশ্রুতি রেখে এই নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করা হয়।

সংবাদ সমম্মেলনে গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেনের ডান দিকে ছিলেন বিএনপির মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বাঁ দিকে ছিলেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না।

কামাল হোসেনের প্রারম্ভিক বক্তৃতার পর মান্না ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার পড়ে শোনান।

কামাল হোসেন তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, “২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে এই প্রহসনটি হয়েছিল, সেটি সংবিধান বর্ণিত জনগণের প্রত্যেকের ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই নির্বাচনের মাধমে জনগণ এই রাষ্ট্রের মালিকানা হারিয়েছিল।”

গত দশ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে দলটির সাবেক নেতা কামাল বলেন, “জনগণ যখন মালিক থাকে না, তখন রাষ্ট্রের মালিক হয়ে পড়ে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী, দেশি বিদেশি নানা গোষ্ঠী। এর মাশুল দিতে হয়েছে এই দেশের মানুষকে। এটা আপনারাও হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছেন।”

জোটের ইশতেহার থেকে পড়ে শুনিয়ে মান্না বলেন, “নির্বাচনে জিতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের কল্যাণে সরকার পরিচালণা করবে। এই পরিচালনার মূলনীতি হবে ঐক্যমত্য, সকলের অন্তর্ভুক্তি এবং যে কোনো রকম প্রতিহিংসা থেকে মুক্ত থাকা।”

মান্না বলেন, “‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বর্ণিত এই নীতির ভিত্তিতে সরকার পরিচালণায় যাবতীয় পদক্ষেপের ভিত্তি হবে রাষ্ট্রের মালিকগণের মালিকানা সুদৃঢ় করা।”

ঐক্যফ্রন্ট প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, রাষ্ট্রের এই মালিকানা কেবল নির্বাচনে জেতা মানুষের হবে না, এই মালিকানা থাকবে পরাজিত দলের নেতা কর্মী সমর্থকদেরও। রাষ্ট্র পরিচালিত হবে নির্বাচনে পরাজিতদের ‘মতামত ও মালিকানা’ নিশ্চিত করে।

ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে ঐক্যফ্রন্টের ৩৫ দফার ইশতেহারে।

কেউ যাতে দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে না পারে, ‘একদলীয় শাসন; যাতে ফিরে না আসে, সেই ব্যবস্থা ঐক্যফ্রন্ট করবে।

তবে বর্তমান কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করা হবে না এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম চলমান থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি এসেছে তাদের ইশতেহারে।

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, দুর্নীতি দমন ও সুশাসন, কর্মসংস্থান ও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনমানের উন্নয়ন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, প্রবাসী কল্যাণ, পররাষ্ট্র নীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঐক্যফ্রন্ট কী কী করতে চায়- সেসব বিষয়েও বিভিন্ন অঙ্গীকারের কথা এসেছে সেখানে।

কামাল হেসেন বলেন, “এটা জনগণের ইশতেহার। জনগণের কল্যাণ, জনমতের ভিত্তিতে এটা তৈরি করা হয়েছে এবং সাধারণ মানুষের মতামত গ্রহণের ধারা অব্যাহত থাকবে। আমরা ভোটের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে দেশে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাস করি।”

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পাঁচ দলের মনোনীত প্রার্থীরা আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন বিএনপির ‘ধানের শীষ’ প্রতীক নিয়ে।

তিনশ আসনের মধ্যে ২৪২টি আসন বিএনপি নিজেদের জন্য রেখে জাতীয় যুক্তফ্রন্টের শরিকদের ১৯টি আসন ছেড়ে দিয়েছে। এর মধ্যে গণফোরাম সাতটি, জেএসডি চারটি, নাগরিক ঐক্য চারটি ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ চারটি আসন পেয়েছে। বাকি ৩৯টি আসন জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটকে দিয়েছে বিএনপি।

৩৫ দফায় যা আছে

# ‘সত্যানুসন্ধান ও বিভেদ নিরসন’ কমিশন: ‘মিথ্যা’ মামলা, গুম, খুন, ঘুষ বাণিজ্য ও বিচারবর্হিভূত হত্যার সমাধানে ‘সর্বদলীয় সত্যানুসন্ধান ও বিভেদ নিরসন কমিশন’ গঠন করা হবে। ‘খোলা মনে’ আলোচনা করে ক্ষমা ও ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে সেখানে ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের’ অতীতের হয়রানিমূলক মামলার সুরাহা করা হবে।

নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা: বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম বন্ধ করবে ঐক্যফ্রন্ট। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করবে। রিমান্ডের নামে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন, সাদা পোশাকে গ্রেপ্তার বন্ধ করবে, ‘মিথ্যা’ মামলায় অভিযুক্তদের ক্ষতিপূরণ দেবে। মিথ্যা মামলায় ‘সহায়তাকারী’ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে জিরো টোলারেন্স দেখাবে, যৌতুক পুরোপুরি বন্ধ করবে।

সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়: ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় গেলে সংখ্যালঘু এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানবিক মর্যাদা, অধিকার, নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করবে। তাদের ওপর যে কোনো হামলার বিচার হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে।

যুদ্ধাপরাধের বিচার : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখবে ঐক্যফ্রন্ট।

ক্ষমতার ভারসাম্য: সংসদে একটি উচ্চ কক্ষ সৃষ্টি করা হবে। সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে (ফ্লোর ক্রসিং) পরিবর্তন আনবে ঐক্যফ্রন্ট।

প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য: প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ‘ভারসাম্য’ আনার প্রতিশ্রুতি রয়েছে ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে। পর পর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকার সুযোগ তারা বন্ধ করবে। সংসদের ডেপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত করার সুযোগ তৈরি করবে।

প্রাদেশিক সরকার :  প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা পরীক্ষার জন্য একটি সর্বদলীয় জাতীয় কমিশন গঠন করা হবে।

# বিচারপতি নিয়োগ কমিশন: বিচারপতিসহ সব নিয়োগের ক্ষেত্রে বিরোধী দলীয় সাংসদ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে স্বাধীন কমিশন গঠন করবে ঐক্যফ্রন্ট। সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে ‘উল্লেখযোগ্য’ সংখ্যক নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে।

সংসদে প্রত্যক্ষ ভোটে নারী: সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করতে চায় ঐক্যফ্রন্ট। তার বদলে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম বিশ শতাংশ নারীকে মনোনয়ন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা দেওয়া হবে।

দুর্নীতির তদন্ত: বর্তমান সরকারের সময়ে দুর্নীতির তদন্ত করে বিচারের আওতায় আনা হবে। ন্যায়পাল নিয়োগ করা হবে এবং সংবিধান নির্দেশিত সব দায়িত্ব পালনে ন্যায়পালকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হবে।

# আর্থিক খাতে দুর্নীতির তদন্ত: আর্থিক খাতে ‘লুটপাটে’ জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে ঐক্যফ্রন্ট। ব্যাংকগুলোকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ‘সর্বময় ক্ষমতা’ দেবে তারা।

সরকারি চাকরির বয়সসীমা: পুলিশ ও সামরিক বাহিনী ছাড়া সরকারি চাকরিতে বয়সের কোনো সময়সীমা রাখবে না ঐক্যফ্রন্ট। অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী ছাড়া সরকারি চাকুরিতে আর কারও জন্য কোটা থাকবে না।

বেকার ভাতা চালু: ৩০ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষিত বেকারদের জন্য ভাতা চালু করতে একটি কমিশন গঠন করা হবে ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় গেলে।

ইশতেহার প্রকাশ অনুষ্ঠানের মূলমঞ্চে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জেএসডির আসম আবদুর রব, শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, মোস্তফা মহসিন মন্টু, রেজা কিবরিয়া, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন।

এছাড়া বিএনপিপন্থি পেশাজীবী নেতা অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, অধ্যাপক মোস্তাহিদুর রহমান, মোস্তফা জামান আব্বাসী, অধ্যাপক সদরুল আমিন, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ, আবদুল হাই শিকদার উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।

বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মিয়া, আবদুল আউয়াল মিনটু, অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, অধ্যাপক সাহিদা রফিক, অধ্যাপক তাজমেরী এ ইসলাম, অধ্যাপক সুকোমাল বড়ুয়া, রুহুল আলম চৌধুরী, শাহজাদা মিয়া, এনামুল হক চৌধুরী, গণফোরামের জগলুল হায়দার আফ্রিক, আওম শফিক উল্লাহ, নাগরিক ঐক্যের শহীদুল্লাহ কায়সার, জাহেদ উর রহমান, গনদলের গোলাম মওলা চৌধুরীও ছিলেন।