ইশতেহার: জাতীয় পার্টির ১৮ দফায় ‘সৌভাগ্যের’ প্রতিশ্রুতি

সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দল জাতীয় পার্টি ‘গণতন্ত্রের বিকাশ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার’ লক্ষ্যে ১৮ দফা অঙ্গীকার নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Dec 2018, 10:34 AM
Updated : 14 Dec 2018, 10:34 AM

এরশাদের বিশেষ সহকারী এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার শুক্রবার বনানীতে দলের কার্যালয়ে এই ইশতেহার ঘোষণা করেন। ‘অসুস্থতার কারণে’ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ এখন বিদেশে।

দশম সংসদে; একইসঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকা জাতীয় পার্টির ইশতেহারে বলা হয়েছে, আগামীতে ক্ষমতায় গেলে দেশের প্রশাসনিক, সরকার পরিচালনা ও নির্বাচনের পদ্ধতি বদলে দেবে তারা। 

এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন করে প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তন, দুই স্তর বিশিষ্ট সরকার কাঠামো এবং নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের মাধ্যমে জাতীয় পার্টি তাদের ভাষায় ‘গণতন্ত্রের বিকাশ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার’ এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়। 

ইশতেহারে পূর্ণাঙ্গ উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, শিক্ষা পদ্ধতির সংস্কার, স্বাস্থ্য সেবা সম্প্রসারণ, সন্ত্রাস দমনে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি এসেছে।

এর আগে গত ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মিলিত জাতীয় জোটের মহাসমাবেশে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এই ১৮ দফার কথা জানিয়েছিলেন। প্রায় তিন মাস পর সেই ইশতেহার লিখিত আকারে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করল জাতীয় পার্টি।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টি ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেগুলোর বিস্তৃত বর্ণনা ছাড়া বড় কোনো পরিবর্তন এবারের ইশতেহারে নেই।

 

তবে ইশতেহার ঘোষণার সময় হাওলাদার দাবি করেন, “নতুন প্রজন্মের জন্য আগামী অর্ধ শতাব্দী সময়কে সামনে রেখে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জাতীয় পার্টি নতুনভাবে এই ১৮ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।”

জাতীয় পার্টি যখন নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করল, দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তখন সিঙ্গাপুরে। জাতীয় পার্টি জানিয়েছে, রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ায় ‘অসুস্থ’ এরশাদ সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

দলের নব নির্বাচিত মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, সিনিয়র কো চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ ও কো চেয়ারম্যান জি এম কাদেরও ইশতেহার ঘোষণার দিনে ঢাকায় নেই। তারা সবাই নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় ‘জনসংযোগে’ ব্যস্ত বলে জানান হাওলাদার।

ঋণখেলাপি হওয়ায় পটুয়াখালী-১ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হাওয়ালাদারের এবার নির্বাচন করা হচ্ছে না। মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠায় সম্প্রতি তাকে মহাসচিবের পদ থেকে সরিয়ে নিজের বিশেষ সহকারী করে নিয়েছেন এরশাদ। চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে দল চালানোর সাংগঠনিক ক্ষমতাও হাওলাদারকে দেওয়া হয়েছে।

পার্টির নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করতে এসে হাওলাদার বলেন, “চেয়ারম্যান মহোদয়ের সঙ্গে আজকে (শুক্রবার) সকালে আমার কথা হয়েছে। তার নির্দেশেই আমি ইশতেহার ঘোষণা করছি।”

তিনি বলেন, আগামী দিনের সরকার পরিচালনায় জাতীয় পার্টির প্রথম অঙ্গীকার হচ্ছে- দেশে সকল ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, সুষ্ঠু গণতন্ত্রের বিকাশ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা।

“গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে হলে গণতন্ত্রের মাধ্যমে দেশের মানুষের কল্যাণ সাধন করতে হবে। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে এবার জাতীয় পার্টি ১৮টি অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।”

এই ১৮ দফার অঙ্গীকারকে এদেশের ‘সৌভাগ্যের প্রতীক’ হিসেবে উল্লেখ করে হাওলাদার বলেন, “জাতীয় পার্টির উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মূল ভিত্তি ছিল, ১৮ দফা কর্মসূচির বাস্তবায়ন “

২০ সেপ্টেম্বর মহাসমাবেশে ১৮ দফার কথা জানাতে গিয়ে এরশাদ বলেছিলেন, “এটা হল মুক্তির পথ, দেশের মুক্তির পথ, জাতির মুক্তির পথ।”

 

যা আছে ইশতেহারে

# ক্ষমতায় গেলে জাতীয় পার্টি দেশে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করবে। আট বিভাগকে ৮টি প্রদেশে উন্নীত করা হবে। নাম হবে – উত্তরবঙ্গ প্রদেশ, বরেণ্য প্রদেশ, জাহাঙ্গীরনগর প্রদেশ, জাহানাবাদ প্রদেশ, জালালাবাদ প্রদেশ, চন্দ্রদ্বীপ প্রদেশ, ময়নামতি প্রদেশ, চট্টলা প্রদেশ।

# সরকার কাঠামো হবে দুই স্তরবিশিষ্ট। কেন্দ্রীয় সরকারকে বলা হবে ফেডারেল সরকার। থাকবে ৩০০ আসনের জাতীয় সংসদ। আর প্রদেশ চালাবে প্রাদেশিক সরকার। থাকবে প্রাদেশিক সাংসদ। প্রতিটি উপজেলা কিংবা থানাকে প্রাদেশিক সরকারের আসন হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

# প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে ঢাকা থেকে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ সদর দপ্তর প্রাদেশিক রাজধানীতে স্থানান্তর করবে জাতীয় পার্টি।

# ইশতেহারে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় গেলে নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার করবে জাতীয় পার্টি। বর্তমান ব্যবস্থার বদলে ভোটের সংখ্যানুপাতিক হারে জয় পরাজয় নির্ধারণের ব্যবস্থা করা হবে। নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হবে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’।

# উপজেলা আদালত ও পারিবারিক আদালতসত পূর্ণাঙ্গ উপজেলা ব্যবস্থা চালু করে স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালী করতে চায় জাতীয় পার্টি। উপজেলার ক্ষমতা উপজেলা চেয়ারম্যানদের কাছে হস্তান্তর করবে তারা।

# জাতীয় পার্টি ‘এক বছরের মধ্যে’বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তাদের ইশতেহারে। পাঁচ বছরের মধ্যে তারা মামলা জট শূন্যের কোটায় নিয়ে আসবে। রাজনৈতিক মামলা দায়ের করার প্রবণতা বন্ধ করবে। প্রতিশ্রুত প্রতিটি প্রাদেশিক রাজধানীতে খোলা হবে হাই কোর্ট বেঞ্চ।

# শিক্ষা পদ্ধতিরও সংস্কার করতে চায় এরশাদের দল। তারা ক্ষমতায় গেলে পঞ্চম ও অষ্টমের দুই সমাপনী পরীক্ষা বাদ দেওয়া হবে। টিউউশন নির্ভরতা কমিয়ে বন্ধ করবে কোচিং ব্যবসা। স্নাতক শ্রেণি পর্যন্ত নারী শিক্ষা অবৈতনিক করবে।

১৮ দফা ইশতেহারে বলা হয়েছে, জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় গেলে ধর্মীয় মূল্যবোধকে ‘সবার উর্ধ্বে’ স্থান দেবে। আবার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য জাতীয় সংসদে ৩০টি আসন সংরক্ষণ করা হবে।

সহজ শর্তে কৃষি ঋণ, চরাঞ্চলের কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য স্থিতিশীল রাখা, ইউনিয়নভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা খাতের বিস্তৃতি ঘটানো এবং পল্লী রেশনিং ব্যবস্থা চালুর অঙ্গীকারও রয়েছে এর মধ্যে।

প্রতিটি উপজেলায় কৃষিভিত্তিক শিল্পনগরী গড়ে তোলার পাশাপাশি অনগ্রসর অঞ্চলে শিল্প স্থাপনে জাতীয় পার্টি ‘অগ্রাধিকার’ দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে ১৮ দফায়। বলা হয়েছে গুচ্ছগ্রাম ও পথকলি ট্রাস্ট পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা।

জাতীয় পার্টি বলেছে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ‘তিন মাসের মধ্যে’ সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি সমূলে নির্মূল করবে তারা।