৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ও প্রাণহানিকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ মনে করা ঠিক হবে না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক সমন্বয় সভার উদ্বোধনী পর্বে সিইসি নূরুল হুদার এ মন্তব্য আসে।
তিনি বলেন, “২০১৪ সালের নির্বাচনের অবস্থা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। ২০১৪ সালে একটা ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সে অবস্থার আলোকে আমাদের এ বছরের নির্বাচনের প্রস্তুতির রূপরেখা অবলম্বন করা প্রয়োজন।”
নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোটের দাবিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ও তার শরিকরা। ভোটের দিন শতাধিক কেন্দ্রে আগুন দেওয়া হয়, সংঘাত-সহিংসতায় সেদিন প্রাণ যায় ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাসহ অন্তত ১২ জনের।
পরের বছর নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে বিএনপি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ এবং আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ পালনের ঘোষণা দিয়ে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিলে তৈরি হয় উত্তেজনা। পুলিশ ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সমাবেশের পথ বন্ধ করে দিলে বিএনপিনেত্রী খালেদা জিয়া টানা অবরোধের ঘোষণা দেন।
এরপর তিনমাসে নজিরবিহীন সহিংসতা ও নাশকতায় দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়, যার পেছনে বিএনপিকেই দায়ী করে আসছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
২০১৪ সালের সেই নির্বাচনের দিন সব বাহিনীই মাঠে ছিল মন্তব্য করে সিইসি বলেন, “সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ছিল-তবুও আমরা দেখেছি পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছে, প্রিজাইডিং অফিসার নিহত হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেট নিহত হয়েছে, শত শত মানুষ নিহত হয়েছে, শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভস্মীভূত হয়েছে।
“সেটা কী প্রেক্ষিতে হয়েছিল, সেটা আমরা কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি, সে প্রসঙ্গ আলোচনা করার প্রয়োজন আমি মনে করি না। সেটা আমাদের মনে রাখতে হবে, ভুলে গেলে চলবে না। সে অবস্থা থেকে কীভাবে উত্তরণ করা যায়, সে অবস্থার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সেই পরিবেশ পরিস্থিতির সৃষ্টি যাতে না হয়, সেদিকে সতর্কতার সাথে দৃষ্টি রাখতে হবে।”
নূরুল হুদা বলেন, জনগণের জীবন ও মালামাল রক্ষা, দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি শান্ত রাখার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমি প্রত্যাশা করব, পেশাদারী ও নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা ও মানসিকতা নিয়ে এবারের নির্বাচন মোকাবেলা করতে পারবেন আপনারা। এবার যেন সেবারের মত তাণ্ডব না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন।”
এবার তফসিল ঘোষণার পর পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও প্রতীক বরাদ্দের পরদিন থেকে সহিংসতার খবর আসার প্রসঙ্গ টেনে সিইসি বলেন, “আমরা কিন্তু আশংকাগুলো একেবারে অবহেলা করতে পারি না। প্রতীক বরাদ্দের পরদিনই যে ঘটনা, তা যত তুচ্ছই হোক না কেন- দুটো জীবনের মূল্য অনেক…। এখানে ওখানে ভাঙচুর, প্রতিহত করা- এগুলোর পেছনে কী শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণ, নাকি ২০১৪ সালের মত ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে- সেদিকে নজর দিতে হবে।”
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সতর্ক নজরদারির তাগিদ দিয়ে নূরুল হুদা বলেন, “একটা ঘটনা হালকাভাবে দেখলে চলবে না। একের ওপর অপরের দোষ চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতির খোলস থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সতর্ক অবস্থান নেওয়ার প্রয়োজন হবে। এর পেছনে নিভৃত শক্তির ষড়যন্ত্র আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে।”
নির্বাচন নিয়ে যখন ‘স্বতঃফূর্ত গণজাগরণের’ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক তখন খুনের ঘটনা, হামলার ঘটনাগুলোকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে মনে করার কোনো কারণ নেই বলে মত দেন সিইসি।
তিনি বলেন, এদেশে স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টার বিরুদ্ধে ‘প্রভাবশালী মহল’ সক্রিয় থাকতে পারে।
নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি দিয়ে সিইসি বলেন, ভোটারদের সিদ্ধান্ত ‘মাস্তানদের হাতে’ ছেড়ে না দিতেই ইসির এ উদ্যোগ।
“বাক্স ছিনতাইকারীর হাত থেকে ভোটারদের মুক্তি দিতে হবে। তার প্রধান ও প্রথম উপায় হল যে পদ্ধতিতে ভোট চলছে, তার পরিবর্তে আরেকটি পদ্ধতি আনতে হবে। নির্বাচন কমিশন বিশ্বাস করে, ইভিএম হতে পরে বিকল্প পদ্ধতি, যার মাধ্যমে ভোটারদের নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব হবে।”
ইভিএম সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে ৮০ শতাংশ অনিয়ম দূর করা সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন নূরুল হুদা।
“সমগ্র নির্বাচন ইভিএমের অধীনে নিয়ে আসার লক্ষ্য নিয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। এটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কারণ বর্তমান পদ্ধতিতে নির্বাচনের অনিয়ম দূর করতে এটাই একমাত্র নির্ভরযোগ্য মাধ্যম বলে আমি মনে করি।”
দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ‘পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতার সর্বোচ্চ প্রয়োগের’ আহবান জানান সিইসি।
তিনি বলেন, “স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে সব বাহিনীর কৌশল অবলম্বন করতে হবে। সব গোয়েন্দা সংস্থার সতর্ক নজরদারি বাড়াতে হবে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিজিবিকে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিশ্চয়তা দিতে হবে, তাদের দিকে নজর রাখতে হবে। নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি আলাদাভাবে দেখতে হবে যেন তারা ভোট দিয়ে নিরাপদে বাসায় ফিরতে পারে।”
প্রত্যেক এলাকার ‘মাস্তান ও গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের’ তালিকা তৈরি করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
নির্বাচন পরিচালনার সিংহভাগ দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ভোটের ভাগ্য সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, প্রয়োজনে আটক করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ২০১৪ সালের অবস্থা মাথায় রেখে নিরাপত্তার ছক তৈরি করতে হবে।”
তবে বিনা কারণে যাতে কাউকে গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা না হয়- সে বিষয়েও সতর্ক করেন সিইসি।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল প্রস্তুতির ৯৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা ছাড়াও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, শাহাদাত হোসেন চৌধুরী, কবিতা খানম, ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ এ সভায় উপস্থিত ছিলেন।