২০০১-এর নির্বাচনের ফল আগেই ঠিক করা ছিল: হাসিনা

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের কাছে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের জন্য বিদেশিদের হাত ছিল মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেছেন, ওই নির্বাচনের ফল আগেই ঠিক ছিল, যার দালিলিক প্রমাণ তিনি পেয়েছেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Dec 2018, 05:35 PM
Updated : 7 Dec 2018, 05:41 PM

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। পাঁচ বছর পরের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের কাছে হেরে যায় তারা।

শুরু থেকে ওই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করে আসা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পরে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে একটি ‘ডকুমেন্ট’ উদ্ধার করেন, যাতে কোন কোন আসন আওয়ামী লীগ দেওয়া হবে আর কোনটা দেওয়া হবে না তা আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছিল লাল, সবুজ কালিতে চিহ্নিত করে।

প্রয়াত প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান নেতৃত্বাধীন তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৬২ আসন, অপরদিকে দুই শতাধিক আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট।

ওই নির্বাচনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করে ভোটের আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের বাংলাদেশ সফরে একটি ঘটনা এর আগেও বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করেছিলেন শেখ হাসিনা।

তার ভাষ্যমতে, জিমি কার্টারের সম্মানে তখনকার প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমান মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করেন। সেখানে তার এবং খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে গ্যাস বিক্রির বিষয়টি আলোচনায় এলে তিনি ‘না’ বলে দেন। তিনি ওই অনুষ্ঠান থেকে চলে গেলেও বিএনপি নেতারা সেখানে ছিলেন।

এরপর ‘গ্যাস বিক্রির মুচলেকা’ দিয়ে বিএনপির ক্ষমতা লাভের অভিযোগ করে আসা শেখ হাসিনা শুক্রবার বলেন, “যাই হোক আসতে পারলাম না। একটা ষড়যন্ত্রের শিকার। আপনারা জানেন, আমাদের গ্যাস বিক্রি করতে হবে। সেই গ্যাস বিক্রি করবে আমেরিকা, কিনবে ভারত। আমি বললাম, আমার এতো গ্যাস নাই, আমি দিতে পারব না।

“স্বাভাবিকভাবে দুটো দেশই একটু বিগড়ে গেল। আর নির্বাচনটাও হল সেভাবেই। একেবারে হাতে তুলে আমাদের হারানো হল। আমরা ভোটে হারিনি। ভোট কিন্তু আমরা বেশি পেয়েছিলাম এত বাধার পরেও। কিন্তু গোনা সিটে আমরা হেরে গেলাম। সেখানে আমাদের কম দেওয়া হল।”

এ বিষয়ে দালিলিক প্রমাণ পাওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “পরবর্তীতে আমি প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে একটা ডকুমেন্ট বের করেছিলাম। যেখানে তখনই মার্ক করা ছিল যে, কোন কোন সিট আমাদের দেওয়া হবে আর কোনটা দেওয়া হবে না।

“কোনোটা লাল কালি দেওয়া, কোনোটা হলুদ কালি দেওয়া, কোনোটা সবুজ দেওয়া, কোনোটা নীল দেওয়া। এইভাবে কিন্তু একেবারে তৈরি করা। সেটা থেকেই বোঝা যায়, নির্বাচনটা তখন কেমন হয়েছিল।”

ওই রকম ‘কারচুপির’ নয়, তারা ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচন করতে চান বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “জনগণের জন্য কাজ করেছি। জনগণ যদি খুশি হয়ে ভোট দেয় আছি ক্ষমতায় না দিলে নাই। কিন্তু দেশের ভাগ্যটা পরিবর্তন করা- এটাই আমাদের লক্ষ্য।”

প্রশাসনের সাবেক তিন শতাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি সমর্থনের কথা জানাতে বিকালে গণভবনে এলে বক্তব্যে এসব বলেন তিনি।

সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জনগণের কাছে তুলে ধরতে সাবেক কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী, অগ্নিসন্ত্রাসীরা ক্ষমতায় এলে দেশের সব কিছু ‘ধ্বংস করে দেবে’।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। আমরা চাই না ওই খুনীর দল, যুদ্ধাপরাধীর দল আর স্বাধীনতাবিরোধী, অগ্নিসন্ত্রাস যারা করে তারা আর এই দেশে ক্ষমতায় আসুক।

“কেউই চাই না। কারণ দেশটাকে তারা ধ্বংস করে দেবে। আমরা ধ্বংস চাই না। আমরা অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যেতে চাই।”

শেখ হাসিনা বলেন, “আর সেই বিভীষিকাময় অবস্থায় দেশ যাক সেটা আমরা চাই না। অগ্নিসন্ত্রাস, বাংলাভাই, জঙ্গিবাদ এগুলো সৃষ্টি হোক, অর্থপাচার, দুর্নীতি, মাদক, অস্ত্র, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড-এটা আর বাংলাদেশের মানুষ চায় না।”

২০০৮ সালের নির্বাচনে দিনবদলের সনদ ঘোষণার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আজকে অন্তত এটা দাবি করতে পারি, দিনবদলের সনদ কার্যকর হয়ে প্রকৃতপক্ষে মানুষের জীবন বদলে গেছে। এখন মানুষ কিন্তু অনেক উন্নত-সুন্দর জীবন পাচ্ছে। কিন্তু আরো উন্নতি আমাদের করতে হবে।

“দারিদ্র্যের হার ২১ শতাংশে নামিয়েছি। যতক্ষণ পর্যন্ত আরো অন্তত ৫ শতাংশ না নামাব ততক্ষণ পর্যন্ত কাজ করতে হবে। ঠিক সেভাবে দেশের উন্নয়নের যে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি; যেমন পদ্মা সেতু। সব থেকে চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু সেগুলোতো বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে আবার হয়ত সব ধ্বংস হয়ে যাবে। খাদ্য উৎপাদনে যে অবস্থান তৈরি করেছি, না হলে সে জায়গাগুলো আবারও ধ্বংস হয়ে যাবে।” 

আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসতে না পারলে চলমান এসব কাজ শেষ হবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা।

“করবে না। করবে না এই কারণেই যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, যারা বাংলাদেশ এগিয়ে যাক চায় না, বাংলাদেশের মানুষ ভালো থাক সেটা চায় না- তারা করবে কেন?”

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এলে দেশের বিভিন্ন উন্নয়নের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “২০০১ সাল পর্যন্ত আমরা দেশের বিভিন্ন খাতের অনেক উন্নতি করেছিলাম। আমাদের সব সময় একটাই লক্ষ্য, দেশের উন্নয়ন করা। আমরা ভিক্ষুকের জাতি হয়ে থাকতে চাই না। মুক্তিযুদ্ধ করেছি, সব সময় মাথা উঁচু করে চলব।”

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারি কর্মকর্তারা কীভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন, তা তুলে ধরেন সাবেক কর্মকর্তারা। আবারও আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে জয়ী করতে মাঠে নামার অঙ্গীকার করেন তারা।

২০১৪ সালে নির্বাচন ঠেকানোর নামে বিএনপির আন্দোলনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “আমি জানি না, কখনো কেউ এ ধরনের কাজ করতে পারে যে, জীবন্ত মানুষকে কেউ পুড়িয়ে হত্যা করে। এর থেকে জঘন্য কাজ আর পৃথিবীতে কিছু হয় না। এটাই নাকি তাদের আন্দোলন ছিল।

“আজকে দেশের মানুষ কিন্তু বুঝতে পারে। দেশের মানুষ জানে সেটা। তারপরেও যত কাজই করি না কেন,  শুধু কাজ করলেই যে দেশের মানুষ ভোট দেবে তা কিন্তু না। মানুষকে কিন্তু স্মরণ করিয়ে দিতে হয়। মানুষকে বলতে হয়, এই সরকার আপনাদের জন্য এই করেছে। আগামীতে এই করবে। সেটা স্মরণ করিয়ে দিতে হয়।”

সবার প্রতি জনগণের কাছে এসব বক্তব্য নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

অনুষ্ঠানের শুরুতে সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা তার নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করতে এসেছি।”

শেখ হাসিনার টানা দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে বাংলাদেশে উন্নয়নের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরেন তিনি।

বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলের কথা উল্লেখ করে কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, “আমরা অন্ধকার সময়ে ফিরে যেতে চাই না। আপনার নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করছি। আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ পরিণত হবে সমৃদ্ধশীল বাংলাদেশে।”

কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, বিএম মোজাম্মেল প্রমুখ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হবে। টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ আবার ভোটে জিততে আশাবাদী।

এই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর গত ২৭ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নৌকার পক্ষে মাঠে নামার অঙ্গীকার করেন।