মানবসম্পদের সঠিক ব্যবহারে সুদিন আসবে

এ কে এম নুরন্নবীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Oct 2016, 06:34 AM
Updated : 24 Oct 2016, 06:34 AM

আমাদের দেশে জনসংখ্যা পরিকল্পনায় যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে সেই অগ্রগতির কারণে বিশ্বে আমরা অন্যতম একটি ‘লো ফার্টিলিটি’-এর দেশে পরিণত হয়েছি। লো ফ্যার্টিলিটির পাশপাশি ‘লো মডেলিটি’ অর্থাৎ, আমাদের মৃত্যুহারও কমে গেছেঅনেক। ফলে মানুষের আয়ু বেড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু হচ্ছে ৭০-৭১ বছর এবং নারীরা পুরুষদের চেয়ে এক বছর বেশি বেঁচে থাকছে, যেটা কিছুদিন আগেও ছিল না।

জনসংখ্যার যে দুটো উপাদান জন্ম এবং মৃত্যু-- এ দুটোরই হার কমেছে। জন্ম হার কমে যাওয়ার ফলে লাগামহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটা লাগাম পড়েছে, অর্থাৎ জন্মনিয়ন্ত্রণে সফলতা এসেছে, অন্যদিকে মৃত্যুহার কমে যাওয়ার ফলেকর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। ১৫-৫৯ বছরের মানুষকে মূলত কর্মক্ষম মানুষ হিসেবে ধরা হয়। অর্থনৈতিকভাবে যখন কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন আমরা দেখি, জনসংখ্যায় ভোক্তার চেয়ে উৎপাদকের সংখ্যা বেড়ে যায়।অর্থাৎ, যে মানুষগুলো কর্মক্ষম তারা উৎপাদনে জড়িত হয় এবং সরাসরি তাদের অবদান রাখে। আর ভোক্তা কমে যাওয়ার কারণে ডিপেনডেন্ট পপুলেশন কমে যায়।

আমরা যদি বর্তমান পরিসংখ্যান দেখি, সেখানে ১৫-৫৯ বছরের জনসংখ্যা হচ্ছে প্রায় ৬৮ ভাগ। এই ৬৮ ভাগ জনগোষ্ঠী হচ্ছে উৎপাদক জনগোষ্ঠী। কিছুদিন আগেও আমাদের উৎপাদক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল কম। এর ফলে এই জনসংখ্যাছিল একটি নির্ভরশীল তরুণ জনগোষ্ঠী। জনসংখ্যার মধ্যে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আছে বেশি সেহেতু উৎপাদকের সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের জিডিপি গ্রোথ, মাথাপিছু আয়ের মধ্যে অবদান রাখার সুযোগ তৈরি হয়েছে বেশি। এই উৎপাদকেরসংখ্যা যখন ভোক্তার তুলনায় বেড়ে যায় তখন এই অবস্থাটাকে বলে ‘ডেমোগ্রাফিক ডেবিডেন্ট’ বা কেউ কেউ বলেন ‘ডেমোগ্রাফিক বোনাস’। জন্ম-মৃত্যু কমে যাওয়ার ফলে যে বোনসাটা আমরা পেয়েছি তাই ডেমোগ্রাফিক বোনাস।

এই বোনাস একটি সুযোগের জানালা খুলে দেয় যার মধ্যে দিয়ে সুবাতাস বইতে থাকে। সুবাতাস যদি আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি তাহলে আমাদের অর্থনীতিতে জিডিপির মাত্রাটা বাড়তে থাকবে। এটা কিন্তু সর্বজনীন যে কোনোজনসংখ্যার মধ্যে এই সময়টা অতিবাহিত হয়, যার ৩০-৩৫ বছর হচ্ছে এই সময়টা।  আমাদের দেশে এই সময়টা শুরু হয়েছে 20১১-১২ সালে, এখান থেকে ৩০-৩৫ বছরের একটা স্প্যান, অর্থাৎ ৪৫-৪৬ সাল পর্যন্ত আমাদের ডেমোগ্রাফিকডেবিডেন্ট-এর সময়।

‘ভিশন ২০২১’-এর দর্শনের ভিত্তিতে যে ‘অ্যাক্টিভিটি প্লান’ তৈরি হয়েছে এবং আমরা আরেকটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছি যে ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা উন্নত দেশে পরিণত হব; এটার ভিত্তি হচ্ছে আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়বে, জিডিপি গ্রোথবাড়বে, দারিদ্র্য কমে যাবে, রেমিটেন্স বাড়বে, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে, স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ বাড়বে, আয়ু কমে গিয়ে মানুষ দীর্ঘদিন বাঁচতে পারবে, মায়ের মৃত্যুহার কমবে, শিশু মৃত্যুহার কমবে, শিক্ষার হার বাড়বে-- এ সূচকগুলোর বৃদ্ধিআমাদের পরিচালিত করছে। তখন আর আমাদের বলতে হবে না এটা করতে হবে। তখন আমিই নিজের তাগিদে সুযোগের সদ্ব্যবহার করব।

কিন্তু এর সঙ্গে অবশ্যই রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার সমন্বয় ঘটাতে হবে। তা না হলে এটি বিচ্ছিন্ন উদ্যোগের মতো হবে, হয়তো কিছু কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে সুযোগ তৈরি করতে পারে, কিন্তু সামগ্রিক জাতির ক্ষেত্রে সুযোগটা তৈরি করতে পারবে না। যদিআমরা ডেমোগ্রাফিক ডেবিডেন্ট ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারি তাহলে আগামী দশ বছরের মধ্যে আমরা মধ্য আয়ের দেশ তো হবই, এমনকি আমাদের জিডিপি গ্রোথ ‘ডাবল ডিজিট’ বা দুই অংকের ঘরে চলে যাবে। এ জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনারপ্রয়োজন। আমাদের যে জনসংখ্যার আধিক্য রয়েছে-- এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।

আমি আগেই বলেছি, পৃথিবীর অনেক দেশেই জনসংখ্যার গ্রোথ নেতিবাচক, তাদের ‘লেবার ফোর্স’ নেই যে তারা উৎপাদনে কাজে লাগাবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের লেবার ফোর্স তারা হায়ার করে নিয়ে যেতে চায়।

এশিয়ার মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, মালেয়েশিয়া, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যাটা সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে আমরাই প্রাধান্য বিস্তার করছি উৎপাদক শক্তি হিসেবে তারুণ্যর তেজদীপ্ত গতির। সেখানে যদি সঠিক পরিকল্পনারমাধ্যমে সুসংহত করতে পারি তাহলে দেখা যাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে মানুষের আয়, জীবনধারনের মানসহ অন্যান্য জীবনের প্রয়োজনীয় উপাদান খুব সহজেই অর্জন করতে পারব।

আমাদের একটি বড় অসুবিধা হল ভূমি ছোট। দেড় লাখ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে আমরা প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি মানুষ বাস করছি। পৃথিবীর অন্যতম একটি ঘনত্বপূর্ণ দেশে আমরা বাস করছি। একদিকে এটি আমাদের জন্য সমস্যা অন্যদিকে এটিরএকটি সুযোগও রয়েছে। যেখানে জনসংখ্যা বেশি সেখানে যদি একটি ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করা হয় সেটির প্রোডাকশনের পাশাপাশি কনজুমারও (ভোক্তা) পাওয়া যায়।

অনেক দেশে ইন্ডাস্ট্রির প্রোডাকশন হয় না কনজুমার নেই বলে। আমাদের এখানে এই অবস্থাটা নেই। ধীরে ধীরে আমরা এমন একটি জায়গায় গিয়ে দাঁড়াব; ২০৪০ সাল নাগাদ শহর আর গ্রাম আধাআধি হয়ে যাবে। জীবনধারনের প্রকৃতি শহর ওগ্রামে প্রায়ই একই রকম হবে।

এখনই গ্রামে আগের দিনের মতো পেয়ারা, ডাব বা অন্যান্য ফল পাবেন না, অথচ চিপস, চানাচুর , ঠাণ্ডা পানীয় ইত্যাদি দোকান থেকে আনা প্রতিটি জিনিসই পাবেন। তার মানে পার্থক্য কিন্তু দূর হয়ে যাচ্ছে। একটা শুধু ফারাক থাকছে শহরে যে কর্মক্ষেত্র, সেই কর্মক্ষেত্র গ্রামে এখনও বিস্তৃতভাবে তৈরি হয়নি। কারণ, আমরা যখন গ্রামীণ উন্নয়নের কথা বলি এই উন্নয়নের মানে হচ্ছে কৃষিজ উন্নয়ন। আসলে কিন্তু এটা ঠিক নয়; অকৃষিজ উন্নয়নও গ্রামে বসে ঘটানো যায়। আমাদেরজনগোষ্ঠী রপ্তানি করে আমরা যে রেমিটেন্স পাচ্ছি-- এটি উন্নয়নের একটি বড় অংশ। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট দেখে গেলেন যে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য বাংলাদেশ একটি বিস্ময়। এই বিস্ময় তৈরি হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে রেমিটেন্সএবং আমাদের গার্মেন্ট শিল্পের মধ্যে দিয়ে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা।

আমাদের এই রেমিটেন্স অন্য দেশে গিয়ে কাজ করে আনতে হচ্ছে। আমি মনে করি, এটি একটি নির্ভরশীল কৌশল। আমি যদি নিজের দেশে বসে আউট সোর্সিং ইন্ডাস্ট্রিতে  (এটি প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলারের একটি ইন্ডাস্ট্রি) আমাদের তরুণরা যুক্তহতে পারে, যাদের কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়নি বা সুযোগ হচ্ছে না, তারা বাড়িতে বসে এই আউট সোসিংয়ের মাধ্যমে হাজার হাজার ডলার মাসে আয় করতে পারে। আমাদের দেশে শুরু হয়েছে মূলত ব্যক্তিগত উদ্যোগে, এটির একটি সমন্বিত রূপ কাঠামোথাকতে হবে।

যখনই কোনো জিনিস একটা কাঠামোর মধ্যে আসে তখন এর ফলাফল খুব দ্রুত বেড়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে চীনের উন্নয়নের কথা বলা যায়। একদিকে তারা জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি নামিয়ে এনেছে, অন্যদিকে যে জনসংখ্যা আছে তাদের ছোটছোট কাজ দিয়ে কর্মক্ষেত্র বৃদ্ধি করেছে।  কেউ জেমস ক্লিপ তৈরি করেছে,  কেউ হয়তো স্ট্যাপলার পিন বানিয়েছে-- এভাবে অনেকের ছোট ছোট কাজ সমন্বয় করা হয়েছে। এতে করে কর্মের সঙ্গে যুক্ত হাউজহোল্ডের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণহয়েছে। ফলে জীবনধারন সহজ হয়েছে। যখন এগুলোর সারপ্লাস ন্যাশনাল পর্যায়ে আসল, তখন তারা দেখল কম খরচে অনেক প্রোডাকশন হচ্ছে। এই প্রোডাকশন তখন তারা সারা দুনিয়ায় অল্প খরচে অল্প লাভে ছাড়তে পারল। এতে করে চীনতার প্রোডাক্ট নিয়ে সারা বিশ্ব দখল করেছে এবং খুব দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি করতে সফল হয়েছে।

আমরাও এই জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে পারি সঠিক প্রশিক্ষণ ও নেতৃত্বের সুযোগ তৈরি করে। শিক্ষিত,অল্প শিক্ষিত জনসংখ্যাকে যদি প্রয়োজন ও মেধাভিত্তিক করে আলাদা আলাদা ক্যাটাগরিতে প্রশিক্ষিত করতে পারি, তাহলেআগামী দশ বছরে উন্নয়নের অনেক উচ্চ পর্যায়ে উঠে যেতে পারব। এই মুহূর্তে হয়তো আমরা ভাবতে পারছি না।

এই যে ৩০-৩৫ বছরের উন্নয়নের কথা বলেছি, যেভাবে অন্যান্য উন্নয়নের সূচকগুলো এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে তাতে কিন্তু একটা সংগঠক তৈরি হতে পারে।  দেখা গেল, আমাদের জনসংখ্যার হার এত কমে গেল যে আমরা আর ডেবিডেন্ট-এরসময় ৩৫ বছর না পেয়ে ২৫ বছর পেলাম। সে জন্য আমাদের আরও একটু আগে থেকে চিন্তা করতে হবে। আমাদের বর্তমান প্রজেকশনে দেখা যাচ্ছে, ২০৪৭ সালে গিয়ে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা তরুণদের চেয়ে বেশি হবে।

এই যে ডেমোগ্রাফিক ডেবিডেন্ট-এর ফলে যে লোকগুলো কর্মক্ষেত্রে ঢুকছে এরাই একটা সময় ষাটের ওপর চলে যাবে তখন এই ঢালটা নামবে। আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডেবিডেন্ট-এর ‘কার্ভ’ এখন ঊর্ধ্বমুখী। ২০৪৭-এ যখন ক্রসিং হবে তখন দেখাযাবে, আমাদের জনসংখ্যার মধ্যে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেশি আসবে।

আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হতে হবে। এ কারণেই হতে হবে যে বয়স্ক মানুষের স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া, জীবনধারন সহজ করা মানে সুন্দর করে বেঁচে থাকার জন্য অর্থনৈতিকভাবে পরিবেশ তৈরিকরার জন্য আমাদের ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হতেই হবে। তা না হলে আমাদের অন্যান্য সম্পদের অভাবের কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ওই গতিতে না করলে ভবিষ্যতে সামাল দিতে পারব না।