সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এগোবে বাংলাদেশ

মো. খায়রুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Oct 2016, 05:24 AM
Updated : 24 Oct 2016, 10:14 AM

এ বছর ইলিশ মাছ খেয়ে আমরা সবাই তৃপ্ত। কেউ ভেবে দেখিনি, এ রকম সাইজের ইলিশ আর সংখ্যার দিক থেকে এমন প্রাপ্তির পেছনে সরকারের কত বিশাল কর্মযজ্ঞ, কত বছরের, কত মানুষের বিশেষত, দরিদ্র জেলেদের কত ত্যাগ রয়েছে। (প্র)শংসা-বচনে আমরা সচরাচর আমরা বেশ কৃপণ। তৃপ্তির ঢেঁকুর মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের ধন্যবাদ জানানো দরকার; বোঝা দরকার যে কোনো প্রাপ্তিই এমনি এমনি আসে না; এর পেছনে অনেক পরিকল্পনা আর অনেক দিনের অনেক কর্মকাণ্ডের দরকার হয়; আর সবচেয়ে বেশি দরকার হয় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ।

গত দশ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত অনেক প্রশংসা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও পুরস্কার পেয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে অর্জনের এবং সাফল্যের তালিকা অনেক লম্বা। কিন্তু এসবের মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে শিশুমৃত্যু হ্রাস, মাতৃমৃত্যু হ্রাস, জনসংখ্যা হ্রাস, আয়ু বৃদ্ধি, শিশু স্বাস্থ্যের উন্নতি ইত্যাদি। এসব অর্জনের পেছনে রয়েছে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি, ওআরএস-এর ব্যাপক প্রচলন, পরিবার পরিকল্পনার ব্যাপক প্রসার, যক্ষার ওষুধ সেবন কর্মসূচিসহ নানা প্রকার কার্যক্রম। এখানে লক্ষণীয়, এসব কর্মসূচি দশকের পর দশক ধরে চলে আসছে। আমরা অনেক সময় না জেনেই সমালোচনা করি যে এক সরকার এসে আগের সরকারের সবকিছু পাল্টে দেয়। এই সমালোচনার খানিকটা ভিত্তি খাকলেও স্বাস্থ্য খাতের মাত্র একটি কর্মসূচি ছাড়া বেশির ভাগ কর্মসূচি ধারাবাহিকভাবে চলেছে।  শিক্ষা খাতেও বিশেষত, নারী শিক্ষার ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। এক সরকারের চেয়ে আরেক সরকার এসব কর্মসূচিতে আরও ভালো করতে চেয়েছে।  রাজনৈতিক বিরোধিতা এবং কখনও কখনও রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে এসব কর্মসূচির কাজে বিঘ্ন ঘটলেও আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্য কর্মসূচিগুলো ধারাবাহিকভাবে চলতে পারা আমাদের দেশের জন্য সৌভাগ্যের এবং স্বাস্থ্য খাতের গত দশকের সাফল্যের একটি অন্যতম নিয়ামক। 

দ্বিতীয়ত, এসব কর্মসূচি মূলত জনস্বাস্থ্য বিষয়ক, চিকিৎসা বিষয়ক নয়। মাঠ পর্যায়ে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে সরকারের বিশাল কর্মী বাহিনী; তারা কেউ ডাক্তার নন। তাদের সঙ্গে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে এনজিওর কর্মীরা।  এদের নেতৃত্ব দিয়েছেন যারা তারা সবাই জনস্বাস্থ্য পেশাজীবি; তাদের অনেকের স্নাতক ডিগ্রি মেডিকেল কলেজ থেকে অর্জিত হলেও তারা কাজ করেছেন  জনস্বাস্থ্য পেশাজীবী হিসেবে।  স্থানীয় পর্যায়ে সরকারের ও এনজিওদের বিশাল মাঠকর্মী বাহিনী সেই সঙ্গে সাধারণ জনগণের বিশেষত, মায়েদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এ রকম সাফল্য অর্জনের আরেকটি নিয়ামক।

তবে সবাইকে জানতে হবে ও বুঝতে হবে যে, বীজ রোপিত হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার গোড়ায় রয়েছে জনমানুষের অংশগ্রহণ।  সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ‘গণস্বাস্থ্য’ শব্দবন্ধে প্রকাশ করার মতো স্বপ্নদ্রষ্টা আর কেউ নন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবেলা ও মহামারী মোকাবেলার সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। ২০০৭ সালের সিডর বা ২০০৯ সালের আইলার মতো প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের পর দেশে কোনো মহামারী হয়নি।  মাঝেমধ্যে সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু, সারস, নিপা ভাইরাসসহ নানা প্রকার আন্তঃদেশীয় মহামারীর আশঙ্কা বাংলাদেশে সফলতার সঙ্গে মোকাবেলা করেছে বাংলাদেশেরই সরকারি প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ বাংলাদেশ বেশ কিছু উদ্ভাবনী উদাহরণ তৈরি করেছে এবং তা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। এখানে অপ্রাসঙ্গিক শোনালেও একটা সুপারিশ করে রাখি, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির প্রথম প্রকল্প পরিচালক ডা. লুতফর রহমান তালুকদার এবং আইইডিসিআর-এর সদ্য সাবেক পরিচালক ডা. মাহমুদুর রহমানকে জীবিত থাকাকালেই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বা পুরষ্কার দেওয়া হোক।  এদের অবদান স্মরণীয়।  

বিগত দশ বছরে আমাদের অন্যতম অর্জন হল, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামোতে নিম্নতম পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের সংযোজন। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন কর্মসূচি নানা রাজনৈতিক সরকারের আমলে ধারাবাহিকভাবে চললেও কমিউনিটি ক্লিনিকের সংযোজন রাজনৈতিক বিবেচনায় অপাংক্তেয় করার সিদ্ধান্তটি ছিল অত্যন্ত হঠকারী এবং তা আখেরে বিএনপিকে ভালো ফল দেয়নি। বর্তমান সরকার কমিউনিটি ক্লিনিককে প্রকল্প আকারে চালাচ্ছে এবং এর জনবল ঢালাওভাবে সরকারিকরণের পক্ষপাতী নয়।  আশা করি, সরকার যেন এ সিদ্ধান্তে স্থির থাকে। কমিউনিটি ক্লিনিকের জনশক্তিকে কিভাবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান দিয়ে মানসম্মতভাবে নিয়োগ দিতে পারে  এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কাছে জবাবদিহি করার সুপারিশ করছি। কমিউনিটি ক্লিনিকের পরিচালন ব্যয় আর বেতনের টাকা পরিচালনা কমিটির কাছে সরকার হস্তান্তর করে দিলেই এটা করা সম্ভব। এর জন্য আইন করার প্রয়োজন নেই; মন্ত্রনালয়ের বিধিই যথেষ্ট। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার স্বার্থে এটা করা জরুরি।

তৃণমূল পর্যন্ত ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। বিশেষ করে সরকারি ওষুধ লাল সবুজ মোড়কে সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত খুব কাজে দিয়েছে এবং ওষুধ চুরি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

১৯৮২ সালের যুগান্তকারী জাতীয় ওষুধ নীতির ফলে আজ দেশীয় ওষুধ শিল্প বিকশিত হয়েছে। সম্প্রতি একটি বাংলাদেশি কোম্পানি খোদ মার্কিন মুলুকে ওষুধ রপ্তানি করতে শুরু করেছে। পাঁচ বছর আগের হিসাব অনুযায়ী, জাতীয় ওষুধ নীতির জন্য বাংলাদেশ ৬০ হাজার কোটি ডলার সাশ্রয় করতে পেরেছে। কিন্তু উদ্বেগের সঙ্গে আমরা লক্ষ করেছি যে, বিগত কয়েক বছরে ওষুধের বাজার এবং দাম আর কারো নিয়ন্ত্রনে নেই। অতি দ্রুত ওষুধের দাম বেড়ে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে। জাতীয় ওষুধ নীতির মূল বৈশিষ্টগুলো ১৯৯১-৯৬ সালের সরকারের আমলে ছেটে ফেলা হয়। আর বাকি সর্বনাশের সূচনা হয় ২০০৯ সালের পর থেকে। মহান জাতীয় সংসদের সদস্য, ব্যবসা, আর ওষুধ প্রশাসনের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতায় তেমন কোনো ভিন্নতা না থাকায় এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হয়।

আমাদের কাছে একটা বিষয় বেশ আশ্চর্যজনক  মনে হয়। যে আমলে সরকারি ওষুধ চুরি প্রায় বন্ধ হয়ে গেল সে আমলেই শুরু হয়ে গেল বিভিন্ন হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজে যন্ত্রপাতি, উপকরণ কেনাকাটার নামে ‘হরিলুট’। স্বাস্থ্য খাতের অপারেশনাল প্ল্যানের প্রশিক্ষণ হয়ে যায় ‘হাওয়াই’ বিষয়।  ফাপাদের অডিট রিপোর্ট নানা গুণীজনের ইমেজ ম্লান করে দিচ্ছে; সরকারি ও বেসরকারি খাতে পাল্লা দিয়ে মেডিকেল কলেজ স্থাপন, সেগুলোতে আসন বাড়ানো, ওষুধ-উপকরণ কোম্পানি বা ঠিকাদারের কল্যাণে  বিদেশ ভ্রমণ ইত্যাদি নীতিবহির্ভুত কর্মকাণ্ডে নেতা ও কর্মকর্তাদের জড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ পত্রিকায় নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

আশা-হতাশার এমন দোলাচলে আগামী দশ বছরের জন্য কী স্বপ্ন দেখব স্বাস্থ্য খাতের জন্য? ‘রূপকল্প ২০২১’ এখন আর স্বপ্ন মনে হয় না; বাংলাদেশ এখন তৈরি হচ্ছে ২০৪১ সালের জন্য; কোমর বেঁধে নামতে হচ্ছে এসডিজি অর্জনের জন্য। বিশ্বজুড়ে জেগেছে পরিবর্তনের আশা। পরিবর্তন আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় মহাপরিচালকের পদে। দেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব নিয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তি, স্বচ্ছতা আর উপাত্তে বিশ্বাসী একজন অধ্যাপক। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের দায়িত্ব নিয়েছেন অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন পরিশীলিত একজন কর্মকর্তা। দারিদ্র্যকে অতীতের বিষয় করে তোলার প্রত্যয় শোনা যায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে। নানা স্তরে নতুন নেতৃত্ব আমাদের আশাবাদী করে তোলে;  তাই তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা খোলাসা করা দরকার।  

প্রথমত, আমরা চাই অনুমোদিত স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নীতির আলোকে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাতের আগামীদিনের কর্মসূচি প্রণয়ন করা হোক। দাতা কনসোর্টিয়াম-নির্ভর না হয়ে নিজস্ব জনবলের উপর আস্থা রাখুন, বাংলাদেশে অনেক মানুষ আছে যারা স্বাস্থ্য খাতে ‘গুরু’, তাঁদের পরামর্শ নিন, তাঁদের কাজে লাগান।

এমডিজিতে যেভাবে সাফল্য এসেছে, এসডিজি অর্জন ততটা সহজ হবে না; এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতে সাম্য আনা হবে বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ যায় সাধারণ মানুষের পকেট থেকে।  আর যেটুকু পকেট থেকে যায় তার সিংহ ভাগ যায় প্রাইভেট সেক্টরে ওষুধপত্র কেনা বাবদ। বাংলাদেশে প্রায় আড়াই লাখ ওষুধের দোকান কোনো নিয়ম-নীতি ছাড়াই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছ। দোকান যত মফস্বলের তত বেশি নিম্নমানের ওষুধ; তত বেশি লাভ। বেশির ভাগ ওষুধ কোম্পানি ওষুধের প্রমোশনে নীতিবোধের কোনো ধার ধারে না। ফলে হাল আমলের কিংবা পৃথিবীতে সদ্য আসা অ্যান্টিবায়োটিক বাংলাদেশে পাওয়া যায়; এবং তার যথেচ্ছ প্রয়োগ হয়। বাংলাদেশে যে দ্রুততার সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক তার প্রয়োগ ক্ষমতা হারাচ্ছে তাতে যে কোনো সময় ভয়াবহ দুর্যোগ ঘটে যেতে পারে। সেই সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে দাম। কয়েক বছর আগেও কোনো অসুখ-বিসুখে শ’ খানেক টাকার ওষুধ হলেই চলত। এখন হাল আমলের অ্যান্টিবায়োটিক, ওষুধ প্রশাসনের লাগাম ছেড়ে দেওয়া আর অপপ্রয়োগের কারণে হাজার টাকায়ও সাধারণ অসুখের একটা পর্ব পাড়ি দেওয়া যায় না।  এ জন্য আশু দরকার এই আড়াই লাখ ওষুধের দোকানের দিকে মনোযোগ দেওয়া। উট পাখির মতো তাদের ব্যাপারে বালিতে মুখ গুজে থাকলে কাজ হবে না, তাদের সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। মানুষের পকেটের ব্যয় আরও বাড়বে। তাই তাদের প্রশিক্ষিত করতে হবে, সেই সঙ্গে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে লাইসেন্সের মাধ্যমে আর নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে।

বাংলাদেশে এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সরকারি চ্যানেলে ওষুধ পৌঁছে যায়, বিতরণ হয়। সেসব ওষুধের বেশির ভাগই সংক্রামক অসুখ সংক্রান্ত। ওষুধের তালিকাটা আরেকবার যাচাই-বাছাই করতে হবে। এখন যাদের অসংক্রামক দীর্ঘমেয়াদি অসুখ আছে তাদের ভীষণ বিপদ।  যার ঘরে একজন উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের রোগী আছে, তিনি জানেন প্রতি মাসে কত টাকার ওষুধ লাগে আর কত টাকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয়।  সরকার যদি সবাইকে না-ও পারে, তবে শুধু হতদরিদ্র ও দরিদ্রদের জন্য  কমিউনিটি ক্লিনিক আর নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের ওষুধ সরবরাহ করতে পারে। এতে করে দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত হবে এবং দারিদ্র্য নিরসনেও তা সহায়ক হবে। সবচেয়ে বড় কথা, এতে করে সামাজিক ন্যায্যতা ও সাম্য আসবে। 

সম্পতি বিশ্বব্যাংকের প্রধান বাংলাদেশের অপুষ্টি নিয়ে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করে বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের আশ্বাস দিয়ে গেছেন। বলা বাহুল্য, এর আগেও বিশ্বব্যাংক নব্বই দশকে বাংলাদেশের অপুষ্টি নিবারণে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল।  সেই ঋণে যেখানে অপুষ্টি নিবারণে কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে আর যেখানে হয়নি দুই জায়গার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য পাওয়া যায়নি। তাই এ রকম ঋণ গ্রহণের আগে অপুষ্টি নিবারণের কর্মসূচি ভালোভাবে যাচাই করে নিতে হবে।  বর্তমান বাংলাদেশে খোলা জায়গায় মলত্যাগের হার প্রায় এক শতাংশের মতো।  কিন্তু এখনও মাত্র ৪০% শিশুর মল নিরাপদ স্থানে ফেলা হয়। বেশির ভাগ মায়েরা শিশুদের পায়খানা করানোর পর সাবান দিয়ে হাত না ধুয়েই খাবার খাওয়ান। ফলে, আন্ত্রিক ব্যাধিতে ভুগে শিশুদের পেটের ঝিল্লির শোষণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, খাবারের পুষ্টি শরীরে যায় না। ফলে অপুষ্টি দানা বাঁধে।

স্যানিটেশনের উন্নতি এবং স্বাস্থ্য আচরণ বিধির উন্নতি ছাড়া  শিশু পুষ্টির উন্নতি করা দুরূহ। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত এখনও স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য আচরণ বিধিকে স্বাস্থ্য খাতের অন্তর্গত বিষয় হিসেবে মানতে পারছে না। এই মানসিকতার আশু পরিবর্তন করে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির জন্য স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য আচরণ বিধিকে স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির একটি পরিমাপক হিসেবে দেখতে হবে।     

আর নজর দিতে হবে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকে।  যদিও সম্প্রতি সরকার সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বাস্তবায়নে পরীক্ষামূলকভাবে স্বাস্থ্য বীমার প্রচলন করেছে। সব সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের যদি স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আনা যেত, তবে কাজটি খুব সহজ হত।  ফরাস উদ্দিন  সাহেবের নেতৃত্বাধীন সর্বশেষ বেতন কমিশন এ রকম একটা সুপারিশ রেখেছিলেন; কিন্তু কেন সেটা কাজে লাগানো হল না তা বুঝতে পারলাম না।  সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাস্তবায়নের ভালো দিক হল, এখন পর্যন্ত প্রাইভেট সেক্টরকে কিছুটা হলেও কাজে লাগানো হয়েছে।  তবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কাছে স্বাস্থ্য খাত কার্যকরভাবে হস্তান্তরিত না করা হলে এসব কর্মসূচি যথাযথ বাস্তবায়ন করা যাবে না। 

এরপরও আমরা আশাবাদী। কেননা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাস্তবায়নে কথা দিয়ে এসেছেন; এসডিজি বাস্তবায়ন করতে হলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাস্তবায়ন করতেই হবে। স্বাস্থ্য খাতের আগামী সেক্টর প্রোগ্রামে যদি বিভিন্ন অপারেশনাল প্ল্যানে এর যথাযথ প্রতিফলন ঘটানো যায় আর সেই সঙ্গে যদি স্বাস্থ্য খাতের দাতা সংস্থার অলিখিত মোড়লেরা বাধা না দেন তাহলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছরেই অনেক এগিয়ে যাবে।  সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষাই হল আগামী দিনের বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের দিক নির্দেশক।

আমরা প্রায়ই বলে থাকি যে, রাজনৈতিক অঙ্গীকার হল উন্নয়নের মূল নিয়ামক। বর্তমান বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছে, আছে সদিচ্ছা আর দৃঢ়চেতা মনোভাব। হয়তো সঙ্গে আছে কিছু অদক্ষতা আর দুর্নীতির মিশেল। রাজনৈতিক ও নির্বাচনী হাওয়া যদি জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসে, তাহলে যেভাবে বিভিন্ন নীতি, কৌশলপত্র ও কর্মসূচি প্রণীত হচ্ছে, আর সেই সঙ্গে যদি স্বাস্থ্য খাত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কাছে স্বাস্থ্য খাত কার্যকরভাবে হস্তান্তরিত করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে গুণগত পরিবর্তন আশা করা যায়। সেই সঙ্গে আশা করা যায়, বাংলাদেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকে এগিয়ে যাবে।