রাজনৈতিকভাবে নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে

খুশি কবিরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Oct 2016, 09:08 AM
Updated : 23 Oct 2016, 11:48 AM

দশ বছর পরের বাংলাদেশ সম্পর্কে বলতে গেলে বর্তমান বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা দরকার। বর্তমান বাংলাদেশের ভালো, মন্দ দুই অবস্থাই বলতে হয়। বর্তমান বাংলাদেশের অনেকগুলো জায়গায় উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে নারীর অবস্থান গত বিশ বছরের তুলনায় অনেকটাই এগিয়েছে। গত দশ বছরে নারীর কাজের ক্ষেত্রগুলো বড়েছে। কাজের সূত্রে  গ্রাম-গঞ্জে, মাঠে-ঘাটে যেতে হয়, প্রান্তিকদের নিয়েও কাজ করি। তাতে দেখা যায়, পোশাক কারখানায় আগেই ছিল, এখন সব ক্ষেত্রেই নারী শ্রমিকদের সংখ্যা বড়েছে। নারীর কাজ করার বাধা অনেকটাই দূর হয়েছে। আগে বাড়িতে নারীরা কিষানীর কাজ করত এখন তারা মাঠে সরাসরি কাজ করছে। কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

শিক্ষার হার বেড়েছে যা কেবল সংখ্যায় নয়, মেধার দিক থেকেও মেয়েরা অগ্রসর হয়েছে। এখন আর সংসারে ছেলে-সন্তান জন্ম নিতেই হবে বা ময়ে-সন্তানকে লেখাপড়া করানো হবে না-- এমন মানসিক অবস্থা নেই। শ্রমিক, ভূমিহীন ও দরিদ্র পরবিারেও মেয়েকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা দখা যায়। মধ্যবিত্ত সমাজে আগে মেয়েরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে যেত। শিক্ষিত হলে ভালো বিয়ে হবে-- এমনটা ছিল পরিবার, সমাজ ও  মেয়েটির নিজের মানসকিতা। কিন্তু এখন শিক্ষিত হয়ে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে এবং পরিবার, সমাজ, রাজনীতি ও নানা সংগঠনের দায়িত্ব পালন করছে। ব্যতিক্রম সবসময়ই আছে ও থাকবে।  বহুদিন ধরে নারীর বিয়েটাই ছিল সব থকে বড় বিষয়, যা এখন আর অতটা নেই। নারী সমাজিকভাবে একটা অবস্থানে দাঁড়িয়েছে, নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখেছে যা ইতিবাচক। বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রের সূচক বেড়েছে। গড় আয়ু বড়েছে, তবে ‘না’ সূচকের সংখ্যাও কম নয় এখনও এই দেশে। নারীর কর্মসংস্থান বাড়লেও মজুরি বাড়েনি সেই হারে। যৌন-হয়রানি, যাতায়াত ব্যবস্থার অসুবিধা, কর্মস্থলে নানা বৈষম্য, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষমতা না থাকা নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে এখনও বড় বাধা। যা প্রতিনিয়তই মোকাবেলা করছে নারী। এসব তো সামাজিকভাবে, রাজনৈতিক ও কর্মস্থলের নেতিবাচক পরিস্থিতির চিত্রই তুলে ধরে। এ দেশে সবচেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে নিরাপত্তার বিষয়টি, বিশেষ করে নারীর নিরাপত্তাহীনতা।

গত এক-দুই দশকের বাংলাদেশের অর্জনগুলো ম্লান করে দেয় এসব নেতিবাচক সূচক। এসব পরিস্থিতিতে নারী ভয় পায়। কারণ, নানা দিক থেকে সবার আগে তারাই আক্রান্ত হয়। এসব পরিস্থিতিতে যে কোনো নারী নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে, আত্মবিশ্বাসটুকু মিলিয়ে যায়। এমনকি পরিবারও শঙ্কিত থাকে সবসময়। তাতে স্বাভাবিক অগ্রগতি তার আর হয় না। তারপরও এখন এ দেশের নারীরা অনেক বেশি ঘরে-বাইরে ফাইট করছে বলা যায়। পরিবার সমাজ সহকর্মীদরের সমর্থন না পেলে ফাইট করেও জয়ী হতে পারে না। ব্যতিক্রম আছে। যারা পায় তারা সামলে উঠতে পারে। নারীর অগ্রগতি ও ক্ষমতার গল্প আমাদের দেশে উল্লেখ করার মতো হয়েছে, এর বড় কারণ হল, নারীর এখন দুটি চরিত্রে ভূমিকা পালন করতে হয়। সংসারের কাজের দায়িত্ব এবং কর্মস্থলের দায়িত্ব-- দু্টোই পালন করতে হচ্ছে। পুরুষদের বেলায় সমানভাবে দুই দায়িত্ব পালনে বাধ্যবাধকতা নেই। এর জন্য সমাজ-সংসারে কেউ দোষ ধরে না। এই দৃষ্টিভঙ্গি এখনও সব স্তরেই রয়ে গেছে। যা আমাদের সামাজিক ও ধর্মীয় অজ্ঞতার কুসংস্কারে বন্দি বলেই এমনটা হচ্ছে। ফলে নারীর পথচলা এখনও সহজ হয়নি। আর এসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে নারীর অধিকারের বিষয়টি।

বিশ্বজুড়েই এখন বলা হয়, ‘নারীর অধিকারই মানবাধিকার’। সংবিধানে নারীর অধিকার একজন নাগরিকের অধিকারের মতোই পাওয়ার কথা লেখা আছে। বাংলাদেশে অনেক আইন আছে নারীর পক্ষে, কিন্তু তা প্রয়োগ হয় কম। এ ছাড়া অধিকাংশ নারীই তাদের অধিকার ও মানবাধিকার সম্পর্কে জানে না। তাই নারীর অধিকার ক্ষুণ্ন হলে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়-- এটা সাদামাটাভাবে বলা যায়। ভূমিহীন থেকে সমাজের সব স্তরে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সবকছিুই ক্ষমতাকেন্দ্রীক। নারীর ক্ষমতা খুব কম। তাই তার অধিকার ক্ষুণ্ন হয় অনেক ক্ষেত্রেই, সেই সঙ্গে মানবাধিকারও। ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ যে বা যারা করে তারাই এই অধিকার নিয়ন্ত্রণ করে। এখনও অধিকাংশ নারীর নিজস্ব সম্পদ কম বা নেই। জমি-বাড়ি ও অর্থ সস্পদের উপর অধিকার নারীর নেই বললেই চলে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে নারী ক্ষমতা অর্জন করে পরিবারে, সমাজে।  রাজনৈতিকভবেও নারী ক্ষমতা অর্জন করে। তবে তারা এই ক্ষমতা কতটা ভোগ করতে এবং প্রয়োগ করতে পারে, সেটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রশ্নবোধক।

বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে নারীর ক্ষমতায়ন হয়ছে। তৃণমূল থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নারী ক্ষমতায় আছে। তার অর্থ এই নয় যে, নারী অধিকার ও মানবাধিকার এ দেশে সুরক্ষিত। মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে পারে নানাভাবে। (বাংলাদেশে মানবাধিকার কতটা কিভাবে রক্ষা হচ্ছে বা হচ্ছে না, তা বিস্তৃত আলোচনার বিষয়)। কখনও ব্যক্তির উপর ব্যক্তি, ব্যক্তি গোষ্ঠীর উপর আবার গোষ্ঠী, আরেক দুর্বল গোষ্ঠীর উপর নিজেদের মতাদর্শ চাপানোর চেষ্টা করে বা বাধ্য করে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের নামান্তর। যেমন সংসারে নারীর উপর স্বামী বা অন্য কেউ নানা ধরনের নির্যাতন করে তেমনি নারী গোষ্ঠীর উপর রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় ও সামাজিক গোষ্ঠী নানা মত ও ফতোয়া জারি করে, আবার রাজনৈতিক দল আরেক দলের উপর নির্যাতন চালায়। তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়।

মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব মূলত রাষ্ট্রের, আবার কখনও রাষ্ট্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক দল মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, আবার কোথাও লঙ্ঘন হলে এর প্রতিবাদ করে, সুবিচার চায় রাষ্ট্রের কাছে। বাংলাদেশে এর সবকটি পরিস্থিতিই বিদ্যমান, দশ বছর পরেও এই পরিস্থিতি খুব একটা বদলাবে তা বলা যায় না। বিষয়গুলো ক্রমাগত চর্চার বিষয়। রাষ্ট্রের কিছু সিস্টেম এবং এর প্রয়োগ কতটা হচ্ছে সেটাই বড় কথা। আর তা সরকারের নীতি ও পরিচালনার দক্ষতার উপরও নির্ভর করে।

সবকিছুই রাজনৈতিক, রাজনীতির বাইরে তো কিছু নেই। এর বাইরে অনেক কিছু করার ক্ষমতাও কারো নেই। তাই ক্ষমতায় যারা বা যিনি থাকেন তার অনেক দায়িত্ব, তার বা তাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বেশি।

দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতাই বড় কথা। এর বড় কারণ বহুযুগের চর্চায় সবকিছুতেই পুরুষতন্ত্র ও পরুষতান্ত্রীক মানসিকতায় অভ্যস্ত ব্যক্তি ও সমাজ। বেশিরভাগ নারীর মানসকিতাও এর বাইরে নয়। এর সঙ্গে জড়িত শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চার বিষয়টি। ব্যক্তি, পরিবার  সমাজ ও রাষ্ট্রের আইন ও নিয়ম  প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্য দিয়ে। উন্নয়নের সূচক, প্রযুক্তির প্রসার ও শিক্ষার হারসহ নানা রকম ইতিবাচক গল্পের পাশাপাশি নারী বা পুরুষ সবার জন্যই অনেক কিছুই করা যায়নি। যা হলে দশ বছর পরের বাংলাদেশ হত সবদিক থেকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ।

যদিও বর্তমান সরকার নারীর জন্য কল্যাণকর অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে তারপরও নারীর পথ চলা এখনও অনেক কঠিন। আর সাম্প্রতিক সময় ধর্মকে ব্যবহার করে এবং এর ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ দেশের নারী-পুরুষ সবাইকে নির্যাতন করছে, নৃশংস মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।  এটা বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে যা অনাকাঙ্খিত। শিক্ষিত মেধাবী তরুণ ও শিক্ষকসহ নারীরাও জড়িয়েছে এই ভুল আর নাশকতা ও আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডে। তারা বন্ধু, সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব মানবাধিকার কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা না করে এই ধ্বংসলীলায় মেতেছে। ফলে এত অর্জনের সুফল আর উন্নতির সূচক নিয়েও শঙ্কিত আর আতংকিত হতে হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ করে অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিমিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। একটা অসাম্প্রদায়িক, সাংস্কৃতিক ও উন্নত দেশ হবে এমন প্রত্যাশাই ছিল। এই দেশের ইতিহাস তো একটু আলাদা; গৌরবের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে।

গত দশকের অর্জনের ধারাবাহিকতায় আগামী দশ বছর পরে বাংলাদেশকে অনেক উন্নত দেশ হিসেবে (সবদিক থেকে) দেখার আশা করাটাই তো স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু তা পারছি না পুরোপুরি। এর বড় কারণ এ দেশের মানুষ একদিকে প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়ে বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে চাইছে অন্যদিকে নানারকম কুসংস্কার ও পুরনো ধ্যান-ধারণা লালন করে এবং তা চর্চাও করে।

তারপরও বাংলাদেশের মানুষ স্বপ্ন দেখতে শিখেছে, বিশ্বে পা বাড়িয়েছে। অনেক উদ্যোগ, পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে এত কাজ হওয়ার পরও দশ বছর পরের বাংলাদেশ ভাবলে যা মনে হয় তা হল, বাংলাদেশের দারিদ্র্য কমানোর চেষ্টা থাকার পরও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়বে। অনেকে অনেক সম্পদের মালিক হবে অন্যদিকে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়বে।

নারীর কাজের ক্ষেত্র ও রাজনৈতিকভাবে অংশগ্রহণ বাড়বে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা মূল জায়গায় তাদের অবস্থান দৃঢ় হতে পারে। গণমাধ্যমসহ অন্য প্রতিষ্ঠানে নারীর বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই আরও সহজভাবে উঠে আসবে। যা এখনও মানুষ সহজভাবে নিতে পারে না। নারী দলবদ্ধ হবে এবং তার পরিচয়ের ক্ষেত্র বাড়াবে। কিন্ত নারীর প্রতি বিদ্যমান বৈষম্যমূলক আইন, দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার পরিবর্তন তেমন হবে না। কারণ, ৩০ বছরেও যা হয়নি এই দশ বছরে হবে তা আশা করতে পারি না। সংবিধানে নারীর সমান অধিকারের কথা লেখা থাকলেও তা কার্যকর নয়। দুর্নীতির পরিমান কমবে এ কথা বলা যায় না। ৪০ বছরের গড়ে ওঠা দুর্নীতির পাহাড় এত তাড়াতাড়ি ছোট হবে না।

জনসংখ্যার তুলনায় ভূমির পরিমান কমে যাবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ভূমিহীনদের ভূমি দেওয়ার ব্যবস্থা হয়, তারপরেও নগরায়ন ও নানা কারণে এই সমস্যাটা বাড়বে।

দেশের বড় অংশ তরুণ সমাজ, তারা এখন কাজ করে, চিন্তায় ও যোগাযোগে অগ্রসর। সম্ভাবনাময় এসব তরুণ দশ বছরে পরিণত হবে। তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাদের যদি দেশপ্রেমে ও সঠিক শিক্ষায় গড়ে তোলা না যায়, তবে দশ বছর পরের যে বাংলাদেশ দেখতে চাই বা যা হওয়া উচিত তা হবে না। এ বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে,  সবারই কাজ করা প্রয়োজন। 

সবকিছুই তো রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু বাংলাদেশে সংসদে তো সরকার দলই সব করছে, বিরোধীদলের ভূমিকা কোথায়? প্রতিবাদ, তর্ক-বিতর্ক তো দেখা যায় না। বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি কোনো কিছুতেই জোরালো ভূমিকা নিতে দেখছি না। কার্যকর সংসদ যা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আইন প্রণয়ন ও মূল সিদ্ধান্তগুলো সংসদেই হয়। এমন চলতে থাকলে এ দেশে কেমন গণতন্ত্র  চর্চা হবে-- এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। দশ বছর পরে সংসদ এমনটা থাকুক তা চাই না। তবে এখন পর্যন্ত যে অর্জনগুলো বংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছে এর ধারাবাহিকতা থাকলে দশ বছর পর বাংলাদেশ আরও অগ্রসর বাংলাদেশ হবে।

অনুলিখন: বনশ্রী ডলি