মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ পাবে সবাই

ড. ছিদ্দিকুর রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Oct 2016, 07:40 PM
Updated : 23 Oct 2016, 11:27 AM

আগামী দশ বছরের মধ্যে আমরা সুশিক্ষিত আলোকিত সমাজ দেখতে চাই। সেখানে নৈতিক গুণাবলী-সমৃদ্ধ জ্ঞানী ও দক্ষ মানুষ থাকবে। আগামী দশ বছরে সাক্ষরতার হার ৯৫ শতাংশের ঘর অতিক্রম করবে। এতে আনুপাতিক হারে নারী-পুরুষের সমান অংশিদারিত্ব থাকবে। যুবসমাজ হবে শিক্ষার মাধ্যমে কুসংস্কারমুক্ত। তারা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায় দেশপ্রেমিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠবে। দেশে-বিদেশে কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করবে তারা; স্বাবলম্বী হয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচবে।

ধর্মান্ধতামুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক, স্ব স্ব ধর্মের সঠিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং জঙ্গিবাদবিরোধী মনোভাবাপন্ন নাগরিকের দেশ হবে বাংলাদেশ। যুবসমাজ মাতৃভাষার প্রতি অধিক মনোযোগী হবে। ইংরেজি ভাষাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই, কিন্তু ইংরেজির প্রতি অনুরাগ হ্রাস পাবে।

শিক্ষার সব মাধ্যমে যুবসমাজের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ বৃত্তিমূলক ও কারিগরী শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। আমাদের শিক্ষাক্রম ব্যক্তি, সমাজ ও দেশের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে।

শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন ধারার বৈষম্য থাকবে না-- সবাই মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ পাবে। সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে। কারণ, শিক্ষার মাধ্যমে সার্বিক জ্ঞান আহরণ করবে শিক্ষার্থীরা। কোনটা নৈতিক, কোনটা অনৈতিক-- সে ব্যাপারে যেমন বোধোদয় হবে শিক্ষার্থীদের তেমনি বিজ্ঞানমনস্কতাও অর্জন করবে তারা। সুতরাং সার্বিকভাবে সবকিছুর ভালো-মন্দ বুঝতে সক্ষম হবে শিক্ষার্থীরা। অতএব, তারা সুস্থ মন ও দেহের অধিকারী হবে।

আমার বিশ্বাস, আগামী এক দশকের মধ্যে দক্ষ জনগোষ্ঠী হিসেবে যুবসমাজের দুই-তৃতীয়াংশ দেশে এবং এক-তৃতীয়াংশ দেশের বাইরে কর্মরত থাকবে। তাদের অধিকাংশই হবে ‘সেলফ এমপ্লয়েড’। অন্যের চাকরি নয়, বরং নিজেদের উদ্যোগে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে তারা; অন্যরা সেখানে কাজের সুযোগ পাবে।

সর্বস্তরের-- প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রে পাণ্ডিত্য, পার্থিব জ্ঞান, পেশাগত অনুরাগ ও দেশপ্রেম প্রধান বিবেচ্য হবে। শিক্ষকদের ক্ষেত্রে অবশ্যই রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা পরিত্যাজ্য হতে হবে। তবে এ কথার অর্থ এই নয় যে, তাঁরা রাজনীতি সচেতন হবেন না। রাজনৈতিক সচেতনতা এক জিনিস আর রাজনৈতিক আনুগত্য আরেক জিনিস। এ দুয়ের পার্থক্য আমরা বর্তমানের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালে সহজেই অনুধাবন করতে পারি।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে জ্ঞান চর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির কেন্দ্র। এ বিষয়ে অধিক গুরুত্ব প্রদান করবে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। সরকারি-বেসকারি নির্বিশেষে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় হবে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত; এসব প্রতিষ্ঠান পাণ্ডিত্য ও প্রশাসনিক দক্ষতাসম্পন্ন উপাচার্য দ্বারা পরিচালিত হবে।

যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকের জন্য যথাযথ সম্মানজনক জীবনযাপনের ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। সর্বস্তরের শিক্ষক ও শিক্ষা-কর্মকর্তাগণের আর্থিক সক্ষমতা ও মর্যাদা হবে উচ্চমানের।

এসব লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব যদি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাই আরেকটু যত্নবান হই। যেমন: সব স্কুল-কলেজে, বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা যাতে আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষালাভ করে; তারা যেন বিদ্যালয়ে সময় কাটাতে পছন্দ করে-- সে জন্য যথাযথ উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিতে হবে।

আশার কথা, এরই মধ্যে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সব মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থায় একই পাঠ্যক্রম চালু হয়েছে। অর্থাৎ, এর মধ্যে মাদ্রাসাও অন্তর্ভুক্ত। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতে একই পাঠ্যক্রম ইংরেজি ভাষায় (ভার্সন) পড়ানো হচ্ছে।

তবে বিদেশি কারিকুলামনির্ভর শিক্ষপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এটি কার্যকর হচ্ছে কি না, তা তদারিকসহ নানা বিষয়ের অনিয়ম দূর করার লক্ষ্যে ‘শিক্ষা আইন’ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এমন একটি আইন গত তিন বছর ধরে ঝুলে আছে, সেটি আলোর মুখ দেখছে না। আশা করি, শিগগিরই এ বিষয়ে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।

আর শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান বৈষম্য দূর করতে হবে, বিশেষ করে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, যেমন: ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, দলিত, চা-শ্রমিক ইত্যাদি সম্প্র্রদায়ের ছেলেমেয়েরাও যাতে একই মানের শিক্ষার সুযোগ পায়, সবাই একইভাবে অগ্রসর হয়, সে জন্য তাদের বিশেষ সুবিধা দিতে হবে; সেটা সম্প্রদায় ভেদে ভিন্ন হতে পারে। একই সঙ্গে আর্থিক প্রণোদনাও দিতে হবে তাদের।

অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাস-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সমর্থনকারী বা উদ্যোক্তাদের চিহ্নিত করে সন্ত্রাস তথা জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন করতে হবে। আমার বিশ্বাস, কোনো প্রতিষ্ঠানই জঙ্গিবাদের প্রশ্রয় দেয় না। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের এক-দুইজন ব্যক্তি হয়তো টার্গেট করে কিছু সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীকে বিপথে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। তাই কড়া নজরদারির মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের হাতে সোপর্দ করার বিকল্প নেই।

বিদ্যমান সৃজনশীল ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। অবশ্যই আমাদের সৃজনশীল মানুষ গঠন করতে হবে। তার জন্য দরকার সত্যিকারের সৃজনশীল পদ্ধতি। এ জন্য শিক্ষকদের নিবিড় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে।

প্রচলিত পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা হ্রাস করে প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একটি চালু করা যেতে পারে; বড়জোর দুটো পরীক্ষা থাকতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই এর বেশি নয়।

অনুলিখন: হাসান ইমাম