বিজ্ঞান শিক্ষার গুণগত মান বাড়বে

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Oct 2016, 07:37 PM
Updated : 23 Oct 2016, 11:04 AM

বাংলাদেশ বিজ্ঞান শিক্ষার সামগ্রিক প্রেক্ষাপট আরও অনেক ভালো হওয়ার কথা ছিল। কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে একজন ছেলে বা মেয়ে বিজ্ঞান শিখবে সেটি মোটেও সত্যি নয়-- বিজ্ঞান শেখা কিংবা বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার ব্যাপারটি শুরু হয় খুবই শৈশব থেকে। আমরা আমাদের শিশুদের ‘Analytic’  হতে শেখাই না,  যুক্তিতে কোনটা টিকে কোনটা টিকে না সেই দক্ষতাটা তৈরি করি না। তাদের তথ্য দিয়ে ভারাক্রান্ত করে দিই, তথ্যটি গ্রহণযোগ্য কি না, তথ্যটি নিয়ে প্রশ্ন করা যায় কি না, সেই বিষয়টি শিশুদের শেখাই না। কাজেই তারা বিশ্লেষণধর্মী একটা মন নিয়ে বড় হয় না। সে জন্যে খুবই শৈশব থেকে তাদের একটা Analytic মন নিয়ে বড় করতে হবে।

প্রাইমারি ক্লাশের বিজ্ঞান বইয়ে অনেক তথ্য এবং নিজের হাতে করার মতো অনেক এক্সপেরিমেন্ট থাকে কিন্তু ছেলে-মেয়েরা তথ্যটা মুখস্থ করে রাখে, হাতে-কলমে করার বিষয়টি চেষ্টা করার সুযোগ পায় না। কারণ বেশির ভাগ সময়েই শিক্ষকেরা সচেষ্ট হন। উদাহরণ দেওয়ার জন্যে বলা যায়, একজন শিক্ষক বোর্ডে একটা গাছ এঁকে তার মূল এবং কাণ্ড দেখিয়ে দেন কিন্তু ক্লাশরুমের বাইয়ে নিয়ে সত্যিকারের একটা গাছ দেখিয়ে নিজের চোখে মূল এবং কাণ্ড চিনিয়ে দিতে আগ্রহী হন না কিংবা এর প্রয়োজন আছে, সেটাও মনে করেন না। বাচ্চারা খুব আনন্দের সাথে নানা ধরনের প্রজেক্ট করতে চায়, কিন্তু তাদের সেই সুযোগ দেওয়া হয় না।

মাধ্যমিক পর্যায়ে অবস্থার খুব পরিবর্তন হয় না, বিজ্ঞান শাখায় প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা থাকলেও কোনো রকম প্র্যাকটিক্যাল না করেই একজন ছাত্র বা ছাত্রী পুরো নম্বর পেয়ে যায়। কলেজে আজকাল খুব কম ক্লাশ হয়, বিজ্ঞান বিষয়টা কঠিন-- সেই অজুহাতে কোচিং প্রাইভেট কিংবা গাইড বইয়ের আশ্রয় নেয়।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষার সাথে সাথে বিজ্ঞানের গবেষণার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, কিন্তু বিজ্ঞান শিক্ষার জন্যে যথেষ্ট পরিশ্রম করা হলেও গবেষণায় বিষয়টি এখনও সেভাবে শুরু হয়নি। কাজেই সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারটি এখনও সেরকমভাবে আশাব্যঞ্জক বলা যাবে না।

তবে আমি খুব আশাবাদী মানুষ, আমি সবকিছুকেই ইতিবাচকভাবে দেখতে চাই। বিজ্ঞান শিক্ষার এই সমস্যাগুলো মোটেও শুধু আমাদের দেশের জন্য নয়, এটি সারা পৃথিবীর জন্যেই সত্যি। নানা কারণেই বিজ্ঞান শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থীরা সারা পৃথিবীতেই সরে আসতে শুরু করেছে।

আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী, কারণ এই দেশে প্রায় চার কোটি ছেলে এবং মেয়ে স্কুল কলেজে লেখাপড়া করে। তাদের একটি অংশ অতীতেও সবরকম প্রতিকূল অবস্থাতেও লেখাপড়া করে গেছে, ভবিষ্যতেও করবে। বিজ্ঞান শিক্ষার মূল যে সমস্যাগুলো, সেগুলো খুঁজে বের করা হয়েছে। সমস্যা খুঁজে পাওয়া সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ, সদিচ্ছা থাকলে বাকিটুকু করে ফেলা যায়। সারা দেশে লেখাপড়া নিয়ে যে সচেতনতা তৈরি হয়েছে, সেটি আমাদের সমস্যার সমাধান করতে নিশ্চয়ই সাহায্য করবে। তা ছাড়া স্কুল কলেজের লেখাপড়ার পাশাপাশি নানা ধরনের অলিম্পিয়াড ও ছেলে-মেয়েদের মেধা বিকাশ করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে-- কম হলেও এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা।

২.

পাঠ্যপুস্তকগুলো সবার আগে ঠিক করতে হবে। বিজ্ঞানের এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। বিজ্ঞান শেখার জন্যে ইন্টারনেট খুব চমৎকার একটি মাধ্যম, ছেলে-মেয়েদের সোশ্যাল নেটওয়ার্কের শেকল থেকে মুক্তি নিয়ে সত্যিকারের তথ্য খুঁজে বের করার কালচারে প্রবেশ করতে হবে।

৩.

হ্যাঁ, আমি আশাবাদী যে, এই উদ্যোগগুলো নেওয়া হবে।

৪.

শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অনেক শিক্ষাবিদের সাথে যোগাযোগ করে এই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করা হয়েছে। আমি আশা করছি, এই উদ্যোগটি থেমে থাকবে না। কারণ, সরকার খুব ভালো করে জানে শিক্ষার জগতে সংখ্যা অনেক বেড়ে গেলেও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শিক্ষার গুণগত মান না বাড়ানো পর্যন্ত অন্য কোনো কিছু করা সম্ভব নয়।