‘যে ৫ কারণে’ বিজয়ী ট্রাম্প

একবছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থিতার জন্য প্রচারণা শুরুর পর থেকেই সব ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Nov 2016, 09:56 AM
Updated : 10 Nov 2016, 11:53 AM

তিনি যে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী দৌড়ে থাকবেন সেটা খুব কম লোকেই ভেবেছিল, কিন্তু তিনি এই দৌড়ে ভালোভাবেই ছিলেন। লোকজন ভেবেছিল, তিনি ভোট পর্যন্ত টিকতে পারবেন না, তিনি টিকলেনও।

তারা ভেবেছিল, কোনো প্রাইমারিতেও তিনি জিততে পারবেন না, কিন্তু তিনি পারলেন। রিপাবলিকান পার্টি তাকে মনোনয়ন দেবে না বলেও তারা মনে করেছিল, তাদের মনোবাঞ্ছা হয়নি।
 

তারা এমনও ভেবেছিল যে নির্বাচনে জেতা তো দূরের কথা তার পক্ষে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাই সম্ভব না।

কিন্তু এতো জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বেলা শেষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন ট্রাম্পই।

অনেকের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত এই জয়ের পেছনে কী কারণ কাজ করেছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

তাতে বলা হয়, এমন পাঁচটি উপায়ে তিনি নির্বাচনে জিতেছেন, যা ছিল অনেকের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুর্বোধ্য।

এগুলো হলো- ট্রাম্পের ‘শ্বেত জোয়ার’, বিতর্ক ও কেলেঙ্কারির পরেও অবিচল থাকা, রাজনীতিতে ‘বহিরাগত’ হয়েও কাউকে পাত্তা না দেওয়া, হিলারির ই-মেইল নিয়ে এফবিআই পরিচালক জেমস কোমির তৎপরতা এবং নিজের ধারণার উপর ট্রাম্পের আস্থা।

ট্রাম্পের ‘শ্বেত জোয়ার’

সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে একের পর এক হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের রাজ্যগুলো চলে গেল ট্রাম্পের দখলে। হিলারি ক্লিনটনের ব্লু ফায়ারওয়াল ভেদ করে এই বিজয় ছিনিয়ে নিলেন ট্রাম্প।

মধ্যপশ্চিমাঞ্চলে হিলারির শক্তির উপরই ডেমোক্রেটদের শেষ ভরসা ছিল। মূলত সাদাদের মধ্যে শ্রমিক শ্রেণির এবং কালো ভোটারদের উপর ভিত্তি করে ওই রাজ্যগুলোতে কয়েক দশক ধরে গেঁড়ে বসেছিল ডেমোক্র্যাটরা। 

এবার ওই সব সাদা শ্রমিকরা- বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোঁড়া না পেরোনো সাদা শ্রমিকরা দল বেঁধে ডেমোক্র্যাট পার্টিকে পরিত্যাগ করেছে।

ভোট পড়েছে বেশি গ্রামীণ মানুষের, যারা কায়েমি শক্তির কাছে নিজেদের অবহেলিত বোধ করেছেন এবং ঊপকূলীয় অভিজাতদের পেছনে পড়ে রয়েছিলেন বহু বছর ধরে। ট্রাম্পের কণ্ঠে নিজেদের আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন তারা।

ভার্জিনিয়া ও কলোরাডোর মতো জায়গায় ডেমোক্র্যাটদের ঘাঁটি শক্ত থাকলেও উইসকনসিনের পতন হয়েছে; সঙ্গে মিসেস ক্লিনটনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্নও।

যেসব জায়গায় দরকার ছিল, সেগুলোতে জোরালো আঘাত হেনেছে ট্রাম্প-জোয়ার।

বিতর্কেও লড়াইয়ে সফল

ট্রাম্প যুদ্ধফেরত সাবেক সেনা কর্মকর্তা জন ম্যাককেইনকে অপমান করেছেন; ফক্স নিউজ ও এর জনপ্রিয় উপস্থাপক মেগান কেলির সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়েছেন।

শিরোপাজয়ী হিস্পানিক সুন্দরীর ওজন নিয়ে কীভাবে মশকরা করেছেন, তা জানতে চাইলে ট্রাম্প বিপুল উদ্যমে আরও বাড়িয়ে বলেছেন।

নারীদের প্রতি নিজের অভদ্রোচিত যৌন আচরণের বিষয়ে তার হাস্যরসমূলক কথাবার্তার গোপন ভিডিও প্রকাশ পাওয়ার পর যেভাবে ক্ষমা চেয়েছেন, তাকে অনিচ্ছাকৃতই মনে হয়েছে।

কিন্তু এসব কোনো কিছুই তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সম্ভবত এসব বিতর্ক এতো শক্ত ও দ্রুতগতির ছিল যে সেগুলো রক্তক্ষরণের সুযোগ পায়নি।

সম্ভবত ট্রাম্পের ব্যক্তিত্ব ও আবেদন এতোটাই জোরালো ছিল, যে ওই সব কেলেঙ্কারি তার গায়ে বাড়ি খেয়ে ফিরে গেছে।

কারণ যা-ই হোক, ট্রাম্প ছিলেন ‘বুলেটপ্রুফ’।

‘রাজনৈতিক অভিজাতদের’ বিরুদ্ধে একা 

আবাসন ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে শুধু নয় নিজের দলের যারা ক্ষমতাসীন তাদের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছেন এবং সবাইকে পরাস্ত করেছেন।

প্রাইমারিতে নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মার্কো রুবিও, টেড ক্রুজ ও জেব বুশসহ দলের সুপরিচিত অনেক নেতাকে পথ থেকে তিনি হটাতে পেরেছেন, যাদের কেউ কেউ তার বশ্যতা স্বীকার করেছেন। কেউ কেউ এখন দলের যোগাযোগেই নেই।

এমনকি হাউজ স্পিকার পল রায়ান থেকে শুরু করে দলের বাকি নেতাদেরও সহায়তা লাগেনি তার। বাস্তবে হয়তো তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার দৃঢ়তাই হয়তো তাকে জিতিয়ে দিয়েছে।

কাউকে ‘পাত্তা না দেওয়ার’ ট্রাম্পের এই মনোভাব তার স্বাতন্ত্র্য ও বহিরাগত অবস্থান এমন সময়ে প্রকাশ করেছে যখন বেশিরভাগ আমেরিকান ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক অভিজাতদের প্রতি ক্ষুব্ধ।

এই মনোভাব ডেমোক্র্যাট বার্নি স্যান্ডার্স ও টেড ক্রুজের মতো আরও কয়েকজন জাতীয় রাজনৈতিক ধরতে পেরেছিলেন। তবে হোয়াইট পর্যন্ত যাওয়ার জন্য ট্রাম্প ছাড়া আর কেউ এটাকে কাজে লাগাতে পারেনি।

কোমি ফ্যাক্টর

নির্বাচন নিয়ে বিশেষ করে, মধ্যপশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলোর অবস্থা নিয়ে জরিপগুলোর আভাস ছিল দুঃখজনক। অবশ্য শেষ দিকে এসে ট্রাম্পের বিজয় পথ নিয়ে জরিপগুলো কাছাকাছিই ছিল।

তবে দুই সপ্তাহ আগেও ট্রাম্পের এই বিজয়ের পথ ততোটা স্পষ্ট ছিল না। হিলারির ব্যক্তিগত ইমেইল সার্ভারের বিষয়ে এফবিআই পরিচালক জেমস কোমি নতুন করে তদন্তের কথা ঘোষণা করার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়।

জরিপে জোরালো প্রতিযোগিতার আভাস থাকলেও কোমির ওই চিঠি এবং পরে তদন্ত শেষ হলে দেওয়া চিঠির এই সময়ের মধ্যেই ট্রাম্প শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন। অন্যদিকে হিলারির প্রেসিডেন্ট হওয়ার আশা ধূসর হয়েছে।

তবে অবশ্যই কোমির এই তৎপরতা হিলারির জন্য কাল হয়ে দাঁড়াত না, যদি তিনি সরকারি কাজে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মেইল সার্ভার ব্যবহার করতেন। এটা পুরোটাই তার নিজের দায়।

নিজের ধারণায় আস্থা

ট্রাম্প এ যাবতকালের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক প্রচারণা চালালেও প্রমাণ করেছেন, তিনি সব অভিজ্ঞদের চেয়ে ভালো জানেন।

তিনি নির্বাচনী পর্যালোচনার চেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন হ্যাট বিক্রিতে; সফর করেছেন উইসকনসিন ও মিশিগানের মতো রাজ্যগুলো, যেগুলোকে পণ্ডিতরা দুর্গম বলেছিল।

মানুষের দ্বারে দ্বারে না গিয়ে তিনি বড় বড় সমাবেশ করে ভোটারদের ঘর থেকে বের করে এনেছেন।

তার জাতীয় রাজনৈতিক সমাবেশ ছিল অসংগঠিত, যার চেয়ে অগোছালো কোনো সমাবেশ আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়নি।

নির্বাচনে ক্লিনটন শিবিরের চেয়ে অনেক কম খরচ করেছেন তিনি। একই অবস্থা ছিল প্রাইমারির ক্ষেত্রেও। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কীভাবে জিততে হয় তা নিয়ে প্রচলিত ধারণাই পাল্টে দিয়েছেন তিনি। তার এসব ধারণা ‘বিজ্ঞদের’ কাছে হাসিঠাট্টার খোরাক হয়েছিল।

তবে দিন শেষে তার এসব ধারণাই কাজে দিয়েছে। ট্রাম্প এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু- তার সন্তান ও কতিপয় মনোনীত উপদেষ্টারাই- শেষ হাসি হাসবেন। এবং সেটা হোয়াইট হাউজের ভেতর থেকেই।