ট্রাম্প টাওয়ার থেকে হোয়াইট হাউজ

আমেরিকাকে ‘শ্রেষ্ঠত্বের’ মুকুট ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ভোটারদের সামনে হাজির হওয়ার অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিনত দেশটির সবচেয়ে রঙদার, সবচেয়ে জাঁকালো ধনকুবের হিসেবে।

মীর মোশাররফ হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Nov 2016, 02:35 AM
Updated : 9 Nov 2016, 01:02 PM

কয়েক বছর আগে ঘনিষ্ঠরাও ভাবতে পারেননি, ব‌্যবসায়ী ট্রাম্প ৭০ বছর বয়সে এসে আমেরিকার রাজনীতির একেবারে কেন্দ্রে আবির্ভূত হবেন।

রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী আর অধিকারকর্মীদের এতোটা অনাস্থা নিয়ে, একের পর এক যৌন হয়রানির অভিযোগ সামাল দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব কি না- সে প্রশ্নও ছিল।

অভিবাসী, মুসলমান ও নারীদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব‌্যের কারণে রিপাবলিকান পার্টির অনেক রথি-মহারথি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন ট্রাম্পের দিক থেকে। বিশ্ব নেতাদের অনেকেই ভোটের আগে তাকে নিয়ে বলেছিলেন উদ্বেগের কথা।

শ্বেতাঙ্গ অধিপত‌্য ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখিয়ে, শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনকে টেক্কা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে সেই ট্রাম্প পৌঁছে গেছেন হোয়াইট হাউজে।

শৈশবের ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: ডোনাল্ড ট্রাম্প ক‌্যাম্পেইন

ধনীর দুলাল

নিউ ইয়র্কের রিয়েল এস্টেট ব‌্যবসায়ী ফ্রেডরিক ট্রাম্পের পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ ডোনাল্ড; ১৯৪৬ সালের ১৪ জুন কুইন্সে তার জন্ম।

বাবা ফ্রেডরিক কুইন্স, স্টাটান আইল্যান্ড আর ব্রুকলিন এলাকায় সাধারণ মধ্যবিত্তদের জন‌্য অ্যাপার্টমেন্ট বানাতেন। অভিবাসীবিরোধী ইমেজ গড়ে তোলা ট্রাম্পের মা একজন স্কটিশ বংশোদ্ভূত; ছুটিতে নিউ ইয়র্ক বেড়াতে এসে ফ্রেডরিকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তার।

ধনীর ঘরে জন্ম নিলেও ছোটবেলায় বাবার প্রতিষ্ঠানে সর্বনিম্ন-স্তরে কাজ করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন ডোনাল্ড। ছোটবেলা থেকেই পরিচিতি পান উদ্যমী আর আগ্রাসী হিসেবে। স্কুলে বেয়ারাপনার ধারাবাহিক অভিযোগের মধ‌্যে ১৩ বছর বয়সে তাকে পাঠানো হয় সামরিক অ্যাকাডেমিতে।

অ্যাকাডেমিতে উদীয়মান অ্যাথলেট ও ছাত্রনেতা হিসেবে নজর কাড়েন ট্রাম্প। ১৯৬৪ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ভর্তি হন ফোর্ডহ‌্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই বছর পর ট্রান্সফার হন পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির হোয়ারটন স্কুল অব ফাইন্যান্সে। ১৯৬৮ সালে সেখান থেকেই অর্থনীতিতে ডিগ্রি নেন।

কলেজে থাকার সময় পড়াশোনার অজুহাতে একবছর এবং পরে আরও এক বছর চিকিৎসাকালীন ছুটি নিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন ট্রাম্প। তবে গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বাবার প্রতিষ্ঠানে ঠিকই সময় দিতেন তিনি।

মিলিটারি একাডেমিতে ট্রাম্প। ছবি: নিউ ইয়র্ক মিলিটারি একাডেমি ফেইসবুক

এলিজাবেথ ট্রাম্প অ‌্যান্ড সন্স কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার আগে ট্রাম্প তার বাবার কাছ থেকে ১০ লাখ ডলার ধার করে নিজেই রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু করেন। বড় ভাই ফ্রেড পাইলট হওয়ার পথে গেলে বাবার ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে আসে ডোনাল্ডের হাতে। অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনের কারণে ৪৩ বছর বয়সেই মারা যান ফ্রেড।

পরে বাবার সঙ্গে ব্যবসা করতে গিয়ে নিজের ব‌্যবসার বিস্তৃতিও বাড়িয়ে তোলেন ট্রাম্প। গ্র্যাজুয়েশনের পর ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা বাড়ানোর ব্যাপারে বাবাকে রাজি করান তিনি।

১৯৭১ সালে ট্রাম্প কোম্পানির নাম বদলে হয় ‘ট্রাম্প অর্গানাইজেশন’। ১৯৯৯ সালে ট্রাম্পের বাবা মারা যান। ডোনাল্ড সে সময় বলেছিলেন, বাবাই ছিল তার অনুপ্রেরণা।

পারিবারিক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ বুঝে নেওয়ার পর ব্রুকলিন ও কুইন্স থেকে প্রকল্প সরিয়ে ম্যানহাটানে বড় বড় ভবন নির্মাণে নজর দেন ট্রাম্প। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে।

ম্যানহাটানের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে সেখানে বিনিয়োগ বাড়াতে থাকেন ট্রাম্প। চমৎকার নির্মাণশৈলী ও জনগণের আস্থার কারণে সেই কাজগুলোই পরে তাকে বিপুল মুনাফা এনে দেয়।

পেনসিলভানিয়া সেন্ট্রাল রেইলরোড কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেলে ট্রাম্পের হাতে ম্যানহাটানের পশ্চিমে রেলের জমি কেনার সুযোগ তৈরি হয়। তুলনামূলকভাবে গরিব ওই এলাকায় অ্যাপার্টমেন্ট ব‌্যবসায় লাভের আশা না থাকায় ট্রাম্প সেখানে কনভেনশন সেন্টার নির্মাণের প্রস্তাব দেন। ১৯৭৮ সালে শহর কর্তৃপক্ষ আরও দুটি জায়গার সঙ্গে সেখানেও কনভেনশন সেন্টার নির্মাণের অনুমতি দেয়।

১৯৭৫ সালে বাবার ফ্রেড ট্রাম্পের সঙ্গে ডোনাল্ড। ফেইসবুক/ডোনাল্ড ট্রাম্প

ট্রাম্প ওই কনভেনশন সেন্টার নিজের পরিবারের নামে বানানোর আগ্রহ দেখান। তার প্রস্তাব ছিল, কর্তৃপক্ষ ‘ট্রাম্প’ নামটি নিলে তিনি নির্মাণ কাজের ফি নেবেন না। কিন্তু তার সেই প্রস্তাব খারিজ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। ওই কনভেনশন সেন্টারের নামকরণ হয় সিনেটর জ্যাকব জাভিটসের নামে।

ব্যবসা করতে গিয়ে ট্রাম্প প্রথম প্রশ্নের মুখোমুখি হন ১৯৭৩ সালে। ওই বছর রাজ্য সরকার ট্রাম্প, তার বাবা ও তাদের কোম্পানির বিরুদ্ধে জাতিবিদ্বেষের অভিযোগ আনে।

অভিযোগে বলা হয়, ট্রাম্পের কোম্পানি ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে জাতিগত বৈষম্য করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফেয়ার হাউজিং অ্যাক্টের’ স্পষ্ট লঙ্ঘন। ট্রাম্প অবশ্য বরাবরই সে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর ১৯৭৫ সালে ট্রাম্পের কোম্পানির সঙ্গে রফায় আসে রাজ্য সরকার। ট্রাম্প তার কর্মচারীদের ফেয়ার হাউজিং অ্যাক্টের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়ার এবং তাদের অ‌্যাপার্টমেন্টগুলোতে ফেয়ার হাউজিং প্র্যাকটিস নিয়ে প্রচার চালানোর শর্ত মেনে নেন।

১৯৮৭ সালে ট্রাম্পের আত্মজীবনী ‘আর্ট অব দ্য ডিল’-এ ওই ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন ট্রাম্প। তবে তা লেখা হয়েছে তার একান্ত নিজস্ব স্টাইলে- “শেষ পর্যন্ত সরকার ওই মামলা প্রমাণ করতে পারেনি। আর আমরা শেষ করেছিলাম ক্ষুদ্র একটা বন্দোবস্তের মধ‌্য দিয়ে, এবং অবশ্যই দায় স্বীকার না করে।”

ওই মামলা চলার সময়ই ট্রাম্প গ্র্যান্ড হায়াত হোটেল নির্মাণে হাত দেন। ম্যানহাটানের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছে পেন সেন্ট্রাল কোম্পানির কমোডোর হোটেল তখন লোকসানে চলছিল। ১৯৭৫ সালে ট্রাম্প হায়াত হোটেল কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করে সেখানে নতুন হোটেল নির্মাণের কাজ শুরু করেন। হায়াত চেইনের তখনো কোনো বড় হোটেল ছিল না। দের স্কাটের নির্মাণ শৈলীতে ট্রাম্প সেখানে নির্মাণ করেন দৃষ্টিনন্দন এক কাচের দালান।

ভাই বোনদের সঙ্গে ট্রাম্প। ছবি: ডোনাল্ড ট্রাম্প ক‌্যাম্পেইন

১৯৮০ সালে গ্র্যান্ড হায়াত হোটেল খুলে দেওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। লোকসানি একটি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসায়িক সাফল‌্য এনে দেওয়ায় ট্রাম্পের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৭৯ সালে ট্রাম্প ম্যানহাটানের ফিফথ অ্যাভেনিউয়ের বিখ্যাত জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান টিফানি অ্যান্ড কোম্পানির অফিস সংলগ্ন এলাকায় জমি ইজারা নিয়ে ২০ কোটি ডলারের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স নির্মাণে হাত দেন।

ওই কমপ্লেক্স ১৯৮২ সালে উন্মুক্ত হয়, যার নাম পরে হয় ট্রাম্প টাওয়ার। ৫৮ তলা ওই ভবনে রয়েছে ৮০ ফুট দীর্ঘ একটি কৃত্রিম ঝর্ণা। বিলাসবহুল এ ভবন ব্যবসায়ী ও সেলিব্রেটিদেরও আগ্রহী করে তোলে।

১৯৭৭ সালে নিউ জার্সিতে জুয়ার ব্যবসা আইনি বৈধতা পেলে সেখানে টাকা ঢালেন ট্রাম্প। ১৯৮০ সালে তিনি আটলান্টিক সিটিতে জমি কেনেন। হলিডে ইন কর্পোরেশনের অংশীদারিত্বে ১৯৮৪ সালে সেখানে নির্মাণ করেন ২৫ কোটি ডলারের ট্রাম্প প্লাজা। কিছুদিন পর হলিডে ইনের শেয়ার কিনে নেন এবং ওই প্লাজায় নির্মাণ করেন হোটেল ও ক্যাসিনো।

আটলান্টায় হিলটন হোটেলের ক্যাসিনো-হোটেলটিও কিনে নেন ট্রাম্প; ৩২ কোটি ডলার খরচ করে গড়ে তোলেন ট্রাম্প ক্যাসল।

অল্প সময়ের মধ‌্যে ট্রাম্পের হাতে আসে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ক্যাসিনো হোটেল তাজমহল। ১৯৯০ সালে সেটি ট্রাম্প তাজমহল হোটেল নামে যাত্রা শুরু করে।

অর্থনৈতিক সংকট ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে চলতি বছর ট্রাম্প তাজমহল বন্ধের ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ। গত মার্চে লাইসেন্স নবায়নের সময় ট্রাম্প তার হাতে থাকা শেয়ার কার্ল আইকানের কাছে বিক্রি করে দেন।

ছবি: রয়টার্স

আটলান্টিক সিটিতে বড় বড় সব নির্মাণ কাজের সময় ট্রাম্প নিউ ইয়র্কেও বারবাইজন প্লাজা হোটেল ও সেন্ট্রাল পার্কে জমি কিনে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। তাতে ওই এলাকায় বাড়ি ভাড়া বেড়ে যাবে আশঙ্কা করে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো জোট বেঁধে আদালতে যায়। আদালত স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষেই রায় দেয়। পরে ট্রাম্প বারবাইজন প্লাজা হোটেল সংস্কার করেন এবং নাম দেন ট্রাম্প পার্ক।

১৯৮৫ সালে ম্যানহাটানের পশ্চিম পাশে ৭৬ একর জমি কিনে সেখানে টেলিভিশন সিটি নামে একটি কমপ্লেক্স বানানোর ঘোষণা দেন ট্রাম্প। ডজনের উপর সুউচ্চ ভবন, একটি মল ও নদীমুখী পার্ক নির্মাণের এ পরিকল্পনা প্রযোজনা সংস্থা ও টেলিভিশন কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করে তুললেও এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে প্রকল্পটি ঝুলে যায়।

১৯৮৮ সালে ট্রাম্প ৪০ কোটি ৭০ লাখ ডলারে প্লাজা হোটেলটি কিনে নেন এবং আরও পাঁচ কোটি ডলার খরচ করে তা ঝকঝকে করে তোলেন।

দক্ষিণাঞ্চলে সাম্রাজ্য গড়ার সময় ট্রাম্প ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পাম বিচেও একটি বিলাসবহুল প্রকল্পের কাজ শেষ করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ৩৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারে ইস্টার্ন এয়ারলাইনস শাটলের একটি শাখা কিনে নেন, পরে যার নাম হয় ট্রাম্প শাটল। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ ট্রাম্প ১৯৯২ সালে ওই কোম্পানি বিক্রি করে দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে মুম্বাই, ইস্তাম্বুল ও ফিলিপিন্সেও ট্রাম্প টাওয়ারের শাখা আছে। তার বিভিন্ন হোটেল ও ক্যাসিনো চারবার দেউলিয়ার খাতায় তার নাম তুললেও বৃহস্পতি ট্রাম্পকে ছেড়ে যায়নি।

ছবি: রয়টার্স

১৯৯০ এর জানুয়ারিতে ট্রাম্প লস অ্যাঞ্জেলসে একশ কোটি ডলারের একটি প্রকল্পের ঘোষণা দেন, যেখানে ১২৫ তলা একটি সুউচ্চ অফিস ভবন থাকবে। ওই সময় আবাসন ব্যবসায় বিরাট ধস নেমেছিল, যা থেকে আয় কমে যাচ্ছিল ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের।

সে সময়ে নিজের সম্পদের পরিমাণ দেড়শ কোটি ডলার বলে দাবি করেছিলেন ট্রাম্প, যদিও ফোর্বসের তখনকার এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, এ কোটিপতির ঋণের পরিমাণও ৫০ কোটি ডলারের কম হবে না।

ট্রাম্প অর্গানাইজেশন যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রচুর পরিমাণ ঋণ নিতে থাকে যা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে এবং ছোট ছোট আবাসন কোম্পানিকে ধসিয়ে দিতে ভূমিকা রাখে বলেও সে সময় অভিযোগ ওঠে।

ওই দশকে ৯০ কোটি ডলার ঋণের বাধা কাটিয়ে দুইশ কোটি ডলারের সম্পদ গড়ে তোলেন বলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি। তবে স্বতন্ত্র গবেষকরা ওই অংক মানতে নারাজ। তাদের ধারণা, ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ট্রাম্পের সম্পদের পরিমাণ কোনোভাবেই ৫০ কোটি ডলারের বেশি হবে না।

২০০০ সালে সুউচ্চ একটি ভবন নির্মাণে আদালতের বাধা অতিক্রম করে আবারও শিরোনামে আসেন ব্যবসায়ী ট্রাম্প।

অন্য নির্মাতারা অভিযোগ করে বলেছিলেন- ৮৫৬ ফুট উঁচু ওই ভবন শহরের নির্মাণবিধি লঙ্ঘন করছে। তাদের দাবির মুখে নগর কর্তৃপক্ষও নির্মাণবিধি সংশোধন করে এ ধরনের উঁচু ভবন নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু আদালতের রায় ছিল ট্রাম্পের পক্ষে, তার সেই ভবন নির্মাণ আটকানো যায়নি।

ছবি: রয়টার্স

এক সময় বিনোদন জগতেও সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১৯৯৬ সাল থেকে পরবর্তী দুই দশক তার কোম্পানির ঝুলিতে জমা পড়ে মিস ইউনিভার্স, মিস ইউএসএ ও মিস টিন ইউএসএ প্রতিযোগিতা আয়োজনের কৃতিত্ব।

২০০৪ সালে এনবিসি টেলিভিশনে ‘দ্য অ্যাপ্রেন্টিস’ নামে একটি রিয়েলিটি শো শুরু করেন ট্রাম্প, যেখানে প্রতিযোগীদের পুরস্কার ছিল ট্রাম্পের প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপকের চাকরি। টানা ১৪টি সিজন ওই শো উপস্থাপনা করেন ট্রাম্প। সেই প্রতিযোগিতা তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২১ কোটি ৩০ লাখ ডলার এনে দিয়েছিল।

ওই সময়ই ট্রাম্পের কণ্ঠের ‘ইউ আর ফায়ারড’ ডায়ালগটি বেশ আলোচিত হয়ে ওঠে। দ্য অ্যাপ্রেন্টিস বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার সংগ্রহ করেছিল বলেও রিপাবলিকান নির্বাচনী শিবিরের দাবি।

অ্যামি পুরস্কারের জন্য মনোনীত ট্রাম্প বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন। তার রয়েছে একটি চেইন শপের ব্যবসা- বিশ্বজুড়ে টাই থেকে শুরু করে বোতলজাত পানি বিক্রি করছে ওই কোম্পানি।

ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী, এ ধনকুবেরের সম্পদের পরিমাণ বর্তমানে ৩৭০ কোটি ডলারের উপরে। ট্রাম্প অবশ‌্য দাবি করেন, ওই অংক কোনোভাবেই হাজার কোটি ডলারের কম হতে পারে না।

ভোটে জয়ের পর ট্রাম্প পরিবার। ছবি: রয়টার্স

ভোটে জয়ের পর স্ত্রী মেলানিয়ার সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প ছবি: রয়টার্স

পিতা ও স্বামী

যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি বয়সী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ পর্যন্ত বিয়ে করেছেন তিনবার। তার ভাষায়, প্রথম স্ত্রী চেক অ্যাথলেট ও মডেল ইভানা জেলনিকোভা উইঙ্কেল মেয়ারই ছিলেন তার কাছে সবচেয়ে ‘প্রিয়’। নিউ ইয়র্কের ফ্যাশন মডেল ইভানা ১৯৭২ সালের চেক অলিম্পিক দলের স্কি টিমে ছিলেন।

ইভানা ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন; গ্র্যান্ড হায়াত হোটেল ও প্লাজা হোটেল সংস্কারেও তার ভূমিকা ছিল। এ দম্পতির তিন সন্তান- ট্রাম্প জুনিয়র, ইভাঙ্কা ও এরিক। ১৯৯০ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়।

বিচ্ছেদ নিয়ে মীমাংসার সময় বিভিন্ন ট্যাবলয়েড এ দম্পতিকে নিয়ে নানা মুখরোচক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এর মধ্যে ছিল ইভানাকে যৌন নির্যাতন ও অবমাননার অভিযোগ। ইভানা অবশ্য বলেছেন, সেসব প্রতিবেদন ‘সত্য নয়’।

১৯৯৩ সালে মডেল মার্লা ম্যাপলসকে বিয়ে করেন ট্রাম্প। ছয় বছর পর ২০ লাখ ডলারের বিচ্ছেদের আগে তাদের ঘরে আসে কন্যাসন্তান টিফানি।

মেলানিয়া নউসের সঙ্গে ট্রাম্পের বিয়ে হয় ২০০৫ সালে। সেই বিয়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অতিথি হয়েছিলেন এবারের নির্বাচনের ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ও তার স্বামী সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন।

বয়সে ২০ বছরের ছোট মেলানিয়ার ঘরে একটি ছেলে আছে ট্রাম্পের, তার নাম ব্যারন উইলিয়াম ট্রাম্প। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাতি-নাতনীর সংখ্যা ৭।

তিন সন্তান ডোনাল্ড জুনিয়র, ইভাঙ্কা ও এরিক ‘ট্রাম্প অর্গানাইজেশন’ এর নির্বাহী সহ-সভাপতি হিসেবে বাবাকে সাহায্য করেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী অবশ‌্য ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই।

ছবি: রয়টার্স

হাতির পিঠে হোয়াইট হাউজে

ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্নের কথা প্রথম বলেন ১৯৮৭ সালে। ১৯৯৯ সালে শুরু হয় তার চেষ্টা। তবে ক্যালিফোর্নিয়া প্রাইমারিতে রিফর্ম পার্টির হয়ে বাজে ভাবে হারার পর তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন।

২০০৮ সালে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ‘বার্থার’ আন্দোলনের জনপ্রিয় মুখপাত্রে পরিণত হন ট্রাম্প। ওই আন্দোলনে ওবামার জন্মস্থান নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রশ্ন তোলা হয়। ত্যক্ত বিরক্ত ওবামা এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে তার জন্মের সনদ প্রকাশ করেন।

এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নেমে চাপের মুখে আগের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ান ট্রাম্প। ওবামার জন্ম যে যুক্তরাষ্ট্রেই, এক বিবৃতিতে তিনি তা মেনে নেন। উল্টো বার্থার আন্দোলন শুরুর দায় দেন প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনকে। ২০০৮ সালে মনোনয়ন যুদ্ধের সময় হিলারি শিবিরই নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী ওবামার ‍বিরুদ্ধে প্রথম ওই অভিযোগ তুলেছিল, অন্তত ট্রাম্পের তেমনটাই দাবি।

২০১৫ সালের জুনে ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থীতা চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার মনোনয়ন দৌঁড়ে শামিল হন।

“সত্যিকার অর্থে আমাদের এমন একজন নেতা দরকার, যিনি দেশটিকে আবারও শ্রেষ্ঠ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে। আমরা চাইলেই সেটা করতে পারি,” নিজের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণায় এমনটাই বলেন ট্রাম্প।

২০১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দেওয়া ট্রাম্প দলের সবচেয়ে বড় দাতা ও তহবিল সংগ্রাহকে পরিণত হন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ২ কোটি ৫০ লাখের বেশি অনুসারী আছে।

‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ ব্যানারে ট্রাম্প আমেরিকার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা, মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তোলা এবং মুসলিম অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে সাময়িক নিষেধাজ্ঞার কথা বলে সমালোচিত হন ট্রাম্প। তারপরও তার জনসমর্থন ছিল অবাক করার মত। যার ফলে ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের প্রাইমারির পরপরই ট্রাম্পের প্রার্থিতা নিশ্চিত হয়ে যায়।

ট্রাম্পকে ব‌্যাঙ্গ করে রাস্তায় নাঙ্গা মূর্তি। ছবি: রয়টার্স

ওই সময়ের মধ্যে রিপাবলিকান দলের নেতা টেড ক্রুজ আর মার্কো রুবিও’র মত প্রার্থীরাও তাদের নাম প্রত্যাহার করে নেন। ১৯ জুলাই তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে হাতি প্রতীকের প্রার্থী ঘোষণা করে রিপাবলিকান পার্টি। তার সঙ্গে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হন মাইক পেন্স।

নারীদের প্রতি ট্রাম্পের ধারণা ‘বাজে’- ধারাবাহিকভাবে এমন দাবি করে আসছিল প্রতিদ্ব্ন্দ্বী ডেমোক্রেট শিবির। নির্বাচনের মাস দেড়েক আগে ফাঁস হওয়া একটি টেপ সেই দাবিকে সুসংহত করে।

ওই টেপে ট্রাম্প নারীদের বিষয়ে আপত্তিকর কথা বলেছিলেন। এক তারকাকে তিনি বলেছিলেন, খ্যাতিমানরা চাইলে নারীকে ‘ইচ্ছেমত’ ব্যবহার করতে পারেন।

ওই ভিডিওকে ট্রাম্প ‘লকার রুমের’ কথোপকথন বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। নিজের গা বাঁচাতে ঢাল বানানোর চেষ্টা করেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিলারির স্বামী বিলের কেলেঙ্কারিকে। ট্রাম্প বলেন, “আমি তো কেবল বলেছি, বিল ক্লিনটন তো করেই দেখিয়েছে।”

নির্বাচনের আগে হিলারির সঙ্গে মুখোমুখি বিতর্কের মধ‌্যেই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন বেশ কয়েকজন নারী। সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে ট্রাম্প বলেন, তাকে ফাঁসাতে হিলারি শিবির ও প্রভাবশালী কয়েকটি গণমাধ্যম ‘নাটক সাজিয়েছে’। অভিযোগ করা প্রত্যেক নারীকে আইনের আওতায় আনবেন বলেও হুমকি দেন তিনি।

প্রচারের বিভিন্ন সময় নারীদের নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্যসহ অনেক ইস্যুতে প্রভাবশালী অনেক রিপাবলিকান নেতা ও সিনেটর সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তায় সাময়িক ভাটা পড়ে।

তবে সেসব টপকে নির্বাচনের আগে আগে ইমেইল কেলেঙ্কারিতে পর্যদুস্ত হিলারির সঙ্গে ব্যবধান অনেকটাই কমিয়ে আনেন এই ধনকুবের। বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে ৮ নভেম্বর ভোটে জিতে তিনি হয়ে যান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।

বিপদের সময় প্রভাবশালী যে রিপাবলিকান সিনেটররা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, তাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ‌্যায়িত করে ট্রাম্প বলেছিলেন, নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি দেখিয়ে দেবেন, ‘কী করে জিততে হয়’।

শেয়ার বাজার আর ডলারের দরে ধস নামিয়ে, বিশ্বের বহু চিন্তাবিদকে আরও চিন্তায় ডুবিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প তা করে দেখিয়েছেন। 

তথ্যসূত্র: বিবিসি, সিএনএন, রয়টার্স, ডোনাল্ড ট্রাম্প ডটকম ও বায়োগ্রাফি ডটকম।