ভোট জালিয়াতি মামলায় পরাজিত হওয়ার পর আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বাদীদের খরচ বাবদ আড়াই লাখ পাউন্ড পরিশোধ না করায় মঙ্গলবার লণ্ডন হাই কোর্টর একজন বিচারক এই আদেশ দেন।
গত বছর টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি, ইমামদের দিয়ে ভোটে প্রভাব বিস্তার, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষের অপপ্রচার এবং সরকারি অর্থ দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল নির্বাচনী আদালত লুৎফরের মেয়র পদ শূন্য ঘোষণা করে পুনর্নির্বাচনের আদেশ দেয়। সেইসঙ্গে পাঁচ বছর লুৎফুরের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার উপর দেওয়া হয় নিষেধাজ্ঞা।
বিচারক রিচার্ড মাওরি ওই রায়ে চার বাদীর মামলার খরচ হিসাবে আড়াই লাখ পাউন্ড লুৎফুর তাৎক্ষণিকভাবে পরিশোধের নির্দেশ দেন।
ওই চার ভোটারের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফ্রান্সিস হওয়ার মঙ্গলবার হাই কোর্টকে জানান, আদালত আড়াই মাস আগে নির্দেশ দিলেও লুৎফুর এখনও কোনো অর্থ শোধ করেননি।
শুনানিতে লুৎফুরকে ‘একজন অসৎ ব্যক্তি’ হিসাবে উল্লেখ করেন বাদীপক্ষের এই আইনজীবী।
শুনানি শেষে বিচারক লুৎফুরের সম্পদ জব্দের নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি গত ৫ বছরে তার আয়-ব্যয়ের হিসাব এবং গত সাত বছরের আয়কর বিবরণীও দাখিল করার নির্দেশ দেন।
হাই কোর্টের এই শুনানিতে লুৎফুরের আইনজীবী এডওয়ার্ড ম্যাকিয়ানান আদালতকে জানান, তার মক্কেল জুডিশিয়াল রিভিউয়ের আবেদন করবেন। তবে লুৎফুর আদালতে উপস্থিত ছিলেন না।
লুৎফুর যুগের অবসানের পর গত ১১ জুলাই টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাচন হয়, যাতে নতুন মেয়র নির্বাচিত হন লেবার পার্টির জন বিগস। আগের নির্বাচনে লুৎফুর তাকে জালিয়াতির মাধ্যমে হারিয়েছিলেন বলে আদালতে প্রমাণিত হয়।
১৯৬৫ সালে বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া লুৎফুর শৈশবেই যুক্তরাজ্যে যান। আইন পেশায় যুক্ত হওয়ার পর ১৯৮৯ সালে তিনি ব্রিটেনের লেবার পার্টিতে যোগ দেন।
লুৎফুর কাউন্সিলে লেবার পার্টির লিডার থাকা অবস্থায় গণভোটের মাধ্যমে টাওয়ার হ্যামলেটসে নির্বাহী মেয়র ব্যবস্থা চালু হয়। এতে মেয়র কার্যত একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হন।
সে সময় জর্জ গ্যালওয়ের রেসপেক্ট পার্টির সঙ্গে ‘আঁতাত করে’ লুৎফর এ পদ্ধতি চালুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন বলে অভিযোগ ওঠে।
লেবার পার্টির অবস্থান সে সময় নির্বাহী মেয়র পদ্ধতির বিরুদ্ধে ছিল। দলের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় লেবার পার্টি ২০১০ সালের নির্বাচনে লুৎফুরের মনোনয়নের আবেদন ফিরিয়ে দেয়।
কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে অংশ নিয়ে সহজেই ৩২ শতাংশ বাঙালি অধ্যুষিত এ কাউন্সিলের মেয়র নির্বাচিত হন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লুৎফুর।
মেয়র হওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অভিযোগ ওঠে। স্থানীয় কমিউনিটির মধ্যে প্রভাব ধরে রাখতে তিনি স্থানীয় মসজিদ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মওলানা শামসুল হকের সঙ্গে বন্ধুত্বের বিষয়টি কাজে লাগান।
এরপর সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে ২০১৪ সালে লুৎফুর দ্বিতীয় দফায় মেয়র নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনের আগের শুক্রবার ১০১ জন ইমাম ও মুসলিম নেতা স্থানীয় বাংলা সংবাদমাধ্যমগুলোতে একটি চিঠি পাঠান, যাতে বলা হয়, লুৎফুরকে ভোট দেওয়া ‘মুসলমানদের ইমানি দায়িত্ব’।
ওই নির্বাচনে প্রথম দফা ভোটে লুৎফুর রহমান পেয়েছিলেন ৪৩ শতাংশ ভোট। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জন বিগস পান ৩৩ শতাংশ ভোট।
কেউ ৫০ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফা ভোটে বিগসের ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশের বিপরীতে ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেলে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় লুৎফুরকে।
ভোটের পর চারজন ভোটার নির্বাচন কমিশনে ভোটে প্রভাব সৃষ্টিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ করেন। রয়াল কোর্টস অফ জাস্টিস সেই অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করে গত ২৪ এপ্রিল রায় দেয়।
ওই রায়ে লুৎফুরের মেয়র পদ শূন্য ঘোষণার পাশাপাশি অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার কারণে তার দল টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট এর রেজিস্ট্রেশনও বাতিল করে নির্বাচন কমিশন।
বিচারক রায়ে বলেন, নির্বাচনী প্রচারে ‘ধর্ম’ ও ‘বর্ণবাদ’কে কাজে লাগিয়েছেন লুৎফুর রহমান। নির্বাচনের পুরো সময় ‘রেইস ও ইসলামফোবিয়া কার্ড’ খেলেছেন তিনি।