সাগরে সঙ্কট: বোঝাই নৌকা ফেরত পাঠাচ্ছে মালয়েশিয়া

সাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ঢোকার চেষ্টায় থাকা আরও পাঁচশ’ জনকে ফেরত পাঠিয়েছে মালয়েশিয়া, এরা বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা বলে দাবি করা হচ্ছে।  

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 May 2015, 10:08 AM
Updated : 14 May 2015, 10:15 AM

মালয়েশিয়ার একজন সরকারি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বৃহস্পতিবার এ খবর দিয়েছে মালয়েশিয়ার সংবাদপত্র ব্যাংকক পোস্ট ও রয়টার্স।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়ার পেনাং রাজ্যের উত্তর সমুদ্র উপকূলে তাদের খাবার ও ওষুধ দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়।

মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী ওয়াং জুনায়েদ জাফর ব্যাংকক পোস্টকে বলেন, রাষ্ট্রের পক্ষে অবৈধ অভিবাসী দিয়ে সমুদ্রসীমা ভরিয়ে ফেলা সম্ভব নয়।

“আমরা কী করতে পারি? সীমানা লঙ্ঘনকারীদের সঙ্গে আমরা যথেষ্ট নমনীয়তা দেখাচ্ছি। আমরা বিষয়টি মানবিকভাবে দেখছি।”

“কিন্তু এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। তাদের সঠিক তথ্যটি জানানো জরুরি যে, আমাদের দেশে তাদের আমরা স্বাগত জানাতে পারি না।”

এদিকে, থাইল্যান্ডের প্যাডাং বিজার এলাকার খাও কেউ পাহাড়ের আশে পাশে বুধবার অবৈধভাবে গমনেচ্ছুদের আরও চারটি কবরের সন্ধান মিলেছে। সেখান থেকে তিনটি লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।

গত কয়েক মাস ধরে অবৈধ অভিবাসী সমস্যা নিয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে পুরো দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সমুদ্র অঞ্চলে। একের পর এক পাওয়া যাচ্ছে অবৈধ আভিবাসীবোঝাই নৌকা। যাদের বেশিরভাগই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা, আছে বাংলাদেশিও।

জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথমভাগে অন্তত ২৫ হাজার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি পাচারের শিকার হয়েছেন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, ছয় হাজারেরও বেশি অসুস্থ ও ক্ষুধার্ত অভিবাসী সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধারের অপেক্ষায় আছেন।

উদ্ধার হওয়া অনেকে বলছেন, সারেংরা তাদের ফেলে নৌকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অসহায় এই ব্যক্তিরা জানে না, এরপর তাদের কী হবে।

থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সরকারকে জাতিসংঘ আহ্বান জানিয়েছে এসব অসহায় ব্যক্তিদের উদ্ধারের ব্যবস্থা নেওয়ার। কিন্তু এখনও এ বিষয়ে এ দেশগুলো সরকারের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া য়ায়নি।

থাইল্যান্ডের ক্ষমতাশীন জান্তা সরকারের মুখপাত্র মেজর জেনারেল ওরেনচং সুখনধাপাতিপাক রয়টার্সকে বলেন, “আমি যতদূর জানি, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নৌকায় করে আসা আর কোনো অবৈধ অভিবাসীদের ঢুকতে দেওয়া হবে না।”

তবে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা ইউএনএইচসিআরের উদ্ধার অভিযানের আবেদন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে তিনি রাজি হননি।

মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও এই আবেদন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে থাইল্যান্ড নেভি বুধবার জানিয়েছে, 'পুশ ব্যাকের' মতো কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত তাদের নেই।

রিয়ার অ্যাডমিরাল কান ডিউবল রয়টার্সকে বলেন, “তারা যদি থাই সমুদ্রসীমায় চলে আসে, তবে আমরা অবশ্যই তাদের খাদ্য ও পানি দিযে সাহায্য করব। মানবিক কারণেই আমারা তাদের অকূল সমুদ্রে ফিরিয়ে দেব না।”

এদিকে অবৈধ মানবপাচার বিষয়ে এই তিন দেশের পুলিশের শক্ত অবস্থানের কারণেও অভিবাসীদের সমুদ্রে ফেলে পালাচ্ছে পাচারকারীরা।

গত সপ্তাহে থাইল্যান্ডে গণকর থেকে ৩৩ অবৈধ অভিবাসীর মৃতদেহ পাওয়ার পর বেরিয়ে আসতে থাকে একের পর এক কবর, যা রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তি নষ্ট করায় পুলিশ কঠোর হতে বাধ্য হয়।

গত সপ্তাহে এক হাজার অবৈধ অভিবাসী মালযেশিয়ার ল্যাকাউই দ্বীপে এসে ভেড়ে। তাদের সেখানকার একটি সরকারি ক্যাম্পে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তবে এরপর আর কোনো নৌকা ভেড়াতে বাধা দেয়া হচ্ছে বলে রয়টার্সকে জানান মালয়েশিয়া সরকারের এক সমুদ্র কর্মকর্তা।

মালয়েশিয়ান মেরিটাইম এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান অ্যাডমিরাল তান কো কো কিউ রয়টার্সকে বলেন, “আমরা আর তাদের সুযোগ দিচ্ছি না। এটি রাষ্ট্রীয় নীতিগত সিদ্ধান্ত।”

সোমবারও ইন্দোনেশিয়া কর্তৃপক্ষ আচেহ প্রদেশের উত্তর উপকূল থেকে খাদ্য, পানি ও ওষুধ দিয়ে ৫০০ জনকে মালয়েশিয়ার দিকে ফেরত পাঠিয়েছে। যদিও এটিকে ‘প্যুশব্যাক’ বলতে নারাজ তারা। ইন্দোনেশিয়ার নেভি বলছে, নৌকাটির যাত্রীরা মালয়েশিয়ায় যেতে চেয়েছিল, ইন্দোনেশিয়ায় নয়।

রোববারও প্রায় ৬০০ অভিবাসীকে আচেহ উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয়। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বুধবার এ তথ্য দিয়ে সাংবাদিকদের জানান, ইন্দোনেশিয়া পুলিশ তাদের খাদ্য দিয়ে সাহায্য করেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শরণার্থী ও আভিবাসী সংস্থার সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে তারা।

এদিকে সোমবার আশিয়ান পার্লামেন্টারিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস ইন্দোনেশিয়া সরকারের পুশব্যাক নীতির সমালোচনা করেছে।

আন্তর্জাতিক আইনি সাহায্য সংস্থা এবিএইচআরের প্রধান ও মালয়েশিয়ার সংসদ সদস্য চার্লস সান্তিয়াগো রয়টার্সকে বলেন, “অভিবাসীদের উন্মুক্ত সমুদ্রের দিকে ঠেলে দিয়ে এটা আমার সমস্যা নয় বলে চোখ বন্ধ করা, এতবড় আঞ্চলিক সমস্যার সমাধান হতে পারে না।”

তার মতে, তিন দেশের অবস্থান এ সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করছে।

মালয়েশিয়ান হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সুনাই পাহসুক রয়টার্সকে বলেন, “যখন দেশগুলো যেমন থাইল্যান্ড 'পুশব্যাক' নীতি অবলম্বন করছে, তখন উপকূলে আমরা রোহিঙ্গাদের মৃতদেহ পাচ্ছি।

“এই তিন দেশ যদি পুশব্যাক নীতি নিয়ে এগোতে থাকে, তবে তাদের হাতে সাধারণ মানুষের রক্তের গন্ধ লেগে থাকবে।”

এদিকে মালযেশিয়ার পুলিশ থাই পুলিশের সঙ্গে যৌথ অভিযানের সফলতা দাবি করেছে। তারা থাইল্যান্ডের পশ্চিমের ও মালয়েশিয়ার উত্তরের মানবপাচারের সাতটি চক্রকে ধসিয়ে দেওয়ার দাবি করেছে। পুলিশের দাবি, পাচারকারীরা ইউএনএইচসিআরের কাগজও জাল করে।

এদিকে, মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী ওয়ান জুনাইদি দক্ষিণ এশিয়ার সারকারদের প্রতি মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন বলে সংবাদ প্রকাশ করেছে ব্যাংকক পোস্ট।

“আপনারা গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলেন, তাহলে নাগরিকদের উচ্ছিষ্ট বা অপরাধীদের মতো দেখবেন না, যাতে তাদের দেশ ছেড়ে পালাতে হয়।”

ওয়ান জুনায়েদি জানান, শিগগিরই বাংলাদেশ, মিয়ানমারসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো এবং আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন তারা।

তিনি বলেন, “অন্যান্য দেশগুলোকে আমি অনুরোধ করব, গ্যালারিতে বসে কথা না বলে, নিজেদের দরজা অসহায় আভিবাসীদের জন্য খুলে দিতে।”

জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় দেড় লাখ অবস্থান করছেন। এর মধ্যে ৪৫ হাজারেরও বেশি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপ-প্রধান ফিল রবার্টসন বলেন, মালযেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার শক্ত অবস্থান রোহিঙ্গা সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে।

তবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে উদ্ধার বাংলাদেশি আভিবাসীদের ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে।