যেভাবে ‘প্রতিশ্রুতি ভাঙছে’ বিশ্ব ব্যাংক

মানুষ ও পরিবেশের ‘ক্ষতি না করার’ স্লোগান নিয়ে কার্যক্রম চালালেও আর্থিক খাতের বিশ্ব মোড়ল বিশ্ব ব্যাংক কীভাবে গত এক দশকে ৩৪ লাখ লোকের বাস্তুচ্যুতির কারণ হয়েছে- তা উঠে এসেছে ২১ দেশের ৫০ সাংবাদিকের অনুসন্ধানে তৈরি এক প্রতিবেদনে।

নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 April 2015, 09:24 PM
Updated : 18 April 2015, 02:53 PM

যুক্তরাষ্ট্রের হাফিংটন পোস্টে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ব ব্যাংকের চারটি প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশেও ঘর হারিয়েছে ৮৪ হাজার ৪০৮ জন।

‘হাউ দ্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ব্রোক ইটস প্রমিজ টু প্রোটেক্ট দ্য পুউর’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে নেওয়া প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে গত দশ বছরে বিভিন্ন দেশের প্রায় ৩৪ লাখ মানুষকে ভিটেমাটি থেকে ‘উচ্ছেদ’ করা হয়েছে, ধ্বংস করা হয়েছে তাদের জীবিকার অবলম্বন।

নিজেদের প্রকল্পের কারণে ক্ষতির হাত থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে যে নীতিমালা বিশ্ব ব্যাংক তৈরি করেছে, তা প্রতিপালনেও যে তারা বারবার ‘ব্যর্থ’ হয়েছে, তা উঠে এসেছে এ প্রতিবেদনে।

ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্ব ব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠক শুরুর আগে বৃহস্পতিবার ‘ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস’ (আইসিআইজে) এর ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে হাফিংটন পোস্ট। 

এতে বলা হয়, বিশ্ব ব্যাংকের অসংখ্য নথি বিশ্লেষণ করে এবং আলবেনিয়া, ব্রাজিল, ইথিওপিয়া, হন্ডুরাস, ঘানা, গুয়াতেমালা, ভারত, কেনিয়া, কসভো, নাইজেরিয়া, পেরু, সার্বিয়া, দক্ষিণ সুদান ও উগান্ডায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে প্রায় এক বছরের চেষ্টায় এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

“অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিশ্ব ব্যাংকের কারণে এসব দেশে নগরের বস্তিবাসী, প্রান্তিক কৃষক, দরিদ্র জেলে এবং আদিবাসীদের ঘর হারাতে হয়েছে, জমি হারাতে হয়েছে, স্বাভাবিক জীবন থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে; আর কখনও কখনও এটা করা হয়েছে জোর করে, সহিংসতার মাধ্যমে।”   

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি না- তা পর্যালোচনার বিষয়টি বিশ্ব ব্যাংক প্রায়ই উপেক্ষা করে গেছে।  বাস্তুচ্যুত মানুষের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটছে- সে বিষয়েও বিশ্ব ব্যাংক কোনো খোঁজ রাখেনি।

“বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বিশ্ব ব্যাংক নিপীড়ক সরকারগুলোকে ঋণ দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। এতে তারা এই বার্তা পেয়েছে যে, বিশ্ব ব্যাংকের নীতিমালা না মানলেও ভয়ের তেমন কিছু নেই।”

২০০০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিশ্ব ব্যাংকের হয়ে আদিবাসী অধিকার রক্ষার বিষয়টি দেখভাল করেছেন নাভিন রাই।

তাকে উদ্ধৃত করে হাফিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, “অনেক সময়ই দেখা যায়, ঋণগ্রহীতা সরকার ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া নিয়ম মানতে আগ্রহী নয়। আর তাদের এ বিষয়ে বাধ্য করতে বিশ্ব ব্যাংককেও খুব একটা আগ্রহী হতে দেখা যায় না। এভাবেই খেলাটা চলে।”   

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব ব্যাংক ও তাদের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন এমন সব সরকার ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে গেছে, যাদের বিরুদ্ধে হত্যা, নির্যাতন, এমনকি ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উঠেছে। কিছু ক্ষেত্রে এসব অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার পরও ব্যাংক তাদের অর্থ জুগিয়ে গেছে।

বিশ্ব ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ইথিওপিয়া সরকার দাতাদের অর্থায়নের একটি প্রকল্প থেকে কোটি কোটি ডলার সরিয়ে নিয়ে তা কাজে লাগিয়েছে বড় ধরনের এক উচ্ছেদ অভিযানে।   

“বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপ ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এমন সব প্রকল্পে ৫০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে যেগুলো সমাজ বা পরিবেশের জন্য ভয়ঙ্কর ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।”

ক্ষতিগ্রস্তদের সুরক্ষায় বিশ্ব ব্যাংকের নীতিতে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ থাকার বিষয়ে গত মার্চে সংস্থার প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আইসিআইজে ও হাফিংটন পোস্ট।

“জবাবে এক বিবৃতিতে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বলেন, বিষয়গুলো আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি এবং যা দেখতে পেয়েছি তাতে আমি উদ্বিগ্ন।”

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পরাশক্তি মিলে যখন বিশ্ব ব্যাংক গঠন করে, তাদের মূল স্লোগান ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযোগিতা করা। সদস্য দেশগুলো যে অর্থ যুগিয়েছে, তা দিয়ে বিশ্ব ব্যাংক প্রতি বছর গড়ে ৬৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ ও অনুদান দিয়ে গেছে। ভোটের মাধ্যমে এসব প্রকল্প অনুমোদন করেছে সদস্য দেশগুলোই।  

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ব ব্যাংক যে ‘সেইফগার্ড পলিসি’ অনুসরণের কথা বলে এসেছে, তাতে বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কোনো সরকার অধিবাসীদের সতর্ক না করে বাড়ি সরাতে পারবে না। বাঁধ বা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সময় যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হবে তাদের অবশ্যই পুনর্বাসন করতে হবে এবং নতুন জীবিকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।   

বিশ্ব ব্যাংকের ভাষায়, এই নীতিমালার মধ্য দিয়ে তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ‘অধিকতর মানবিক ও গণতান্ত্রিক’ একটি মডেল তৈরি করেছে। 

কিন্তু আইসিআইজে ও হাফিংটন পোস্টের প্রতিবেদন বলছে, এশিয়ার বিশ্ব ব্যাংকের ২২১টি প্রকল্পের কারণে ২৮ লাখ ৯৭ হাজার ৮৭২ জন, আফ্রিকায় ১৩৬টি প্রকল্পের কারণে ৪ লাখ ১৭ হাজার ৩৬৩ জন, দক্ষিণ আমেরিকায় ৩১ প্রকল্পের কারণে ২৬ হাজার ২৬২ জন, ইউরোপে ১১টি প্রকল্পের কারণে ৫ হাজার ৫২৪ জন, ওসেনিয়া অঞ্চলে দুটি প্রকল্পের কারণে ২ হাজার ৪৮৩ জন, উত্তর আমেরিকায় ১১টি প্রকল্পের কারণে ৮৫৫ জন এবং দ্বীপ দেশগুলোতে একটি প্রকল্পে ৯০ জন বাস্তুহারা হয়েছেন।

এর মধ্যে কেবল চীন, ভারত ও ভিয়েতনামেই বিশ্ব ব্যাংকের ‘গাফিলতির কারণে’ ২৭ লাখ ২১ হাজার ৮৫৮ জন গৃহহারা হয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। 

এতে বলা হয়েছে, ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে উন্নয়নশীল বিশ্বে বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ ৭২০০ প্রকল্পে ৪৫৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। আর একই সময়ে এ দুটি সংস্থায় জমা পড়া কয়েক ডজন অভিযোগে বলা হয়েছে, ঋণদাতা বা গ্রহীতা উভয়ই প্রকল্প বাস্তবায়নে অংশীজনের সুরক্ষা নীতি মেনে চলতে ব্যর্থ হয়েছে।

হাফিংটন পোস্টের প্রতিবেদনের শুরুতেই নাইজেরিয়ার লাগোসে পুলিশের অস্ত্রের মুখে কয়েক হাজার বস্তিবাসীকে উচ্ছেদের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। আর সেই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয় বিশ্ব ব্যাংকের একটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে, যে সংস্থাটি দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলে।

একইভাবে ভারতের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের অর্থায়নে টাটার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে জেলে ও চিংড়িচাষিদের আবাসভূমিতে দূষণের ক্ষতিসহ বিভিন্ন দেশে বিশ্ব ব্যাংকের নীতির ব্যর্থতা তুলে ধরা হয়েছে এ প্রতিবেদনে।           

হাফিংটন পোস্ট বলছে, যাত্রা শুরুর অষ্টম দশকে এসে বিশ্ব ব্যাংক এখন ‘পরিচয়ের সঙ্কটে’ পড়েছে। বড় বড় প্রকল্পে অর্থায়নে সক্ষম আরও অনেক উন্নয়ন ব্যাংক তৈরি হওয়ায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বিশ্ব ব্যাংক।

সম্প্রতি চীনও একটি উন্নয়ন ব্যাংক খুলে যুক্তরাজ্য ও জার্মানির মতো দেশকে তাতে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যেই এর বিরোধিতা করে আসছে।