‘তিনি সত্যিকারের একজন ইতিহাসের মহারথী’, কুয়ানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় বলেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তার কথায়, লি কুয়ানের কাছ থেকে উপদেশ, পরামর্শ নেয়া অতীত ও বর্তমান প্রজন্মের বিশ্ব নেতাদের সংখ্যা নেহাত কম নয়।
সিঙ্গাপুরকে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া একটি দেশ থেকে এশিয়ার অন্যতম ধনী দেশে পরিণত করার এই রূপকারের মৃত্যু তাই নাড়া দিয়ে গেছে গোটা বিশ্বকে।
সিঙ্গাপুরের পার্লামেন্ট ভবনে শায়িত কুয়ানের কফিনে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছে মানুষ। বিশ্বজুড়ে শোকবই ভরে গেছে শোকবাণীতে। ২৫ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত পার্লামেন্টেই শায়িত থাকবে কুয়ানের দেহ। ২৯ মার্চ হবে শেষকৃত্য।
১৯২৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশ সিঙ্গাপুরে জন্মেছিলেন হ্যারি লি কুয়ান ইউ। চীনের গুয়াংডং প্রদেশ থেকে তার পূর্বপুরুষরা চলে এসেছিলেন সিঙ্গাপুরে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার স্মৃতি মুছে ফেলতে প্রথম নাম হ্যারি ছেঁটে ফেলেছিলেন তিনি।
জীবনের শুরুর দিনগুলো
ধনাঢ্য চীনা পরিবারে জন্ম নেয়া লি কুয়ান ইউ ১৯ শতক থেকেই সিঙ্গাপুরে ছিলেন।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে পড়াশুনা করেন তিনি।১৯৫০ এর দশকে কুয়ান সিঙ্গাপুরে ফিরে আসেন।
রাজনীতির শুরু
সিঙ্গাপুর তখনো ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ।ছিল গভর্নরের শাসন আর একটি বিচারিক পরিষদ। যেটি গঠিত ছিল ধনী চীনা ব্যবসায়ীদের নিয়ে। তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হয়ে বরং নিয়োগ পেতেন। ১৯৫০ এর দশকের শুরু দিকেই সিঙ্গাপুরে সাংবিধানিক সংস্কার এবং স্বাধীনতার গুঞ্জন উঠেছিল। আর তখনই দেশের শাসনকাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সংস্কার এবং স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান লি কুয়ান। খুব শিগগিরই নেতৃত্বের অগ্রভাগে চলে আসেন তিনি। ১৯৫৪ সালেই নিজ দল পিপলস অ্যাকশন পার্টির (পিএপি) মহাসচিব হন।
পিএপি’র অগ্রযাত্রা
১৯৫৫ সলে সিঙ্গাপুরে নতুন সংবিধান চালু হয়। এতে বিচারিক পরিষদে নির্বাচিত আসনসংখ্যা বাড়ে। তাতে পরিষদে প্রতিনিধিত্ব অর্জন করে লি কুয়ানের দল। ১৯৫৬ সালে ঙ্গিাপুরের স্ব-শাসন নিয়ে আলোচনা করতে প্রতিনিধি দলের হয়ে লন্ডনে যান কুয়ান। কিন্তু আলোচনা ব্যর্থ হয়। কিন্তু ১৯৫৭ সালে আবার লন্ডনে আলোচনা করতে যান তিনি।
এর পরের বছর লি স্বশাসিত সিঙ্গাপুরের মর্যাদা প্রশ্নে আলোচনায় সফল হলে নতুন সংবিধান রচিত হয়। এর আওতায় ১৯৫৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন। এতে চূড়ান্তভাবে জয়লাভ করে লি কুয়ানের দল।স্ব-শাসনের মর্যাদা পায় সিঙ্গাপুর এবং লি কুয়ান হন স্বাধীন সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।
সিঙ্গাপুরের স্বাধীনতা
ক্ষমতায় থাকাকালে বিস্ময়করভাবে সিঙ্গাপুরকে বদলে দেয়ার জন্য উন্নয়নের কারিগর ছিলেন লি কুয়ান। পাঁচশালা উন্নয়ন পরিকল্পনাও চালু করেছিলেন তিনি। মালয়েশিয়ার সঙ্গে যোগ দেয়াটাও ছিল তার এ পরিকল্পনার অংশ।
মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তখন মালয়, সিঙ্গাপুর, সাবাহ এবং সারাওয়াক নিয়ে একটি ফেডারেশন গড়ার প্রস্তাব দিলে লি কুয়ান এ প্রচেষ্টার পক্ষে প্রচার শুরু করে চিরতরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটানোর প্রয়াস নেন।
মালয়েশিয়া থেকে বিচ্ছিন্নতা
ফেডারেশনে চীনা এবং মালয়দের মধ্যে উত্তেজনার কারণে সিঙ্গাপুরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল। ষাটের দশকে ভয়ঙ্কর এ জাতিগত বিদ্বেষে তছনছ হয় গোটা সিঙ্গাপুর।
চীনা আর মালয়দের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে সে সময় ৩৪ জনের মৃত্যু ঘটে। এরপরই মালয়েশিয়া থেকে সিঙ্গাপুরকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন লি কুয়ান।
জীবনের শেষ দিনগুলো
১৯৯০ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে সরে দাঁড়ান লি কুয়ান। তবে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত পিএপি’র নেতা ছিলেন তিনি। ২০০৪ সালে এ পদে আসীন হন কুয়ানের ছেলে লি শিয়েন লুং।
চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকেই সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালে ছিলেন লি কুয়ান। প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ায় ভুগছিলেন তিনি। মার্চের শুরুতে তার অবস্থার অবনতি হলে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিত্সাধীন রাথা হয়। কিন্তু তাতেও তার অবস্থার আরো অবনতি হওয়ার পর ২৩ মার্চে শেষ নিঃস্বাশ ত্যাগ করেন কুয়ান।