উন্নত জীবনের আশায় থাইল্যান্ডে পাড়ি জমানোর উদ্দেশে তিনি একটি ছোট নৌকায় চড়ে বসলেন। ঠিক তখন ভারত মহাসাগরে তৈরি হওয়া ভয়াবহ সুনামিও তার তাণ্ডবযাত্রা শুরু করে।
এর দশদিন পর তার মা এক ফোন কলে জানতে পারেন তার ২০ বছর বয়সী মেয়ে নুই মারা গেছেন। সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে তার কন্যা সাগরে চিরতরে হারিয়ে গেছেন।
তবে প্রায় ১০ বছর পর প্রকৃত ঘটনা জানতে পারেন তিনি। প্রলয়ংকরী সুনামির পর আয়ে নুইয়ের লাশ খুঁজে পাওয়া যায় এবং পরিচয়হীন ব্যক্তিদের সঙ্গে তার লাশও মাটি চাপা দেয়া হয়।
ইরাবতি.ওরগ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ থাইল্যান্ডে সুনামির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের সমাধি আছে। এখানে পরিচয়হীন হিসেবে ৪১৮ জনকে কবর দেয়া হয়েছে। এসব কবরে শুধু নম্বর আছে, কোনো নাম নেই। নুইয়ের নম্বর পিএম৬৬-টিএ১৪১৫।
একই নৌকায় থাকা সুনামি থেকে বেঁচে যাওয়া নুইয়ের বান্ধবী খিন হাথওয়ে য়ি’ই শুধু জানতেন এই নম্বরের আড়ালে যে রয়েছে তার নাম। কিন্তু অবৈধ অভিবাসী হাথয়ে য়ি পুলিশের ভয়ে কখনোই নিহত বান্ধবীর পরিচয় প্রকাশ করেননি।
জীবিকার সন্ধানে নুই ও তার বান্ধবী খিন হাতওয়ে য়ি তাদের গ্রাম থেকে ৬শ’ মাইল পাড়ি দিয়ে মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চলে গিয়ে পৌঁছান। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর তারা একটি নৌকায় করে পাড়ি জমান থাইল্যান্ডের উদ্দেশে। আন্দামান সাগরের ১৫ মিনিটের সরু পথ পাড়ি দিলেই পৌঁছে যাবেন তারা।
কিন্তু এদিন সকালেই ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রার উপকূলে সমুদ্রের নিচে ৯.১ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। ভারত মহাসাগরের বিলিয়ন বিলিয়ন টন পানি অকল্পনীয় প্রাণসংহারী ঢেউ তীব্র বেগ নিয়ে ছুটে আসছিল উপকূলের দিকে।
আর থাইল্যান্ড অংশের আন্দামান সাগরে ৫ হাজরেরও বেশি মানুষ এদিন প্রাণ হারান।
খিন হাতওয়ে য়ি জানান, নৌকায় চড়ে বসার কয়েক মিনিটের মধ্যেই সমুদ্র উত্তাল হয়ে ওঠে। সমুদ্রের এমন রূপ তারা কখনো দেখেনি এবং তারা ভাবতেও পারেনি, এই ঢেউ স্বাভাবিক নয়।
নৌকাটি ডুবে যায় আর তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তারা বাঁচার জন্য সংগ্রাম চালান।
খিন হাথওয়ে য়ি বলেন, আমরা একে অপরকে বাঁচানোর চেষ্টা চালাই, জড়িয়ে ধরি। সে আমাকে টেনে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেই।
এ ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। আমি নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম। আমি তাকে বাঁচাতে পারিনি।
খিন হাথওয়ে একটি প্লাস্টিকের কন্টেইনার আঁকড়ে ধরে পানির ওপর ভেসে ছিলেন। সমুদ্রে একঘণ্টা কাটানোর পর তিনি তীরে উঠতে পারেন। গ্রেপ্তার এড়াতে থাইল্যান্ডে অবৈধভাবে প্রবেশ করেন। আর একারণেই কী ঘটেছিল তা পুলিশকে জানাতে পারেননি।
বান বাঙমুগান শহরে সুনামিতে নিহতদের এই কবরস্থানটি তৈরি করা হয়। তবে এর আগে নিহতদের প্রত্যেকের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়।
মায়ের নুইয়ের মা অত্যন্ত দরিদ্র। আর এ কারণে তারপক্ষে সম্ভব নয় থাইল্যান্ড গিয়ে তার মেয়ের দেহাবশেষ দেশে ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু তিনি আশা করেন, বৌদ্ধরীতিতে তার মেয়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন করবেন।
তিনি বলেন, “আমার কোন ক্ষোভ নেই। আমি কাউকে দোষারোপও করছি না। আমার মেয়ের লাশ যারা রেখেছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। এটা আমার মেয়ের ভাগ্যে ছিল।”