সিডনির জিম্মি ঘটনা: শুরু থেকে শেষ

সিডনির মার্টিন প্লেসের লিন্ড ক্যাফের জিম্মি নাটকের নায়ক হারুন মনিস ওরফে শেখ হারুন তার দাবি দাওয়া নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টনি এবোটের সঙ্গে সরাসরি টেলিফোনে কথা বলতে চেয়েছিলেন।

ফজলুল বারী, সিডনি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Dec 2014, 11:28 AM
Updated : 17 Dec 2014, 06:37 PM

আর তার দাবিগুলো ফোন এবং মোবাইল ফোনে ধারণ করা ভিডিওচিত্র আকারে বিভিন্ন গণমাধ্যমে পৌঁছে দিতে ব্যবহার করেছিলেন ওই ক্যাফেরই এক কর্মী আর জিম্মিদের।

কিন্তু তার দাবিগুলো জায়গামতো না পৌঁছানোয় চিৎকার-চেঁচামেচি করেছেন, মাঝে মাঝেই হয়েছেন ক্ষিপ্ত। ইরানি বংশোদ্ভূত ‘বন্দুকধারী’ মনিসের অস্থিরতার মুখে ভীতিকর একটা একটা সময় কাটাতে হয়েছে জিম্মিদের।    

ওই ক্যাফে থেকে প্রাণ নিয়ে ফেরা একজন জিম্মির কথায় উঠে এসেছে সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর কিছু মুহূর্তের চিত্র।   

গত মঙ্গলবার ওই ক্যাফেতে কয়েক ডজন মানুষকে বন্দুকের মুখে জিম্মি করার ১৬ ঘণ্টা পর নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে মারা যান মনিস। এছাড়া ক্যাফের ম্যানেজার ও ক্যাটরিনা নামে একজন আইনজীবীও প্রাণ হারান ওই ঘটনায়। 

ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবস্থাপক হিসাবে কাজ করার সময় প্রতারণার অভিযোগ মাথায় নিয়ে ১৯৯০ এর দশকে মালয়েশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় যান মনিস।

১৪ বছর আগেই তাকে ফেরত চেয়েছিল ইরান। কিন্তু ইরানের সঙ্গে অপরাধী প্রত্যার্পণ চুক্তি না থাকায় তাকে ফেরত দেয়নি অস্ট্রেলিয়া।

শেষ পর্যন্ত যে দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন, সেখানেই জিম্মি নাটকের মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি।

যে জিম্মি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে বর্ণনা করেছেন ওই দিনের ঘটনা, তিনি নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি।   

তিনি বলেন, “নিজেকে ইসলামিক স্টেটের প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে ক্যাফের ম্যানেজারের দিকে অস্ত্র তাক করে প্রথম নিজের অবস্থান জানান দেন মনিস। ক্যাফের ভিতরে থাকা লোকজনকে বলেন, ‘খবরদার কেউ এখান থেকে বেরোনোর চেষ্টা করবে না! সারা ভবনে বোমা পাতা আছে। বোমা-বিস্ফোরক আছে আমার ব্যাগের মধ্যে। কেউ চালাকি করার চেষ্টা করলেই মারা পড়বে’।

এরপর মনিস ক্যাফের কর্মীদের সব দরজা বন্ধের নির্দেশ দেন। ভীত সন্ত্রস্ত কর্মীরা তার নির্দেশ পালন করেন। তাকে ‘ব্রাদার’ বলে সম্বোধন করতে জিম্মি নারীদের নির্দেশ দেন তিনি।

“প্রথম দিকে বন্দুকধারী ক্যাফের ম্যানেজারের চেয়ারে বসেছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরপর দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন। অস্ত্রহাতে তার অস্থির নড়াচড়া ক্যাফের ভেতর ভীতি ছড়াচ্ছিল। জিম্মিদের সবাইকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দেন হারুন মনিস।

“ওই অবস্থায় বাইরে অ্যালার্ম বেজে ওঠে। অটোমেটিক দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে এক নারী কাস্টমার। মনিস তার দিকে অস্ত্র তাক করে বলেন, ‘খবরদার আর কেউ এখানে ঢুকবে না বা এখান থেকে বেরোবে না’। সম্ভবত ওই নারীর মাধ্যমেই প্রথম জিম্মি ঘটনার খবর পায় পুলিশ।”

“ওই সময় ক্যাফের ভেতরে শুধুই আতংক। ভীতসন্ত্রস্ত জিম্মিদের অনেকে কাঁদছিলেন। একজন বমি করতে থাকেন। হারুন চিৎকার করে সবাইকে সাবধান করছিলেন আর বলছিলেন, গত কয়েক বছর ধরে তার সঙ্গে অনেক অবিচার করা হয়েছে। এদেশের কোন রাজনীতিক, মিডিয়া, বিচারক কেউ তার কথা শোনেনি। ফাইনালি সে তার কথা শোনানোর ব্যবস্থা করেছেন।”

ঘটনার এই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, এক পর্যায়ে একজনের ফোন বেজে ওঠায় সে কল রিসিভ করতে যাচ্ছিল। সে সময় চিৎকার করে হারুন ফোন নিচে ফেলে দিতে বলেন। লিন্ডসের এক স্টাফকে হারুন তার পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন। ওই কর্মীকে দিয়েই নানা নির্দেশ পালন করাচ্ছিলেন।”

“তার (স্টাফ) মাধ্যমে তিনি নানা সোস্যাল মিডিয়ায় বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ওই স্টাফকে সিডনির টু-জিবি, নাইন, সেভেন নেটওয়ার্ক, এবিসি এসব মিডিয়ায় ফোন করতে বলেছিলেন।”

বন্দুকধারী মনিস চাচ্ছিলেন তার বক্তব্য বাইরে যাক, কিন্তু তা না হওয়ায় বারবার রেগে যাচ্ছিলেন।

এরপর হারুন তার দাবিদাওয়া নিয়ে তার বক্তব্য ভিডিও করতে জিম্মি চার নারীকে বাছাই করেন।

ভিডিওতে দেখা গেছে, তার নির্বাচন করা ওই নারীরাই ক্যাফের এক কোনে কালো ব্যানারে আরবিতে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ লেখা ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ব্যানারের সামনে দাঁড়িয়ে মনিসের বক্তব্য পড়তে বাধ্য করা হয়েছিল জুলি টেইলর নামের একজন আইনজীবীকে।

ওই আইনজীবীকে বলতে দেখা যায়, “আমার নাম জুলি টেইলর। আমি সিডনি কোর্টের একজন ব্যারিস্টার। এই বার্তাটি প্রধানমন্ত্রী টনি এবোটের জন্য। এখানে আমরা আমাদের ব্রাদারের সঙ্গে আছি। তিনি মাত্র তিনটি সাধারণ বিষয় বলছেন।”

মনিসের প্রথম দাবি ছিল, প্রধানমন্ত্রী টনি এবোটকে তার কাছে (মনিস) ফোন করতে হবে। তাদের আলোচনা গণমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করতে হবে। এটি করা হলে পাঁচজন জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে।

দ্বিতীয় দাবি ছিল, অস্ট্রেলিয়ায় ইসলামিক স্টেটের হামলার কারণ তিনি জানাতে চান রাজনীতিকদের। আর ইসলামিক স্টেটের পতাকা বিলি করার ইচ্ছাই ছিল তার শেষ দাবি।

হারুনের এই ভিডিওটিই ওইদিন বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল। দুর্বল ছবি ও শব্দের ভিডিওটি বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ সব ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়।

“দুপুরের দিকে হারুন বুঝতে পারেন, তার ভিডিও বার্তাটি প্রচার হয়নি। এরপর তাকে খুব রাগারাগি করতে দেখা যায়। এরপরও এক পর্যায়ে জিম্মিদের পানি পানের অনুমতি দেন। এক নারী ওষুধ খেতে চাইলে তারও অনুমতি দেওয়া হয়। একজন টয়লেটে যেতে চাইলে ক্যাফের একজন স্টাফকে তাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যেতে বলেন। বিকালের দিকে তার অস্থিরতা আরও বাড়তে শুরু করে বলে ওই জিম্মি জানান।

অস্ত্র নিয়ে তার ঘনঘন নড়াচড়ায় জিম্মিদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ে। জিম্মিদের কেউ কেউ অনুনয় বিনয় করে তাদের ছেড়ে দিতে বললে ‘নো নো’ বলে প্রত্যাখ্যান করেন হারুন।

ওই প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বেলা ৩ টা ৩৭ মিনিটের দিকে একজন পালানোর প্ল্যান করে। হারুন তখন তার কাছের লোকজনের সঙ্গে কথা বলছিল। ওই ফাঁকে একজন লোক পালাতে পারে। এরপর দরজাটা বন্ধ করার কথা বলে পালায় আরেকজন। ৫টার দিকে ফায়ার এক্সিট দিয়ে পালিয়ে যায় লিন্ডের দুই কর্মী।

“এতে হারুন এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন যে, তার চেহারা দেখে অন্য জিম্মিরা ভয় পেয়ে যায়। ফলে নতুন করে আর কেউ পালানোর চেষ্টা করেনি।”

শেষ পর্যন্ত রাত দুইটার পর ব্যাপক ধোয়া আর আলোর বন্যার মধ্যে অভিযান চালিয়ে জিম্মি নাটকের রক্তাক্ত পরিসমাপ্তি ঘটায় পুলিশ।