সিরিয়ায় ‘ইসলামি খেলাফত’ গড়েছে আইএস

সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় মরু, শহর আর উদ্যান সমাজের বাসিন্দারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মেনে নিয়েছে ইসলামিক স্টেটকে, যারা ইরাক ও সিরিয়ায় অধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে খেলাফত ধাঁচের রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু করেছে।

>>রয়টার্স
Published : 4 Sept 2014, 03:02 PM
Updated : 4 Sept 2014, 05:13 PM

শিরশ্ছেদ, গণহত্যা, প্রতিপক্ষের শক্ত ঘাঁটি চুরমার করতে পারদর্শী ইসলামিক স্টেট, ক’দিন আগেও যাদের দাপ্তরিক নাম ছিল ‘ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট’। তারাই এখন পানি-বিদ্যুৎ সেবাসহ সরকারি কর্মচারীদের বেতন, রাস্তার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, জনগণের নিত্য দিনের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে রুটি উৎপাদন, ব্যাংক- বীমা পরিচালনা থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনার সব দায়িত্বই পালন করছে।

সিরিয়ার উত্তরপূর্বাঞ্চল বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলের রাক্কা প্রদেশকে ‘ইসলামি খেলাফত’ এর দৃষ্টান্ত হিসাবে স্থাপন করেছে তারা।

রণাঙ্গণে প্রতিপক্ষ ওপর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ, ইসলামি আইনের কঠোরতম প্রয়োগ অন্যান্য জঙ্গি দলগুলোর থেকে ভিন্ন রূপ দিয়েছে আইএসকে। তবে ওই অঞ্চলের বাসিন্দারা বলছে, কার্যকর ও বাস্তবসম্মত শাসন কৌশলই আইএসকে শক্ত অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে।

রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজেদের মতবাদ ও তত্ত্বগুলোর প্রথম প্রয়োগ আইএস ঘটিয়েছে সিরিয়ার রাক্কা প্রদেশে। তাদের শাসনে রাষ্ট্র বনাম জনগণের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে দাঁড়ায়, তারই পরীক্ষা চালাচ্ছে আইএস।

রাক্কা অঞ্চলের এই প্রশাসনকে সুদূর চীন থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃতি করার খায়েশ রয়েছে তাদের।

তিন বছর আগে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর আগে রাক্কা প্রদেশের রাজধানীতে প্রায় তিন লাখ মানুষের বাস ছিল। সেখানে আইএস এর নিয়ন্ত্রণের বাইরে আসাদ প্রশাসনের সময়কার একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানও নেই।

রাক্কার একজন বাসিন্দা রয়টার্সকে বলেন, “সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে তারা (আইএস) অনেক প্রতিষ্ঠানিক কাজ করেছে। এটা আসলেই পছন্দ করার মতো ব্যাপার।”

নিরাপত্তার অভাবে রয়টার্সের সাংবাদিকর আইএস এর রাজ্য ঘুরে দেখতে পারেননি। তবে সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলা এবং যোগাযোগ করতে পেরেছেন তারা।

রাক্কার বাসিন্দা, আইএস যোদ্ধা এমন কি আইএস বিরোধী পক্ষগুলোর সঙ্গেও কথা বলেছেন রয়টার্সের সাংবাদিকরা। তাদের দাবি বাগদাদির নেতৃত্বে একটি আধুনিক রাষ্ট্রই গড়ে তুলেছে আইএস।

ইসলামি চরমপন্থি গোষ্ঠী আইএস-এর উত্থানে উদ্বিগ্ন বিশ্বের আঞ্চলিক শক্তিগুলো। গতমাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক বক্তব্যে আইএসকে মধ্যপ্রচ্যের ‘ক্যান্সার’ বলে উল্লেখ করেন।

আর মধ্যে প্রচ্যেই পশ্চিমা বিশ্বের অন্যতম মিত্র সৌদি আরবের বাদশাহ আব্দুল্লাহ উল্টো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে আইএস এর উত্থান নিয়ে সতর্ক করেছেন। বাদশাহর মতে ঠিকমতো দমাতে না পারলে অচিরেই আইএস ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রে অস্থিতিশীলতা শুরু করবে।

কিন্তু রাক্কার মতো এলাকায় আইএস নাগরিক জীবনের সঙ্গে এমন শক্তভাবে মিশেছে যে, এখন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান এমন কি ইরাক, সিরিয়া ও কুর্দি যোদ্ধাদেরও তাদেরকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করা দুষ্কর হয়ে পড়বে।

বিপ্লবের সেতুবন্ধন?

রাক্কায় আসাদ প্রশাসনের পতন হয়েছে ২০১৩ সালে। আইএস এর কাছে সেটা ছিল তাদের ভবিষ্যতের বিপ্লবী পরিকল্পনার সূচনামাত্র।।

আসাদকে হটানোর লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল উদারপন্থি ধর্মীয় গোষ্ঠী ছাড়াও আরো কিছু কট্টরপন্থি ধর্মীয় গোষ্ঠী। তবে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আইএস এর দোর্দণ্ড দমননীতির সামনে নিশ্চিহ্ন হয়েছে তারা।

সিরিয়া যুদ্ধে আসাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন অথচ আইএস’ এর মতবাদের অনুসারী নয় এমন যোদ্ধাদের হত্যা করেছে বাগদাদির বাহিনী। অনেককে গুম করা হয়েছে। কেউ আবার পাশের দেশ তুরস্কে পালিয়ে গিয়ে প্রাণরক্ষা করেছেন।

রাক্কায় মদ জাতীয় পানীয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। দুপুরের পর (আযানের পর) বাজারের দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যায়, রাত নামতেই ফাঁকা হয়ে যায় রাস্তাঘাট। বহির্বিশ্বের সঙ্গে এমন কি পাশের শহর গুলোতে যাতায়াত করতে হলেও আইএস প্রশাসনের অনুমোদন প্রয়োজন হয়।
বিদ্রোহী ও আসাদ বিরোধীদের মধ্যে যারা রাক্কায় থেকে গেছেন তাদেরকে অবশ্য ‘অনুশোচনা’ ও বাগদাদি প্রশাসনের আনুগত্য স্বীকার করে নিতে হয়েছে। তাদের পাপ ক্ষমা করার পর অনেককে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে দেয়া হচ্ছে আবার কেউ কেউ আইএস এর হয়ে কাজ করছেন।

আইএসের একজন আমির বা কমান্ডার রয়টার্সকে বলেন, “আমরা আসলে একটি রাজ্য, এখানে সবকিছুই পূণ্যময়, কারণ এখানে শাসন চলছে আল্লাহর আইন অনুযায়ী।”

আসাদ প্রশাসনের হয়ে কাজ করত এমন কিছু সুন্নি মুসলিমও আইএস এর ‘রাজ্যে’ থেকে যেতে পেরেছেন। তবে তাদেরকে নতুন রাজ্যের আনুগত্য স্বীকার করতে হয়েছে।

রাক্কার এক বাসিন্দা রয়টার্সকে বলেন, “যেসব নাগরিক আগে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না, তারা খুব সহজেই আইএস-এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। কারণ, মানুষগুলো আগেকার প্রশাসনের অধীনে থেকে অনেক ক্লান্ত, বিরক্ত। এছাড়া, সত্যিকার অর্থে আইএস এখানে প্রতিষ্ঠানিক কাজগুলোই করছে।”

নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর থেকেই আইএস এখানে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনঃনির্মাণ করেছে। ভোক্তাদের সুবিধাবৃদ্ধি, জননিরাপত্তা এমন কি বিচার ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়েছে বলে দাবি ওই স্থানীয় বাসিন্দার।