রওজা ভেঙে সরিয়ে নেয়া হবে মহানবীকে!

মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর সমাধিক্ষেত্র ভেঙে তার দেহাবশেষ অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে নেয়ার একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে সৌদি আরবে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Sept 2014, 02:16 PM
Updated : 2 Sept 2014, 03:10 PM

যুক্তরাজ্যের দৈনিক দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট ও ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি আরবের এক শিক্ষাবিদের সঙ্গে আলোচনার পর এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব এরই মধ্যে মদিনার ‘মসজিদে নববী’ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের কাছে পাঠানো হয়েছে।

গুরুত্বের দিক থেকে মুসলমানদের কেবলা কাবা শরিফের পরই মসজিদে নববীর স্থান। এখানেই রয়েছে মহানবীর (সা.) রওজা বা সমাধি। প্রতিবছর হজের সময় লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলিম স্থানটি জিয়ারত করেন। মসজিদে নববী মুসলিমদের কাছে দ্বিতীয় পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত।

নিয়ামানুযায়ী সৌদি আরবের বর্তমান বাদশা আবদুল্লাহ এর অভিভাবক।

এরকম একটি স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান ভেঙে ফেলার পরিকল্পনায় মুসলিম বিশ্বে নতুন ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।     

মহানবীর সমাধিক্ষেত্র সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনাটি প্রথম প্রকাশ করেছেন দেশটির আরেকজন বিশেষজ্ঞ, যিনি এর আগে মুসলিমদের আরেকটি পবিত্র স্থান মক্কায় অবস্থিত বিভিন্ন পবিত্র এবং ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংসের সমালোচনা করেছিলেন।    

৬১ পৃষ্ঠার ওই নথিতে মহানবীর (সা.) দেহাবশেষ মসজিদে নববীর কাছেই অবস্থিত আল-বাকি সমাধিক্ষেত্রে সরিয়ে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। আর কাজটি করা হবে গোপনীয়তার সঙ্গে।  

তবে প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে কিনা তা এখনো জানা যায়নি।

কিন্তু শিয়া-সুন্নি, মুসলিমদের দুই সম্প্রদায়ের কাছেই অত্যন্ত পবিত্র হিসেবে পরিচিত মসজিদে নববী সংস্কারের যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হলে পুরো মুসলিম বিশ্বে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদ ড. ইরফান আল-আলাওয়ী।

এমনিতেই ইরাক ও সিরিয়ায় শিয়া-সুন্নি সংঘাত বেড়ে যাওয়ায়, সৌদি সরকারের নতুন এই পরিকল্পনা দুই গোষ্ঠির মধ্যেকার হিংসাত্মক ঘটনা আরও বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করেন তিনি।     

সৌদি আরবের কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতারা ওহাবি মতাদর্শে দীক্ষিত। সুন্নি মুসলমানদের কট্টরপন্থী গোষ্ঠী ওহাবিরা মনে করে, কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব কিংবা স্থাপনার প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করা হারাম। এটি শিরক বা আল্লাহর সমতুল্য জ্ঞান করা।

ইসলামিক হেরিটেজ রিসার্চ ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থার পরিচালক আলাওয়ী বলেন, “মসজিদে নববীর চারপাশে যেসব ঘরে মহানবীর (সা.) পরিবারের সদস্যরা বসবাস করতেন, মানুষ সেসব ঘর পরিদর্শন করে এবং পরে মূল সমাধিতে গিয়ে প্রার্থণা করে।

“এখন তারা দর্শনার্থীদের এ সমাধিক্ষেত্রে আসা বন্ধ করতে চায়, কারণ তারা মনে করে এটা শিরক। কিন্তু মানুষের মহানবীর সমাধি দেখার প্রবণতা বন্ধ করার একটাই পথ আছে, সেটি হচ্ছে তাকে (মহানবী) সেখান থেকে বের করে এনে অন্যকোনো সমাধিক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া।”

প্রতিবছরই কয়েক লাখ মুসলিম পবিত্র হজ পালন করতে মক্কায় যান। হজের সময় অবশ্য পালনীয় কাজের পাশাপাশি তারা মদিনায় অবস্থিত হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর রওজাও জিয়ারত করেন।

মহানবীর সমাধির চারপাশ ঘিরে অবস্থিত মসজিদে নববীর বহুবার সংস্কার ও পরিবর্ধন করেছে আরব শাসকরা, বিশেষ করে ওসমান বংশীয়রা। এখানে ক্যালিগ্র্যাফিতে ইসলামের শেষ নবী এবং তার পরিবারের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা হয়েছে।

ড. আলাওয়ী জানিয়েছেন, ঐতিহাসিকভাবে মহামূল্যবান এসব ক্যালিগ্রাফির সঙ্গে নবীর সমাধি ঢেকে রাখা সবুজ রংয়ের গম্বুজটিও ভেঙে ফেলার প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনায়।

সৌদি সরকারের এ ধরনের পরিকল্পনায় সুন্নিরাই বেশি অবাক হবে বলে মনে করেন তিনি।

দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট এর আগে মসজিদুল হারামের সংস্কারের বিশালযজ্ঞের কথা তুলে ধরেছিল। ওয়াশিংটনভিত্তিক গালফ ইন্সটিটিউটের বরাত দিয়ে ইন্ডিপেনডেন্ট জানিয়েছিল, সংস্কার কাজের অংশ হিসেবে মক্কার কাবা শরীফকে ঘিরে থাকা এ মসজিদের ৯৫ ভাগই ধ্বংস করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বিলাসবহুল সব হোটেল, অ্যাপার্টমেন্ট আর শপিং মল।   

প্রতিবছর অতিরিক্ত হজযাত্রীর চাপ সামলাতে নেয়া এই সংস্কার পরিকল্পনা দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন ওহাবি মতাদর্শের অনুসারী মসজিদুল হারামের ইমাম আবদুল রহমান আল-সুদাইস।

মসজিদে নববী সংস্কারের জন্য রিয়াদের ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সৌদ ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ ড. আলি বি আবদুলাজিজ আল-শাবালের তৈরি করা প্রস্তাবটি দুই মসজিদের (মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববী) অভিভাবক কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানান আলাওয়ী।

রাষ্ট্রীয় জার্নালে এই প্রস্তাবের নথির কয়েকটি পৃষ্ঠা ছাপা হয়েছে। মসজিদে নববীকে ঘিরে থাকা যেসব কক্ষগুলোতে মহানবীর স্ত্রী, কন্যারা বাস করতেন সেসব অপসারণের কথা বলা হয়েছে এতে। মহানবীর (সা.) কন্যা হজরত ফাতিমার কারণে শিয়াদের কাছে এই স্থাপনাগুলো পবিত্র।   

নথিতে সবুজ গম্বুজ, এসব কক্ষ অপসারণের পাশাপাশি মহানবীর দেহাবশেষও কাছাকাছি কোনো সমাধিক্ষেত্রে সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।    

এ প্রসঙ্গে ড. আলাওয়ী বলেন, “মহানবী (সা.) অজ্ঞাত থাকবেন। মহানবীর মসজিদের চারপাশের সবকিছুই এরই মধ্যে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এর চারপাশে এখন অনেক বুলডোজার। আশপাশের সবকিছু সরিয়ে ফেলার পর তারা মসজিদের দিকে এগোবে।”

পুরো বিশ্বের নজর এখন ইরাক আর সিরিয়ার দিকে থাকার সুযোগেই কাজটি করা হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ইমাম হয়ত বলবেন, মসজিদটির পরিবর্ধন প্রয়োজন। মুহাম্মদ (সা.) এর সমাধিকে যারা পবিত্র মনে করে সেই মুলধারার সুন্নিরা এটা কখনোই করবে না। মহানবীর কন্যা ফাতিমাকে সম্মান দেখানো শিয়াদের কাছেও তো এই জায়গাটি গুরুত্বপূর্ণ।”

তিনি বলেন, “আমি নিশ্চিত এই ধরনের পদক্ষেপ পুরো মুসলিম বিশ্বকে ভয়ঙ্করভাবে নাড়া দেবে। ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়বে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো।”

এ বিষয়ে জানতে ঢাকায় সৌদি আরব দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।