মেরে বাঁচানো চিকিৎসা!

মারাত্মক আঘাতের কারণে মুমূর্ষুরা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে অভিনব এক চিকিৎসার অভিজ্ঞতা পেতে পারেন, যাতে রোগীকে বাঁচিয়ে তুলতে মৃত্যুর পর্যায়ে নিয়ে যাবেন চিকিৎসকরা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 June 2014, 05:52 PM
Updated : 12 June 2014, 05:52 PM

অস্ত্রোপচারের আগে চিকিৎসক তার শরীরের রক্ত সংরক্ষণ করে সেখানে স্থান দেবেন ঠাণ্ডা সল্টওয়াটার বা লবণাক্ত পানি। এতে করে রোগীর হৃদক্রিয়া এবং মস্তিষ্কের সক্রিয়তা বন্ধ হয়ে যাবে। রোগী হয়ে যাবেন ক্লিনিক্যালি ডেড অর্থাৎ চলে যাবেন এক ধরনের মৃত অবস্থায়।

এর পরে চিকিৎসক আহত ব্যক্তিকে সুস্থ করার প্রচেষ্টা শুরু করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের একদল চিকিৎসকের নেতৃত্ব চলা অত্যাধুনিক ওই চিকিৎসার নাম দেয়া হয় ইমার্জেন্সি প্রেজার্ভেশন অ্যান্ড রিজারেকশন বা ইপিআর।

নিউ ইয়র্ক টাইমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ মেডিকেল সেন্টারের গবেষকদের নতুন ধরনের এই পর্যবেক্ষণ অস্ত্রোপচারের প্রচলিত আধুনিক সব ধারনাকে ছাড়িয়ে যাবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রচলিত কিছু নৈতিকতাও এতে লংঘন হবে বলে অনেকের দাবি।

চিকিৎসকদের আশা, রোগীর শরীরকে হাইপোথেরামিয়ার (৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা) পর্যায়ে এনে এবং মেটাবায়োলিজম বা প্রাণ স্থিত করার রাসায়নিক উপাদানের গতি নিয়ন্ত্রণ করে রোগীর প্রাণস্পন্দন চূড়ান্তরূপে থেমে যাওয়াকে বিলম্বিত করবে। সেটা প্রায় একঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বিত করা সম্ভব হবে।

আর এই সময়ের মধ্যেই আক্রান্ত হওয়ার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত রোগীর শরীরে তারা অস্ত্রোপচারসহ প্রয়োজনীয় কাজগুলো সেরে নেবেন।

কিন্তু বিজ্ঞানীরা কখনও এধরনের অমানবিক চিকিৎসা চালাতে পারেন না। মুমূর্ষু কিংবা আঘাতের কারণে অচেতন কোনো রোগীর পক্ষে এধরণের চিকিৎসায় সম্মতি দেয়া সম্ভব নয়। প্রচলিত নিয়মে চিকিৎসার সুবিধার্থে কোনো রোগীকে অজ্ঞান করার আগে সেক্ষেত্রে রোগীর সম্মতি নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

তাহলে স্থির হওয়া প্রাণস্পন্দন আবার কিভাবে গতি পাবে? সে প্রশ্নের উত্তরই প্রচেষ্টারত চিকিৎসকদের অভিনবত্ব।

কোনো বরফাচ্ছন্ন কূপে ডুব দিয়ে কিংবা বিমানের চাকা জড়িয়ে ধরে ৩৮ হাজার ফুট উচ্চতায় উঠে গেলে কোনো অক্সিজেন না পেয়েও মানুষ কিংবা স্বল্প অক্সিজেনের সংস্পর্শে মানুষ প্রায় একঘণ্টা ধরে বেঁচে থাকতে পারেন। এ বছরের যুক্তরাষ্ট্রে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর বিমানের চাকার ফাঁকে লুকিয়ে থেকে পাঁচঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে হা্ওয়াই পৌঁছেছে। যাত্রাপথে ৩৯ হাজার ফুট ওপরে বরফশীতল তাপমাত্রা আর অক্সিজেনের অভাবের মধ্যেও সুস্থ অবস্থায় গন্তব্যে পৌঁছায় সে।

১৯৬০ সালের দিকে সাইবেরিয়ার চিকিৎসকরা শিশুর হৃদপিণ্ডে অস্ত্রোপচারের আগে তাদেরকে শীতলতাপমাত্রায় রাখতেন। এতে করে রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে বলে মনে করতেন চিকিৎসকরা।

মানুষের প্রাণস্পন্দন চূড়ান্তভাবে থেমে যাওয়াকে প্রলম্বিত করতে দেহাভ্যন্তরে শীতলতার এই প্রভাবকে কাজে লাগানো হচ্ছে নতুন ওই চিকিৎসায়।

বর্তমানেও অস্ত্রপচারের আগে শীতলীকরণ করা হয় যা হার্টের স্পন্দনকে থামিয়ে রাখে। তবে হঠাৎ আহতদের চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত তথাকথিত থেরাপোয়েটিক হাইপোথারমিয়া বা হার্ট ও মস্তিষ্ক সংরক্ষণে রক্তশীতলীকরণ (২৮ থেকে ৩২ ডিগ্রির মধ্যে) পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়নি। এছাড়া তাদের শরীরের অভ্যন্তরে শীতল সল্টওয়াটারের প্রবেশ ঘটিয়ে রোগীর রক্ত সংরক্ষণের কৌশলটিও প্রয়োগ করা হয়নি। 

ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ এর চিকিৎসকরা তাদের প্রাথমিক প্রচেষ্টায় মারাত্মক আহত ও রক্তক্ষরণের শিকার রোগীদের ওপর তাদের নতুন পদ্ধতিটি প্রয়োগ করবেন বলে শোনা যাচ্ছে।

চিকিৎসা পদ্ধতি

দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় আহত ব্যক্তির ব্রেইন ডেমেজের (মস্তিষ্কের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া) আগে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক করতে পাঁচ মিনিট সময় পেয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। 

গবেষক দলের প্রধান ডাক্তার স্যামুয়েল এ. টিসারম্যান বলেন, “ওই প্রক্রিয়ায় প্রতি ১০ জনে একজনকে সুস্থ করা সম্ভব হয়। তবে নতুন উদ্ভাবিত কৌশল অবলম্বন করে আমরা রোগীদেরকে আরো ভালো চিকিৎসা দেব।”

টিসারম্যান ও তার দল রোগীর শরীরে বা ধমনীতে ক্যানুলা নামের একটি টিউব স্থাপন করবেন। এর সাহায্যে রক্তের মধ্যে শীতলীকরণ স্যালাইন প্রয়োগ করে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রির নিচে নামিয়ে আনা হবে। এতে করে রোগী যখন সাসপেন্ডেড অ্যানিমেশন (জীবনপ্রক্রিয়ার মন্থরগতি) পর্যায়ে চলে আসবে তখন চিকিৎসক তার অস্ত্রোপচারকাজ চালাতে এক ঘণ্টার মতো সময় পাবেন।

অস্ত্রোপচার শেষ করার পর চিকিৎসকরা তাপ সরবরাহের মাধ্যমে একটি হৃদপিণ্ড সচলের পদ্ধতির ব্যবহার করবেন রোগীর শরীরে রক্ত ফিরিয়ে আনার জন্য। আর ওই রক্ত ধীরে ধীরে রোগীর শরীরে পর্যাপ্ত তাপমাত্রা নিয়ে আসবে।

রক্তের তাপমাত্রা ৮৫ থেকে ৯০ ডিগ্রির মধ্যে পৌঁছালে রোগীর হৃদপিণ্ড (হার্ট) আবার স্পন্দন দিতে শুরু করবে। তবে এক্ষেত্রে জ্ঞান ফিরে আসতে কয়েক ঘণ্টা কিংবা কয়েকদিন সময় লাগতে পারে।

১০ জীব প্রজাতির ওপর পক্রিয়াটির পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা আছে ডা. টিসারম্যানের। গত এপ্রিলেই নিরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। প্রতিমাসে একটি করে প্রজাতির ওপর সম্পন্ন করা হবে নতুন ধারার চিকিৎসার পরীক্ষণ কাজ।

পুরো গবেষণা পূর্ণতার পর্যায়ে নিয়ে যেতে কয়েক বছর সময়ে লাগতে পারে। তবে কোনো মানুষের ওপরে নিরীক্ষাটি চালানো হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানাননি ডা. টিসারম্যান।

গবেষকদের দাবি, তারা ইতোমধ্যেই শত শত কুকুর ও শুকরের উপর পরীক্ষা চালিয়ে ইপিআর বা ইমার্জেন্সি প্রেজার্ভেশন অ্যান্ড রিজারেকশন নামের ওই পদ্ধতির সঠিক ফলাফল পেয়েছেন। 

সাম্প্রতিক গবেষণায় ৯০ শতাংশ প্রাণীকেই বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।