যে কারণে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মালয়েশিয়ার বিমান

মহাকাশের অন্ধকারে তাকিয়ে আমরা শত শত কোটি মাইল দূরের জিনিস দেখতে পাই, কিন্তু সাগরের তিন মাইল গভীরতাই আমাদের প্রাযুক্তিক সীমাবদ্ধতাকে পরীক্ষায় ফেলে আমাদের সীমাবদ্ধতা বুঝিয়ে দিয়েছে।

আফসার বিপুলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 April 2014, 05:52 PM
Updated : 22 April 2014, 05:06 PM

এর প্রধান কারণ আমাদের বেশিরভাগ উদ্ভাবনই পানির নীচে কাজ করে না।

মানুষ চাঁদে গলফ খেলেছে। মঙ্গলগ্রহ থেকে পৃথিবীতে ছবি পাঠানো একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহাকাশে স্থাপন করা হাবল টেলিস্কোপের মাধ্যমে মহাবিশ্বের এক হাজার কোটি থেকে দেড় হাজার কোটি আলোকবর্ষ দূরে তাকাতে পারি।

কিন্তু সাগরের মাত্র তিন মাইল গভীরে? এ যেন সত্যিকারের গোধুলি এলাকা! মালয়েশীয় এয়ারলাইনসের ফ্লাইট এমএইচ৩৭০ এর খোঁজে চলা অভিযানটিকে, ওই গভীরতায়- মহাকাশের বিশালত্বের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা যেতে পারে- যেখানে সবকিছুই প্রায় আজানা।

বিমানটির ধ্বংসাবশেষের খোঁজে ব্লুফিন-২১ নামের একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন অতলযান মহাসগারের তলদেশে আটটি অভিযান শেষ করেছে। কিন্তু মহাসাগরের তলে চূর্ণ করে দেয়ার মতো পানির প্রবল চাপ উপেক্ষা করে বেশি গভীরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সফলতা আসেনি।

আমাদের মহাসাগরগুলোর গভীর তলদেশের ৯৫ শতাংশই এখনও মানচিত্রের আওতায় আসেনি। সিডনির ‘নিউ সাউথ ওয়েলস’ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিদ এরিক ভ্যান সিবিলি বলেন, “মহাসাগরের তলদেশের বিস্তারিত সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত।”

আমাদের এই অজ্ঞতার কারণ খুব সাধারণ। আধুনিক সব যোগাযোগ প্রযুক্তি- এটি আলো, বেতার, এক্স-রে বা ওয়াই-ফাই, যাই হোক- বিদ্যুৎচুম্বক তরঙ্গের একটি রূপ, এই তরঙ্গ সমুদ্রের পানিতে কাজ করে না।

“একমাত্র শব্দই পানির নীচে ভ্রমণ করতে পারে, আর এ কারণেই আমরা সেখানে শব্দতরঙ্গ প্রযুক্তি ব্যবহার করি,” বলেন ভ্যান সিবিলি।

শব্দ তরঙ্গ যান্ত্রিক তরঙ্গ। তাই তরলের মতো বেশি ঘনত্বের মাধ্যমও এটি ভেদ করতে পারে। কিন্তু ৩ মাইল বা ৫ কিলোমিটার গভীরতায় শব্দপ্রযুক্তি যন্ত্রও(সোনার) ক্ষমতানুযায়ী কাজ করতে পারে না।

এমএইচ৩৭০ যেখানে খোঁজা হচ্ছে সেখানে সাগরের গভীরতা ৪ হাজার ২শ’ থেকে ৪ হাজার ৪শ’ মিটার পর্যন্ত বলে জানা গেছে। ওই এলাকার ওপর দিয়ে যাওয়া জাহাজগুলো গভীরতার এই মাপই পেয়েছে।

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ওই জায়গাগুলো অন্তত ৪ হাজার ৫শ’ মিটার (১৪ হাজার ৮শ ফুট)গভীর। এ বিষয়টি অতলযান ব্লুফিন-২১ নামানোর পরই বোঝা গেছে। কারণ ওই গভীরতায় পৌঁছলেই ব্লুফিন-২১ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাগরের উপরে উঠে আসে।

ভ্যান সিবিলি বলেন, “ব্লুফিন আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে এ জায়গা সম্পর্কে আমাদের সেরা মানচিত্রগুলোও আসলে তত ভাল নয়।”

এছাড়া, মহাসাগরের গভীরে অন্য আরোকিছু যা আমাদের দৃষ্টিকে বাধাগ্রস্ত করছে তা হচ্ছে, সাগরে ফেলা বর্জ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের সাগর-মহাসাগরগুলোর তলদেশে প্রায় ৫ দশমিক ২৫ লাখ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্যের কণা ছড়িয়ে আছে।

বিশ্বের মহাসাগরগুলোতে পাঁচটি বড় ধরনের বর্জ্য কবলিত এলাকা আছে। সাগরের স্রোতে প্লাস্টিক বর্জ্য এসব জায়গায় জমা হতে থাকে। এ জায়গাগুলোর সম্মিলিত আয়তন ৭ লাখ থেকে দেড় কোটি বর্গ কিলোমিটার হবে। এটি আমাদের পুরো ইকোসিস্টেমকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

জাহাজ থেকে ফেলা বর্জ্য ইতোমধ্যেই এমএইচ৩৭০’র অনুসন্ধান কাজ বাধাগ্রস্ত করেছে। উপগ্রহের মাধ্যমে কয়েকশত জিনিসকে বিমানের সম্ভাব্য ধ্বংসাবশেষ বলে শনাক্ত করে সেখানে বিমান ও জাহাজ পাঠোনো হয়েছে। কিন্তু বিপুল ব্যয়ের পর সেখানে গিয়ে পরিত্যক্ত বস্তুই শুধু পাওয়া গেছে।

এ ধরনের অনুসন্ধান প্রায় নিস্ফল হতে বসেছে বলে জানাচ্ছেন কর্মকর্তারা। কারণ আমরা সবাই জানি, ব্লুফিন-২১ সাগর তলের বর্জ্যেও বিভ্রান্ত হতে পারে। সাগর-মহাসাগরের তলদেশের এক ভিডিওতে অবিশ্বাস্য পরিমাণ বর্জ্য শনাক্ত করা হয়েছে। এসব বর্জে্যর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আছে প্লাস্টিক- ব্যাগ, বোতল ইত্যাদি।

এসব বর্জে্যর মধ্যে রয়েছে ধাতু বর্জ্যও। এর মধ্যে প্রতি বছর সাগরে হারিয়ে যাওয়া ১০ হাজার কন্টেইনারও আছে। এই গবেষণার প্রধান কিরা শ্চিলিঙ বলেন, “সাগরের গভীরে এত পরিমাণ বর্জ্য দেখে খুব অবাক হয়েছি। আমাদের দৈনন্দিন জীবন যে সাগরের দুই মাইল গভীরকেও প্রভাবিত করে তা আমরা জানিই না।”

“এ কারণেই আমরা বিমানের কোনো ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাচ্ছি না। যদি বলা হয়, এমএইচ৩৭০ মহাকাশে হারিয়ে গেছে- এটা যদি হতো, আমরা এখনই সেটি খুঁজে পেতাম।”

টাইম ম্যাগাজিন অবলম্বনে