নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনাবসান

ফুসফুসের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতি টেনে জীবন-মৃত্যুর সীমারেখা মুছে দিলেন তিনি। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ইতিহাসে কিংবদন্তী দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা বৃহস্পতিবার জোহানেসবার্গে তার বাড়িতে মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা।

কাজী শাহরিন হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Dec 2013, 11:03 PM
Updated : 6 Dec 2013, 05:33 PM

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ ম্যান্ডেলা ২৭ বছরের কারাজীবন থেকে বেরিয়ে বর্ণভেদে রক্তাক্ত দেশটিকে গণতন্ত্রের পথ ধরিয়েছিলেন। ৯৫ বছরের জীবন তিনি উৎসর্গ করেছিলেন সেই সংগ্রামের পথেই। 

টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট জুমা বলেন, পূর্ণ রাষ্ট্রীয় সম্মানে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে। তিনি জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দেন।

“প্রিয় দেশবাসী, আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট, আমাদের সবার প্রিয় নেলসন রোলিহ্লাহ্লা ম্যান্ডেলা চলে গেছেন,” বলেন জুমা।

“নিজের বাড়িতেই শান্তিপূর্ণভাবে তিনি মারা গেছেন।”

জুমার ওই ঘোষণার পরপরই বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে একের পর এক শোক বার্তা আসতে শুরু করে।  

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন, “এই পৃথিবীতে আমরা যাদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছি, তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সবেচেয়ে সাহসিদের একজন, সত্যিকারের একজন ভাল মানুষকে আমরা হারালাম।” 

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেন, “ম্যান্ডেলা ছিলেন আমাদের সময়ের মহানায়ক। পৃথিবীর এক আলোকবর্তিকা আজ নিভে গেল।” 

নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।  

১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই জন্ম নেয়া নেলসন ম্যান্ডেলা তার নিজের দেশের মানুষের কাছে অনেক বেশি পরিচিত  ‘মাদিবা’ নামে, এটি তার গোত্র নাম। নিজের গোত্রে অজ গ্রামীণ জীবন থেকেই তার উত্থান। সেখান থেকেই তিনি আন্দোলণ শুরু করেছিলেন সংখ্যালঘু শক্তিমান শ্বেতাঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে।

তার সেই তুলনারহিত সংগ্রাম তাকে দাঁড় করিয়েছে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে শ্রদ্ধাস্পদ ও ভালবাসার অন্যতম এক নেতা হিসেবে।

জুমা তার ভাষণে বলেন, “আমাদের জাতি এক অভিভাবক হারালো। এ দিনটি অনিবার্য জানলেও এ অতুলনীয় ও অমোচনীয় ক্ষতি আমাদের মন থেকে মুছে যাওয়ার নয়।” 

দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ে শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন তিনি।

৩০ বছরের সংগ্রামের পরে দেশটিতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গরা ধীরে ধীরে নমনীয় হতে শুরু করলে দেশ পুনর্গঠন ও ক্ষমা ঘোষণা করার ক্ষেত্রেও বিলম্ব করেননি মহান এই নেতা।

১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সব জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে প্রথম নির্বাচনে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি।

১৯৯৯ সালে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

১৯৯৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ নেতা এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্কের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে ম্যান্ডেলার সামনে ছিলো বর্ণবাদের ভিত্তিতে অসমতা ও বঞ্চনায় কয়েক যুগ ধরে পিষ্ট হতে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকাকে একত্রিত করার বিপুল কর্মযজ্ঞ।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে এ লক্ষ্যেই কাজ করে গিয়েছিলেন তিনি ও তার প্রশাসন।

তার এ লক্ষ্যযাত্রার মূল নিদর্শন ছিল ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’, যার মাধ্যমে বর্ণবাদবিরোধী দীর্ঘ সংগ্রামের সময়ে উভয়পক্ষের দ্বারা সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার করা হয়েছিলো।

এর মধ্যে দিয়ে জাতিগত দাঙ্গার ক্ষত সারিয়ে তোলা ছাড়াও, আত্মবিরোধ থেকেও বেরিয়ে আসার সুযোগ পায় দেশটির নাগরিকরা।

১৯৯৯ সালে ম্যান্ডেলা স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেন আধুনিক অর্থনীতিতে উন্নততর বোধ ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতাসম্পন্ন উত্তরসূরীদের হাতে।

দক্ষিণ আফ্রিকার বাইরে আফ্রিকার অন্যান্য দেশের নেতাদের জন্যও এটি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার পরে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় এইডস রোগের ছড়িয়ে পড়া রোধে কাজ শুরু করেন।

তার এ মিশন ব্যক্তিগত সংগ্রামে রূপ নেয় ২০০৫ সালে তার একমাত্র জীবিত ছেলে এ রোগে মারা যাওয়ার পরে।

২০১০ বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল খেলার সময় শেষবারের মতো জনসমক্ষে আসেন ম্যান্ডেলা।

সোয়েতোর সেই স্টেডিয়ামে ৯০ হাজার দর্শক দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে সেদিন তাকে স্বাগত জানায়।এই সোয়েতোতেই সংগ্রামের নেতা হিসেবে অভিষেক হয়েছিলো ম্যান্ডেলার।

১৯৬৩ সালে কুখ্যাত রিভোনিয়া ট্রায়ালে হত্যার অভিযোগে (ক্যাপিটাল অফেন্স) বিচারের সময় কাঠগড়ায় ম্যান্ডেলার দেয়া বক্তব্যটি তার রাজনৈতিক জীবন ও দর্শন সম্পর্কে তার সাক্ষ্য বহন করে।

তিনি বলেছিলেন, “আমার সারাজীবন আমি উৎসর্গ করেছি আফ্রিকার জনগণের সংগ্রামের প্রতি। আমি লড়েছি শ্বেতাঙ্গ শোষণের বিরুদ্ধে, আমি লড়েছি কৃষ্ণাঙ্গ শোষণের বিরুদ্ধেও।”