জ্বলন্ত দালানের আলোয় দুই নগরীর গল্প

পশ্চিম লন্ডনের যে সোশাল হাউজিং ব্লকে ২৪ তলা গ্রেনফেল টাওয়ার দিনভর জ্বলতে দেখা গেল দুদিন আগে, সেখান থেকে সামান্য হাঁটলেই অভিজাতদের পাড়া; মিলিয়ন পাউন্ডের সারি সারি নজরকাড়া সব বাড়ি।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 June 2017, 07:28 PM
Updated : 16 June 2017, 07:45 PM

বারা অব কেনসিংটন ও চেলসির খ্যাতির কথা ব্রিটেনের বাইরের লোকও জানে। নামী পপ তারকা, বিভিন্ন অঙ্গনের ‘সেলিব্রেটি’, ধনী ব্যাংকার আর সমাজের উঁচু তলার অনেকের বসবাস সেখানে।

ঐশ্বর্যের এই মানচিত্রে ওই সোশাল হাউজিং ব্লক যেন ক্ষুদ্র এক বঞ্চনার দ্বীপ, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে কয়লা হয়ে যাওয়া গ্রেনফেল টাওয়ার, যেখানে অন্তত ৩০ জনকে পুড়ে মরতে হয়েছে, যাদের অনেকের বিকৃত মরদেহ আর শনাক্ত করা যাবে না।

বুধবার প্রথম প্রহরে অধিকাংশ বাসিন্দা যখন ঘুমিয়ে পড়েছেন, হঠাৎ নরককুণ্ডে পরিণত হয় গ্রেনফেল টাওয়ার। ভাগ্যবান কেউ কেউ জীবিত বেরিয়ে আসতে পারলেও সর্বস্ব হারাতে হয়েছে তাদের।

ভয়াবহ এই বিপর্যয়ের হতবিহ্বলতা কাটিয়ে লন্ডনবাসী ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে অত্যন্ত ঔদার্যের সঙ্গে। যে পরিমাণ কাপড়, জুতা আর বিছানার চাদর তারা দান করেছেন, তা সামলাতে স্বেচ্ছাসেবীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। 

তবে পোড়া অঙ্গারের বিশাল স্তূপে পরিণত হওয়া ওই ভবন ঘিরে ক্ষোভও তৈরি হয়েছে।

মানুষ বলছে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার দিকটি আমলেই নেয়নি। তারা ধনীদের স্বার্থ রক্ষায় যতটা উদ্যোগী, গরিবের মঙ্গলের ব্যাপারে ততটাই উদাসীন।

গ্রেনফেল টাওয়ারের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পাওয়া সাহায্য গুছিয়ে রাখছেন স্বেচ্ছাসেবীরা

সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, লাখ পাউন্ড খরচ করে ওই টাওয়ারের বাইরের রূপ বদলের কাজ গত মে মাসে শেষ হয়। নীল আর সবুজ ধাতব আবরণ দিয়ে বাইরে থেকে মুড়ে ফেলা হয় ভবনটি।

মূলত কংক্রিটের কর্কশ চেহারা ঢেকে অবয়বে চাকচিক্য আনতে এবং ভবনের ভেতরের তাপ নিয়ন্ত্রণ সহজ করতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। দেয়াল থেকে সামান্য ফাঁক রেখে বৃষ্টি নিরোধক জিংক শিটে মোড়ানো ফোমের বোর্ড দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় ভবনের চারপাশ।  

এই কাজে সস্তা এবং অগ্নিনিরোধক নয়- এমন উপাদান ব্যবহার করায় পুরো ভবনে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে থাকতে পারে- এমন একটি সম্ভাবনার কথাও বলাবলি হচ্ছে।   

যারা এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন আলিয়া আল-গাব্বানি নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা, যিনি একটি প্রতিষ্ঠানে রিসিপশনিস্টের চাকরি করেন।

আলিয়া বলেন, “তাদের এই সৌন্দর্যবর্ধনের বিষয়টি সত্যিই বিরক্তিকর। কেন তারা এটা করতে গেল?... কারণ উল্টো দিকের দামি দামি বাড়িগুলোতে যারা থাকেন, এই ভবন তাদের চোখে খুব পীড়া দিচ্ছিল।”

তবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বলছে, ভবনের বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নত করতেই এ সংস্কার কাজ। আর ফায়ার সার্ভিস বলছে, আগুন কীভাবে ছড়াল, তা নিয়ে রায় দিয়ে ফেলার সময় এখনও আসেনি।

পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া ২৪ তলা গ্রেনফেল টাওয়ার

>> বারা অব কেনসিংটন ও চেলসির ল্যাঙ্কাস্টার ওয়েস্ট এস্টেটের একটি অংশে ওই সোশাল হাউজিং কমপ্লেক্সে বাড়ি আছে এক হাজার। ইংল্যান্ডের সবচেয়ে অবহেলিত এলাকার তালিকায় এ জায়গার অবস্থান ১০ নম্বরে।

>> এর মধ্যে ২৪ তলা গ্রেনফেল টাওয়ারের ১২৭টি ফ্ল্যাটে ৪০০ থেকে ৬০০ মানুষের বসবাস ছিল বলে স্থানীয় একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ধারণা।

>> অগ্নিকাণ্ডের কারণ এখনও জানা যায়নি। ফায়ার ফাইটাররা কেবল ১২ তলা পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলেন। ওই বাড়ি থেকে ৬৫ জনকে উদ্ধার করতে পেরেছেন তারা।  

>> অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস জানিয়েছে, ওই বাড়ি থেকে ৭৪ জনকে লন্ডনের ছয়টি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছেন ৭০ জনের মত। ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

অভিজাত এলাকা হল্যান্ড পার্ক থেকে দেখা গ্রেনফেল টাওয়ার

বৈষম্য

কমিউনিটি সংগঠক পিলগ্রিম টাকার গ্রেনফেল টাওয়ারের এই দুর্ভাগ্যজনক অগ্নিকাণ্ডকে দেখছেন সমাজের ওই অংশের মানুষের প্রতি দীর্ঘদিনের অবহেলার ফল হিসেবে। 

“এই সোশাল হাউজিংয়ে যারা থাকেন, তারা সবাই জানেন যে তারা অবহেলিত। সরকার যদি তার কাজ ঠিক মত করত, তাহলে আজ এ ঘটনা ঘটত না।”

টাকারের মত অনেকেই বলছেন, স্থানীয় বাসিন্দারা অনেকদিন ধরে অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথা বলে এলেও কর্তৃপক্ষ তাতে কান দেয়নি।

লন্ডনে স্মরণকালের এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের প্রভাব পড়েছে রাজনীতিতেও।

কম কর আদায় ও ব্যবসাবান্ধব নীতির পক্ষে থাকা ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভরা গত সপ্তাহের নির্বাচনে জনকল্যাণে ব্যয় বাড়ানোর পক্ষে থাকা লেবারদের কাছে অনেক আসন হারিয়েছে।

পুড়ে যাওয়া গ্রেনফেল টাওয়ার যে সংসদীয় আসনে দাঁড়িয়ে আছে, সেই কেনসিংটনেও ব্রিটেনের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো লেবার প্রার্থী জয়ী হয়েছে।

ধনী এলাকার মানুষ দেখছে, দূরে পুড়ছে গ্রেনফেল টাওয়ার

নবনির্বাচিত এমপি এমা ডেন্ট কোড অগ্নিকাণ্ডের পরপরই স্থানীয় এক পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কাউন্সিল কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করে বলেছেন, চাইলেই এ ঘটনা এড়ানো যেত।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থলে যান। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা না বলে কেবল দমকল সদস্যদের সঙ্গে কথা বলায় তিনি সমালোচনার মুখে পড়েন।

অন্যদিকে লেবার নেতা জেরেমি করবিন স্থানীয় একটি চার্চ পরিদর্শন করে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবকদের খোঁজ খবর নিয়ে এলাকাবাসীর মন জিতে নিয়েছেন। বিদায়ের সময় উদাত্ত কণ্ঠে করবিনকে ধন্যবাদ জানাতে দেখা যায় স্থানীয়দের।

করবিন সেখানে সাংবাদিকদের বলেন, কেনসিংটন যে একের ভেতর দুই নগরীর গল্প, এই সত্য কোনোভাবেই এড়ানো যায় না।

“এই এলাকার দক্ষিণাংশের বাসিন্দারা ভয়ঙ্কর রকমের ধনী। পুরো দেশের মধ্যেই সবচেয়ে ধনী এলাকা এটা। আর যে ওয়ার্ডে অগ্নিকাণ্ড হল, আমার ধারণা, সেটি পুরো দেশের মধ্যেই সবচেয়ে দরিদ্র।”

কেনসিংটন টাউন হলে বৈষম্যের প্রতিবাদ

ভেদরেখা

যে ব্লকে গ্রেনফেল টাওয়ারের অবস্থান তার লাগোয়া এলাকা নটিং ডেলে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের বসবাস।

১৯৭০ এর দশকে গড়ে তোলা এই হাউজিং এস্টেট ঘিরে চমৎকার যে রাস্তাগুলো গেছে, তার পাশে লাইন ধরে রয়েছে স্বচ্ছল পেশাজীবীদের ব্যক্তিগত বাড়ি। বনেদি এলাকা হল্যান্ড পার্ক সেখান থেকে মিনিটখানেকের পথ।   

অগ্নিকাণ্ডের পর ক্ষোভের মধ্যেও নটিং ডেলে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এক হয়েছে। তুলনামূলকভাবে ধনী অনেকে তাদের বাড়ির দরজা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য খুলে দিয়েছেন।

পুড়ে যাওয়া গ্রেনফেল টাওয়ারের ছয় বাসিন্দার জন্য নিজের বাড়ির নিচতলা ছেড়ে দিয়েছেন নটিং ডেলের আনাবেল ডোনাল্ড। যে রাতে আগুন লাগে, এই বৃদ্ধা সেদিন ছুটে গিয়েছিলেন স্থানীয় চার্চে আশ্রয় নেওয়া মানুষকে সাহায্য করতে।

তাদের জন্য নিজে হাতে চা বানিয়েছেন, বাচ্চাদের জন্য খেলনা জোগাড় করেছেন, এমনকি টয়লেটও পরিষ্কার করেছেন তিনি, কারণ বহু মানুষকে তখন চার্চের ওই টয়লেট ব্যবহার করতে হচ্ছে।  

রাস্তার অন্যপাশে তুলনামূলকভাবে ধনীদের অংশে বসবাস হলেও আনাবেল ডোনাল্ড সোশাল হাউজিংয়ের ক্ষতিগ্রস্তদের মতই স্থানীয় কর্তৃপক্ষের একচোখা নীতিকে এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করেছেন।

“যারা কম সুবিধা পায়, তারা মনে করছে, তারা আসলে কিছুই পায় না; সবকিছু সুবিধাভোগীদের পেটেই যায়। আমার মনে হয়, তাদের এই অনুভূতিতে ভুল নেই।”

তার ভাষ্য, স্থানীয় কাউন্সিল ধনীদের কাছ থেকে অনেক কম ট্যাক্স নেয়; যা চাইলেই বাড়ানো যায় এবং তা গরিব মানুষের জন্য ব্যয় করা যায়।

এমনকি নিজে আরও বেশি কর দিতেও প্রস্তুত বলে জানান ডোনাল্ড, কেননা তাতে একটি শ্রেণির মানুষের উপকার হবে। 

[রয়টার্স অবলম্বনে তৈরি এই প্রতিবেদনে বিবিসি থেকেও তথ্য নেওয়া হয়েছে।]