ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: দ্বিতীয় দফা ভোটের মুখে ল্য পেন-মাক্রোঁ 

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফায় মধ্যপন্থি প্রার্থী এমানুয়েল মাক্রোঁ এবং কট্টর-ডানপন্থি প্রার্থী মেরিন ল্য পেন জয়ী হয়েছেন বলেই আভাস পাওয়া গেছে ভোটের অনুমিত ফলে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 April 2017, 03:55 AM
Updated : 23 April 2017, 07:02 PM

ফরাসি টিভি জানিয়েছে, মাক্রোঁ পেয়েছেন ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট এবং ল্য পেন পেয়েছেন ২১ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট।

অন্যদিকে, আরও দুইজন প্রার্থীর মধ্যে রক্ষণশীল দলের প্রার্থী ফ্রঁসোয়া ফিয়ঁ পেয়েছেন ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ এবং কট্টর বাম প্রার্থী জঁ লুক মেলাঁশোঁ পেয়েছেন ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট। 

এ দুই প্রার্থীর তুলনায় ল্য পেন এবং মাক্রোঁ বেশি ভোট পাওয়ায় তারা ৭ মে দ্বিতীয় দফা ভোটের মুখোমুখি হয়েছেন।

তিন দিন আগে রাজধানী প্যারিসে পুলিশের ওপর চালানো প্রাণঘাতী হামলার পর কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে রোববার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিয়েছে জনগণ।

৫০ হাজার পুলিশ এবং ৭ হাজার সেনার কড়া পাহারার মধ্যেও নির্বাচনে প্রায় ৮০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে প্যারিসে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভোটের দিন এ কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

স্থানীয় সময় সকাল ৮টায় দেশজুড়ে ৬৭ হাজার ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরু হয় এবং চলে একটানা রাত ৮টা পর্যন্ত। কোনও প্রার্থীই ৫০ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দুইপ্রার্থীকে ৭ মে আরেক দফা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এ রান-অফ ভোটে জয়ী প্রার্থীই হবেন ফ্রান্সের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট।

ইউরোপের ভবিষ্যৎতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় বিশ্বজুড়ে পর্যবেক্ষকরা এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন। ফ্রান্সের নতুন প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য মোট ১১ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। সামনের সারির চার প্রার্থীর মধ্যে চরম ডানপন্থি থেকে চরম বামপন্থি প্রার্থীও রয়েছেন।

জনমত জরিপগুলোর ফলাফলে এগিয়ে থাকা চার প্রার্থীর মধ্যে কট্টর-ডানপন্থি দল ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এফএন) প্রার্থী মারিন ল্য পেন এবং তার সঙ্গে ‘এগিয়ে চল’নামের এক আন্দোলনের নেতা উদার মধ্যপন্থি এমানুয়েল মাক্রোঁর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল আগে থেকেই।

মধ্য-ডানপন্থি রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ফ্রঁসোয়া ফিয়ঁ আগের জনমত জরিপগুলোতে এগিয়ে থাকলেও সরকারি তহবিল তছরুপের অভিযোগে তদন্তের মুখে থাকায় কিছুটা পিছিয়ে পড়েন, তবে এগিয়ে থাকা প্রথম চার প্রার্থীর অন্যতম ছিলেন তিনি।

সামনের সারির চার প্রার্থীর অপরজন ছিলেন কট্টর-বামপন্থি প্রার্থী জঁ লুক মেলাঁশোঁ, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিকে তার প্রতি জনসমর্থন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।

আধুনিক ফ্রান্সের ইতিহাসে এই প্রথম ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচনে প্রার্থী হননি। সমাজতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া অলন্দের জনপ্রিয়তা তলানিতে নেমে যাওয়াই এর কারণ।

সর্বশেষ জনমত জরিপগুলোর ফল বলছে, মারিন ল্য পেন (৪৮) ও এমানুয়েল মাক্রোঁর (৩৯) মধ্যে দ্বিতীয় দফা (রান-অফ ভোট) ভোটে মাক্রোঁরই জয়ের সম্ভাবনা বেশি, আর তা হলে ফ্রান্সের সবচেয়ে কম বয়সী প্রেসিডেন্ট হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করবেন তিনি।

জয়ী প্রার্থী আগামী ১৪ মে-র মধ্যে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া অলন্দের কাছ থেকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন।

বেশ কিছু কারণে ফ্রান্সের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আন্তর্জাতিক মহলে বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, এর আগে কখনও দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এতো অনিশ্চয়তা দেখা যায়নি।

দ্বিতীয় কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ভবিষ্যৎ এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর অনেকটা নির্ভর করছে। ল্য পেনের মতো ইইউ-বিরোধী ও জোটের একক মুদ্রা ইউরো-বিরোধী নেত্রী ক্ষমতায় এলে ইইউ-র ভবিষ্যৎ অনিশ্চিতার মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।                         

অন্যদিকে, এমানুয়েল মাক্রোঁ ইউরোপীয় ইউনিয়নের জোরালো প্রবক্তা৷ তিনি জার্মানির সমর্থন নিয়ে ইউরোপে সামাজিক সুরক্ষার কাঠামো আরও জোরদার করতে চান৷

এই দুই বিপরীতমুখী প্রার্থীর যে কোনও একজনের জয়ই ইইউ য়ে ফ্রান্সের সদস্যপদকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেবে। ফ্রান্স এ জোটে থাকবে কি থাকবে না সে প্রশ্ন দেখা দেবে এবং ফ্রান্স যদি বেরিয়ে যায় তাহলে অন্যতম এ প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের প্রস্থানে ইইউ টিকবে কিনা সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে পড়বে।

ফলে যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট এবং যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প আগমনের ধাক্কার পর ফ্রান্সও রাজনীতিতে ধাক্কা খাওয়া পরবর্তী দেশ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে।

এবারের ফ্রান্সের নির্বাচনে নতুন কি ঘটছে?

অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া অলন্দ দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনে অংশ নেননি।

প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ১১ জন হওয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে ব্যাপক পরিসরে। নির্বাচনের প্রথম ধাপে কেউই ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়ায় ৭ মে তে দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে যেতে হচ্ছে।

ফ্রান্সের রাজনীতির ইতিহাসে সাধারণত বাম পার্টি এবং মধ্য-ডান পার্টিরগুলোরই প্রাধান্য দেখা গেছে। কিন্তু এবারের নির্বাচনে এই মডেল ভেঙে যেতে পারে।

নির্বাচনী ইস্যুগুলো কি?

ফ্রান্সের ভোটাররা সবচেয়ে তীব্র যে সমস্যাটি ভোগ করছে তা হচ্ছে বেকারত্ব। বেকারত্ব প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। ২৮ জাতি ইইউ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে এদিক থেকে ফ্রান্স রয়েছে শীর্ষ ৮ম স্থানে। ২৫ বছরের নিচে চারজনে একজন বেকার।

২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে ফ্রান্স খুব ধীরে ধীরে উন্নতি করেছে এবং প্রথম সারির সব প্রেসিডেন্ট প্রার্থীই বলেছে আরও অনেক বেশি পরিবর্তন প্রয়োজন।

নতুন প্রেসিডেন্ট এ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়েই ক্ষমতায় আসবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) হিসাবকষে বলছে, বেকারত্বের হার ৮ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে ফ্রান্নকে হিমশিম খেতে হবে।

নিরাপত্তা পরিস্থিতি:

নিরাপত্তাও এবারের নির্বাচনে একটি বড় ইস্যু। বিশেষ করে সদ্য প্যারিসে ঘটে যাওয়া হামলার পর।

ফ্রান্সে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সন্ত্রাসী হামলায় ২৩০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দেশটি জরুরি অবস্থার মধ্যে রয়েছে।

কর্মকর্তাদের আশঙ্কা হাজার হাজার মুসলিম ফরাসি তরুণ যারা সিরিয়া এবং ইরাকে যুদ্ধে যোগ দিতে গেছে তারা নতুন করে হামলা করার জন্য ফ্রান্সে ফিরে আসতে পারে।

অনেকে ধারণা করছে, জঙ্গি হামলার কারণে নির্বাচনে ডানপন্থি প্রার্থী বিশেষ করে ল্য পেনের জয়ের সম্ভাবনা বাড়তে পারে। ল্য পেন ফ্রান্সে সব বৈধ অভিবাসন বাতিল করা এবং বিদেশিদের চেয়ে ফরাসিদেরকেই চাকরি, জনকল্যাণ, বাসস্থানসহ সব সুযোগ সুবিধা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।