দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট দুর্নীতির দায়ে অপসারিত

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পার্ক জিউন-হাইকে দুর্নীতির দায়ে অপসারণ করেছে দেশটির সাংবিধানিক আদালত।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 March 2017, 03:00 AM
Updated : 10 March 2017, 07:54 AM

তিন মাস আগে পার্লামেন্টের ভোটাভুটিতে প্রেসিডেন্ট পার্ককে অভিশংসনের যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল,শুক্রবার দক্ষিণ কোরিয়ার সাংবিধানিক আদালত তা বহাল রাখে। 

দক্ষিণ কোরিয়ায় সাবেক সেনাশাসক পার্ক চুং-হির মেয়ে পার্ক জিউন-হাই দক্ষিণ কোরিয়ায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান, যাকে অভিশংসিত হতে হল।

বিবিসি এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই রায়ের ফলে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পুরোপুরি অপসারিত হলেন ৬৫ বছর বয়সী পার্ক।

সংবিধান অনুযায়ী, এখন ৬০ দিনের মধ্যে নতুন একজনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করতে হবে দক্ষিণ কোরীয় নাগরিকদের।

অভিশংসিত হওয়ায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়মুক্তির সুযোগও হারাচ্ছেন পার্ক। তাকে এখন দুর্নীতির দায়ে বিচারের মুখোমুখি করা যাবে।

বিবিসি জানিয়েছেন, শুক্রবার আদালতের রায়ের পর সেউলের বিভিন্ন সড়কে উল্লাসে মেতে ওঠেন পার্কের অপসারণের দাবিতে আন্দোলনকারীরা। 

অন্যদিকে সমর্থকরা আদালতের বাইরে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। পার্কের ছবি নিয়ে কাঁদতে দেখা যায় তাদের অনেককে। পুলিশের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তিও হয়।

দক্ষিণ কোরিয়ার বার্তা সংস্থা ইয়োনহাপ জানায়, বিক্ষোভের মধ্যে অন্তত দুইজনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের একজন মারা গেছেন পুলিশ ভ্যান থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পান।

সায়েনুরু পার্টির শীর্ষ নেতা পার্ক জিউন-হাই ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ কোরিয়ার একাদশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তিনিই প্রথম নারী, যিনি রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পেয়েছিলেন।

দায়িত্ব নেওয়ার সময় তুমুল জনপ্রিয়তা থাকলেও ২০১৪ সালে সেউলে ফেরিডুবির ঘটনায় ৩০৪ জনের মৃত্যুর পর তার এবং দলের জনপ্রিয়তা কমাতে থাকে। সরকার তড়িৎ ব্যবস্থা না নেওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে বলে তখন বিরোধীদলগুলো অভিযোগ করেছিল।

ব্যক্তিগত লাভের লক্ষ্যে এক পুরোনো বন্ধুকে সুবিধা পাইয়ে দিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যবহার করেছেন এমন অভিযোগে গতবছরের মাঝামাঝি সময়ে সংসদে ও রাজপথে পার্কের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়।

এক পর্যায়ে তিনি পদত্যাগ করতে চাইলেও বিরোধীরা তার বিরুদ্ধে অভিশংসনের প্রস্তাব আনে।গতবছর ৯ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার পার্লামেন্টে ওই প্রস্তাব ২৩৪-৫৬ ভোটে অনুমোদন পায়।

নিজ দলের পার্লামেন্ট সদস্যরাও সেদিন পার্কের অভিশংসনের পক্ষে ভোট দেন বলে ধারণা করা হয়।

পার্লামেন্টের অভিশংসনের পর পার্কের ক্ষমতা চলে যায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে।  শুক্রবার নয় সদস্যের সাংবিধানিক আদালত অভিশংসনে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়।

 

এক নজরে পার্ক জিউন-হাই

>> ১৯৫২ সালে দক্ষিণের তায়েগু শহরে জন্ম নেন পার্ক জিউন-হাই । তার বাবা সেনাশাসক পার্ক চুং-হি ১৯৬১ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তার মৃত্যু হয় নিজের গোয়েন্দা প্রধানের হাতে।

>> পার্কের মা ইয়াক ইয়ং-সো ১৯৭৪ সালে উত্তরকোরীয় আততায়ীর ছোড়া গুলিতে নিহত হন। গুলিটি পার্ক চুং-হি কে লক্ষ্য করে ছোড়া হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। মায়ের মৃত্যুর পর কিছুদিন ভারপ্রাপ্ত ‘ফার্স্ট লেডি’র দায়িত্ব পালন করেন পার্ক জিউন-হাই।

 >> অনেক বছর নীরব থাকার পর ১৯৯৮ সালে ফের রাজনীতিতে আসেন পার্ক জিউন-হাই। ওই বছর দেশকে এশিয়ার অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বাঁচানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

>> ২০০৪ সালে পার্ক দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধান রক্ষণশীল দল গ্র্যান্ড ন্যাশনাল পার্টির (জিএনপি) শীর্ষ নেতা নির্বাচিত হন। দুর্নীতির অভিযোগে জিএনপির জনপ্রিয়তা নিচের দিকে নামতে থাকলেও, পার্কের নেতৃত্বগুণে সংসদীয় নির্বাচনে দল ভাল ফল করে।

>> ২০০৬ সালে এক নির্বাচনী র্যালিতে পার্কের গালে ছুরি চালিয়ে দেয় এক হামলাকারী।

>> ২০১১ সালে জিএনপির নাম বদলে রাখা হয় সায়েনুরি। পরের বছরের নির্বাচনে পার্ক উদারপন্থি প্রার্থী মুন জায়ে-ইনকে পরাজিত করে দেশের প্রেসিডেন্ট হন। ২০১৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন তিনি।

>> নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর প্রথম মাসের ভাষণের খসড়া বন্ধু চই সুন-সিলকে দেখতে দেওয়ার কথা স্বীকার করে ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর প্রথমবারের মত জনসম্মুখে ক্ষমা চান পার্ক। রাষ্ট্রীয় বিষয়ে প্রভাব খাটানোর অভিযোগে ৩১ অক্টোবর চই সুন-সিলকে আটক করা হয়।

>> ৪ নভেম্বর টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে দ্বিতীয়বার ক্ষমা চান পার্ক, বলেন কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে তার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তিনি তার দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত।

>> দুই সপ্তাহ পর চইয়ের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও জালিয়াতি প্রচেষ্টার অভিযোগ আনা হয়। ২৯ নভেম্বর পার্ক আবারও জনগণের কাছে ক্ষমা চান; তার বিরুদ্ধে চলা বিক্ষোভের রেশ ধরে পদত্যাগ করতে পার্লামেন্টের সহায়তাও চান তিনি।

>> ৯ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার পার্লামেন্টের ভোটাভুটিতে প্রেসিডেন্ট পার্ককে অভিশংসনের প্রস্তাব অনুমোদন পায়।

 

পার্ক ও তার বন্ধু চই দুজনই তাদের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন প্রথম থেকে। চলতি বছরের শুরুতেও পার্ক বলেছেন, তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ ‘মিথ্যা ও সাজানো’।

ফেব্রুয়ারিতে প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্যামসাংয়ের শীর্ষ নির্বাহী জে ওয়াই লিকে দুর্নীতির অভিযোগে আটক করা হয়। মার্চের ৬ তারিখ দক্ষিণ কোরীয় আদালতের এক বিশেষ প্রসিকিউটর জানান, স্যামসাংয়ের কাছ থেকে চই-এর ঘুষ নেওয়ার সঙ্গে পার্কেরও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।

এ কারণে চূড়ান্তভাবে অভিশংসিত হওয়ার পর পার্ককে বিচারের মুখোমুখি করা হবে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি।

তিনদিন পর ঘুষ ও আত্মসাতের অভিযোগে স্যামসাং প্রধানের বিচার শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর মধ্যে চইকে ৩৮ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দেওয়ার প্রতিশ্রুতির অভিযোগও রয়েছে।

লি এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা পার্ক ও চইয়ের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।