ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে মাত্র ৮ দিন টিকেছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুমানা

বারাক ওবামার সময়ে হোয়াইট হাউজে চাকরিতে ঢুকে পাঁচ বছরের বেশি কাজ করলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আটদিনের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কার্যালয় ছেড়েছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুমানা আহমেদ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Feb 2017, 06:48 PM
Updated : 25 Feb 2017, 05:55 PM

গত ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া ট্রাম্প মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সাত দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নির্বাহী আদেশ দেওয়ার পর পদত্যাগ করেন রুমানা।

পদত্যাগের প্রায় এক মাস পর বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যম ‘দ্য আটলান্টিক’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে ‘মুসলিম প্রবেশে বাধার’ ওই আদেশের প্রতিবাদে পদত্যাগ করার কথা জানান সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলে কাজ করা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই নারী।

তবে ইতোমধ্যে সাত দেশের নাগরিকদের প্রবেশে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেওয়া ট্রাম্পের ওই নির্বাহী আদেশ আদালতে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে সাময়িকভাবে আটকে গেছে।

রুমানা লেখেন, “যে প্রশাসন আমাকে ও আমার মতোদের (মুসলিমদের) যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ভাবার বদলে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে, সেখানে আমার পক্ষে কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।”

যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসী বাংলাদেশি বাবা-মায়ের সন্তান রুমানা লেখায় তার বাবা-মায়ের বাংলাদেশি পরিচয়ও তুলেন।

১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যান রুমানার বাংলাদেশি বাবা-মা। তারা ওয়াশিংটন ডিসির কাছে ম্যারিল্যান্ডে উঠেছিলেন, যেখানে জন্ম হয় তার। শুরুতে ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ শুরু করা রুমানার মা পরে তার ‌‌‘ডেকেয়ার’ ব্যবসা চালু করেন। আর তার বাবা ব্যাংক অব আমেরিকায় কাজ শুরু করে পদোন্নতি পেয়ে একটি সদরদপ্তরের সহকারী উপপ্রধান পর্যন্ত হয়েছিলেন।

তবে ‘আমেরিকান স্বপ্ন’ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া রুমানার বাবা পিএইচডি করার সময় ১৯৯৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।

জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে ২০১১ সালে হোয়াইট হাউজের চাকরিতে যোগ দেওয়া রুমানা মুসলিম হিসেবে বারাক ওবামার সময়ের প্রশাসনে স্বচ্ছন্দপূর্ণ কাজের পরিবেশ পাওয়ার কথা বলছেন তার লেখায়।

২০১৫ সালে হোয়াইট হাউজে বারাক ওবামার সঙ্গে রুমানা। ছবি: হোয়াইট হাউজ

নিজেকে ‘হিজাব’ পরা মুসলিম নারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে রুমানা বলছেন, “ওয়েস্ট উইংয়ে (হোয়াইট হাউজের এক্সিকিউটিভ অফিস ভবন) আমিই ছিলাম একমাত্র হিজাবি।

“ওবামা প্রশাসন আমাকে নিজেদের করে নিয়ে সব সময় স্বচ্ছন্দ অনুভূতি দিয়েছে।”

গত বছরের নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়ের পর ব্যক্তিগতভাবে অস্বস্তিবোধ করলেও দেশের সেবায় নিরাপত্তা কাউন্সিলে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জানিয়ে রুমানা লিখেছেন, কিন্তু ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর আটদিনের বেশি তার পক্ষে সেখানে থাকা সম্ভব হয়নি।

অস্বস্তিবোধ করার পেছনে কিছু কারণের পাশাপাশি ট্রাম্প যুগে হোয়াইট হাউজের কয়েকটি অভিজ্ঞতাও ওই নিবন্ধে লিখেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের এই নারী।

রুমানা বলছেন, ট্রাম্পের অভিবাসী ও মুসলিম বিদ্বেষী নির্বাচনী প্রচারণাকে প্রথমদিকে ‘বাকোয়াজ’ ভাবলেও তা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মনে নেতিবাচক ছাপ রাখছিল দেখতে পারছিলেন।

ট্রাম্পের বিজয়ের পর ২০১৬ সালের শেষের দিকে চারদিকের পরিবেশ বদলে ৯/১১ এর পরের পরিবেশের মতো হয়ে যাচ্ছিল; যখন কিনা মুসলিম হিসেবে সাদাদের সন্দেহ আর ভয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে।

এবার কোস্টকো পার্কিং লটের কাছে সাদা চামড়ার এক ব্যক্তি তাকে প্রায় হাসতে হাসতে গাড়ি ধাক্কা দিতে যাচ্ছিল। আরেকদিন এক ব্যক্তি তাকে মেট্রো ট্রেন পর্যন্ত অনুসরণ করে উচ্চস্বরে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে বলেছিল, “ট্রাম্প তোকে ফেরত পাঠাবে।”

নির্বাচনী প্রচারণায় ধর্ম-বর্ণ-জাতি নিয়ে যার বিদ্বেষী বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে এমন সব আচরণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, সেই ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউজের নেতৃত্বে এলে পরবর্তী পরিস্থিতি কী হতে পারে তা নিয়ে শঙ্কা থাকলেও, রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত না হওয়ায় চাকরিতে থেকে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন রুমানা।

এসময় সহকর্মীদের অনেকেই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই তরুণীর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করলেও তার মতো একজন বাদামী চামড়ার হিজাব পরা নারী ও মুসলিম আমেরিকান দেশপ্রেমিকের কাছ থেকে ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল উপকৃত হতে পারে বলে ভাবছিলেন তিনি।

এরপর নিবন্ধে বাংলাদেশি বাবা-মায়ের এই মেয়ে বলছেন, নতুন প্রেসিডেন্টের শপথের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে তিনি ও তার সহকর্মীরা নতুন সহকর্মীদের সঙ্গে পরিচিত হতে উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করলেও যা এসেছিল তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।

প্রকৃতপক্ষে ওবাম প্রশাসনের অধীনে প্রথমবার হোয়াইট হাউজে কাজ করতে আসার সময়ের মতোই উত্তেজনায় ছিলেন রুমানা।

কিন্তু ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্টের শপথের পর প্রথম কর্মদিবস ২৩ জানুয়ারি সোমবারে ট্রাম্প প্রশাসনে নতুন সহকর্মীদের সঙ্গে পরিচিত হতে হেঁটে আইজেনহোয়ার এক্সিকিউটিভ অফিস ভবনে যান, সেসময়ের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি লেখেন, “নতুন সহকর্মী একটা শীতল আশ্চর্য ভাব নিয়ে আমার দিকে তাকাল।

“যে (ধর্ম ও জাতিগত) বৈচিত্র্যের হোয়াইট হাউজে আমি কাজ করে এসেছি, তা যেন একমুখী ও পুরুষাধিপত্যের হয়ে এসেছিল।”

তিনি বলেন, “যে কটা দিন আমি ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে পার করেছি, তা ছিল অদ্ভূত, অস্বস্তিকর ও বিরক্তিকর। রিগ্যান প্রশাসনের সময় থেকে কাজ করা এক কর্মকর্তা বলেন, ‌‘এই জায়গাটা (হোয়াইট হাউজ) পুরো উল্টে গেছে। এটার এই জগাখিচুড়ি, আমি এর আগে কখনও এমন অবস্থা দেখিনি।’”

২৩ জানুয়ারি থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কাজ শুরু করে আটদিনের মাথায় পদত্যাগ করেন রুমানা।

তিনি বলছেন, “আমি হয়ত আরও কিছুদিন থাকতে পারতাম। কিন্তু সাত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের ভ্রমণকারীদের নিষিদ্ধ করে নির্বাহী আদেশ আমেরিকাকে কোনোভাবে বেশি নিরাপদ না করে বিশৃঙ্খলার কারণ হল।বিমানবন্দরে বছরের পর বছর ধরে চলা বৈষম্য বৈধতা পেল।”

নিরাপত্তা কাউন্সিলের যোগাযোগ উপদেষ্টা মাইকেল এন্টন তাকে পদত্যাগ করে কোথায় যাবেন জানতে চাইলেও কেন পদত্যাগ করছেন তা জানতে চাননি বলে লেখায় জানান মুসলিম এই তরুণী।

তারপরও নিজ থেকেই মাইকেল এন্টনকে রুমানা বলেছিলেন, ট্রাম্পের মুসলিম আগমন নিষিদ্ধ ঘোষণার পর কাজ চালিয়ে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

রুমানা লিখেছেন, “আমি তাকে জানাই, (এই ঘোষণার পর) দেশের সবচেয়ে ঐতিহাসিক এই ভবনে প্রতিদিন প্রবেশ করা আমার জন্য রীতিমতো অপমানজনক একটি ব্যাপার হয়ে উঠেছে। একজন আমেরিকান ও মুসলিম হিসেবে আমি যা বিশ্বাস করি, এই প্রশাসন তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।”