২০১৬ সালে এই সব কিছু ছাপিয়ে গণমানুষের রাজনৈতিক ভাবনায় বড় পরিবর্তনের ইংগিত দিচ্ছে ব্রেক্সিট ও কলম্বিয়ার গণভোট, ইউরোপে উগ্র ডানের অব্যাহত উত্থান আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
এই প্রবণতাকে ‘আম জনতার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক কাঠামো প্রত্যাখ্যানের প্রকাশ’ চিহ্নিত করেছেন কেউ কেউ। বার্লিন প্রাচীরের পতনের বছর ১৯৮৯ কে ‘মুক্ত গণতন্ত্রের বিকাশের বছর’ হিসেবে ধরে ২০১৬ সালের পৃথিবীকে ঠিক তার উল্টো অবস্থানে দেখতে পাচ্ছেন ব্রিটিশ রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার টিমোথি গার্ডন অ্যাশ।
যুক্তরাজ্যের ইংরেজি দৈনিক গার্ডিয়ান ২০১৬ সালকে চিহ্নিত করেছে ‘রাজনৈতিক ভূমিকম্পের বছর’ হিসেবে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার পাশাপাশি এ বছর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে দেখেছে বিশ্ব। অন্যদিকে এশিয়ায় চীনের প্রভাব অব্যাহতভাবে বাড়ছে।
ফাঁস হওয়া হাজারও দলিলপত্রে বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের করফাঁকির যে খবর ২০১৬ সালে মানুষ পেয়েছে, তার মাত্রা ভূমিকম্পের চেয়ে কম ছিল না। মাদক কেলেঙ্কারির কারণে রাশিয়ার ক্রীড়াবিদদের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল এ বছর ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম আলোচিত বিষয়।
ঘূর্ণিঝড়-বন্যা-ভূমিকম্পের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর দুর্ঘটনায় প্রাণহানির বিভিন্ন ঘটনা এ বছরও সংবাদ শিরোনামে এসেছে। বিভিন্ন দেশে সংঘাতে প্রাণ গেছে বহু মানুষের।
বছরের শুরুতে জিকা ভাইরাস চোখ রাঙালেও বছরের শেষ প্রান্তে এসে প্রকোপ কমেছে তার। বছরের শেষ দিকে এসে ডলারের অবস্থান শক্তিশালী হতে শুরু করেছে; জ্বালানি তেলের দামও একটু একটু করে বাড়ছে, তেলনির্ভর ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতির দেশগুলোকে দেখাচ্ছে আশার আলো।
এ বছরই একজন নতুন মহাসচিব পেয়েছে জাতিসংঘ। পর্তুগালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আন্তোনিও গুতেরেস জাতিসংঘ প্রধান হিসেবে বিশ্বকে শান্তির পথে এগিয়ে নিতে কতোটা সাফল্য পাবেন- তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে আগামী পাঁচটি বছর।
এ বছর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় চমক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন নিউ ইয়র্কের ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি রীতিমত ভূমিকম্প ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
নির্বাচনের আগে অভিবাসী ও নারীদের নিয়ে নানান মন্তব্যের জন্য সমালোচিত ট্রাম্পের পরাজয়ের ইঙ্গিত ছিল গণমাধ্যমগুলোর সব জরিপে। ডেমোক্রেটিক প্রার্থী ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি তাকে সহজেই হারাবেন বলে ধারণা করা হলেও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য ফিরিয়ে আনার জিগির তুলে পাশার দান উল্টে দিয়েছেন এ রিয়েল এস্টেট মোগলই।
পপুলার ভোটে হিলারির চেয়ে ২৮ লাখ ভোট কম পেলেও হোয়াইট হাউজে যেতে প্রয়োজনীয় ইলেকটোরাল ভোট ঠিকই জিতে নেন ট্রাম্প।
যুক্তরাজ্যর লেবার নেতা জেরেমি করবিন যুক্তরাষ্ট্রের ভোটের ফলকে ব্যাখ্যা করেছেন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক কাঠামোর বিরুদ্ধে জনগণের প্রত্যাখ্যানের প্রতীক হিসেবে।
ট্রাম্পের জয় যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা ও পররাষ্ট্রনীতিতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। ট্রাম্প তার পরবর্তী প্রশাসনের জন্য দলের মধ্যেও কট্টরপন্থি হিসেবে পরিচিতদের বেছে নিয়ে সেই ধারণার পালে আরও হাওয়া দিয়েছেন।
ক্ষমতায় গেলে ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন; তার প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন প্রক্রিয়া কঠোর করা, মুসলিম অভিবাসীদের প্রবেশে বাধা দেয়া। আছে মেক্সিকোর সঙ্গে দেয়াল নির্মাণেরও ঘোষণা। তবে নির্বাচনে জেতার পর এসব বিষয়ে ‘নরম সুর’ শোনা গেছে তার কণ্ঠে।
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও এবার আরও কয়েকটি দেশের প্রেসিডেন্টরা খবরের পাতায় জায়গা করে নিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রৌসেফ ও দক্ষিণ কোরিয়ার পার্ক জিউন হাই। দুজনকেই দুর্নীতির অভিযোগে অভিশংসিত হতে হয়েছে।
ট্রাম্পের মতই বছরজুড়ে আলোচনায় ছিলেন ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট রদরিগো দুতের্তে। ট্রাম্পের মত সব সমালোচনা ঠেলে ভোটে জিতেছেন তিনিও। মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে কট্টরপন্থী দুতের্তে বিনাবিচারে মানুষ হত্যা করছেন বলে অভিযোগ করে আসছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
লাওসে আসিয়ান সম্মেলনে বারাক ওবামাকে ‘গণিকার সন্তান’ বলে নিন্দা কুড়ানো দুতের্তে দাভাওয়ের মেয়র থাকাকালে নিজহাতে তিনজনকে হত্যার কথা স্বীকার করে নিয়ে আরেক দফা খবরের শিরোনাম হন বছরের শেষভাগে।
প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক কাঠামোর বিরুদ্ধে জনগণের প্রত্যাখ্যানের আরেকটি বড় নজির ছিল এবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে যুক্তরাজ্যের গণভোটের ফল। সব প্রচারমাধ্যমের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ করে, শক্তিশালী বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর আহ্বান উপেক্ষা করে যুক্তরাজ্যের জনগণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার (ব্রেক্সিট) পক্ষে রায় দেয়।
ভোটের মানচিত্রে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের উত্তর অংশ ইইউতে থাকার পক্ষে থাকলেও দক্ষিণের প্রায় পুরো অংশ ছিল জোট ছাড়ার পক্ষে। এজন্য ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে বিচ্ছেদপন্থিরা জয়ী হলেও স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডে দেখা গেছে উল্টো চিত্র।
ভোটের আগে বেক্সিটপন্থিরা বলছিল, অভিবাসীদের ব্রিটেনে আসা বন্ধ করতেই মনোযোগ তাদের। বিশেষ করে ইউরোপ থেকে কেউ যাতে অবাধে যুক্তরাজ্যে এসে বসবাস করতে না পারে। আর ‘রিমেইন গ্রুপ’ এর ভাষ্য ছিল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এলে ৫০ কোটি মানুষের বাজার হারাবে ব্রিটেন। তাতে অর্থনীতিতে আবার ‘ধস’ নামবে, যা এক যুগেও কাটিয়ে ওঠা যাবে না।
ব্রেক্সিটের পর পাউন্ডের দর ১০ শতাংশ পর্যন্ত নেমে যায়, যা ১৯৮৫ সালের পর ছিল সর্বনিম্ন। শেয়ার বাজারের সূচকও কমে যায়, কমে যায় জ্বালানি তেলের দামও।
ভোটের পর টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যান ডেভিড ক্যামেরন, দায়িত্বে আসেন টেরিজা মে।
গণভোটে অপ্রত্যাশিত ফল দেখা যায় ফার্ক গেরিলাদের সঙ্গে কলম্বিয়া সরকারের বহু প্রত্যাশিত শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রেও। পাঁচ দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসানে ওই চুক্তিও গণভোটে প্রত্যাখ্যাত হয়। পরে নতুন এক শান্তিচুক্তি অনুমোদন করে দেশটির সিনেট।
কিউবার মধ্যস্থতায় হওয়া চুক্তিটি আন্তর্জাতিক মহলেও সাড়া ফেলে। চুক্তির জন্য এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল সান্তোস।
বছরের পর বছর ধরে কর ফাঁকির এমন মহোৎসবের খবর পত্রিকার পাতায় আসার পর আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায় বিশ্ববাসীর। এ ঘটনা পানামা পেপার্স নিয়ে।
ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিব জার্নালিস্ট (আইসিআইজে) ও জার্মান পত্রিকা সুইডয়চে সাইটং গত এপ্রিলে পানামার ল ফার্ম মোস্যাক ফনসেকার সাড়ে ১১ মিলিয়ন গোপন দলিল ফাঁস করে দেয়। ৪০ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি তাদের ক্ষমতাশালী মক্কেলদের কীভাবে অর্থ পাচারে সহযোগিতা করেছে, নিষেধাজ্ঞা এড়ানো এবং কর ফাঁকি দেওয়ার পথ দেখিয়েছে, তার তথ্য উঠে আসে সেসব নথিতে।
ওই কোম্পানির মক্কেলদের মধ্যে ছিলেন হোসনি মোবারক, মুয়াম্মার গাদ্দাফী ও বাশার আল আসাদের মত বিভিন্ন দেশের সাবেক ও বর্তমান সরকারপ্রধানরা। এসেছে আর্জেন্টিনার ফুটবল তারকা লিওনেল মেসি ও ভারতের চলচ্চিত্র তারকা অমিতাভ বচ্চনের নামও।
ফাঁস হওয়া দলিলে সোয়া দুই লাখ অফশোর কোম্পানির নাম এসেছে, যেসব কোম্পানির মাধ্যমে কর ফাঁকির কারবার চলত।
এসব কোম্পানির সঙ্গে বিভিন্ন দেশের নামিদামী তারকা ও শীর্ষ রাজনীতিকদের নাম উঠে আসায় বিশ্বজুড়ে হৈচৈ পড়ে যায়। এপ্রিল ও মে মাসে দুই দফায় ফাঁস করা দলিল ও অফশোর কোম্পানিগুলোর নাম প্রকাশ করে সুইডয়েচে সাইটং।
গত দুই বছরের মত ২০১৬ সালেও প্রায় প্রতিটি দিন বিশ্বের কোথাও না কোথাও জঙ্গি বা সন্ত্রাসী হামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে শান্তিকামী মানুষকে। এসব ঘটনায় প্রাণ গেছে ১৫ হাজারের বেশি মানুষের।
তারপরও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ পর্যবেক্ষকরা এ বছরকে আইএস এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এগিয়ে যাওয়ার বছর হিসেবে চিহ্নিত করে আশাবাদী হতে চান।
বছরের মাঝামাঝি সময়েই কুর্দি বাহিনীর হাতে সিরিয়ার কৌশলগত শহর মানবিজের নিয়ন্ত্রণ হারায় আইএস জঙ্গিরা, পাততাড়ি গোটাতে হয় ইরাকের ফালুজা থেকেও। নভেম্বরে তুরস্কের সীমান্ত থেকে বিতাড়িত হয়ে বিশ্ব থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে জঙ্গিগোষ্ঠী।
শেষ প্রান্তে ইরাকের বিশেষ বাহিনীর তীব্র আক্রমণে আইএসকে হারাতে হয়েছে মসুলের পূর্বাঞ্চলের ছয়টি এলাকা; এ শহরেই আইএসপ্রধান বাগদাদি লুকিয়ে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের হিসেবে যে পরিমাণ জায়গা আইএসের দখলে ছিল, তার এক-চতুর্থাংশ তারা গত দেড় বছরে হারিয়েছে। কমে গেছে তাদের আয় এবং যোদ্ধার সংখ্যাও। দুই বছরে আইএস প্রায় ৫০ হাজার যোদ্ধা হারিয়েছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর।
তারপরও এ বছর সন্ত্রাসী হামলার বড় কয়েকটি ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বকে। এর মধ্যে লিবিয়ায় জানুয়ারিতে গাড়ি বোমা হামলায় অর্ধশতাধিক; মার্চে বেলজিয়ামের বিমানবন্দর-মেট্রো স্টেশনসহ তিনটি স্থানে একযোগে হামলায় ৩২ জন; লাহোরের একটি পার্কে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৭৫ জন এবং জুনে ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক বিমানবন্দরে হামলায় ৪৫ জন নিহত হন।
জুলাইয়ের প্রথম দিন বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলায় গুলশানের এক ক্যাফেতে ২২ জনের মৃত্যু হয়। ১৪ জুলাই ফ্রান্সের নিসে উৎসবের ভিড়ে লরি চালিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয় ৮৬ জনকে। একই ধরনের আরেকটি হামলর ঘটনা ঘটে বছরের শেষ দিকে এসে, বার্লিনে। ১৯ ডিসেম্বর এক ক্রিসমাস মার্কেটে ওই ঘটনায় ১২ জন নিহত হন।
বছরের শেষে এসে আলেপ্পো সিরীয় বাহিনীর দখলে চলে যাওয়ার পর আঞ্চলিক অস্থিরতা ধীরে ধীরে পরিণতির দিকে এগুলেও সেখানে সহজেই শান্তি মিলবে না বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। ২০১১ সালে শহরটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লড়াই শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত অন্তত ৪ লাখ মানুষ সেখানে মারা গেছে বলে ধারণা করছে জাতিসংঘ, বাস্তুচ্যুত হয়েছে এর কয়েকগুণ।
বছরের মাঝামাঝি সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নড়ে চড়ে বসে তুরস্কে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানচেষ্টার খবরে। দেশটির ডানপন্থি প্রেসিডেন্ট রিজেপ তায়িপ এরদোয়ান অবকাশে থাকার সময় একদল সেনা তাকে হত্যা করে দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে চেষ্টা চালায় বলে ক্ষমতাসীনরা অভিযোগ করে।
তুর্কি পুলিশ ও জনগণ রাস্তায় নেমে ওই অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। এরদোয়ান এই অভ্যুত্থানচেষ্টার জন্য স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেন ও যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেন। অভ্যুত্থানচেষ্টায় জড়িত থাকার অপরাধে হাজার হাজার সেনা সদস্য, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। বন্দিদের ওপর অবর্ননীয় নির্যাতনের অভিযোগ তোলে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। অভ্যুত্থানচেষ্টার পর দেশটিতে মৃত্যুদণ্ড প্রথাও ফিরিয়ে আনা হয়।
রাশিয়ার বিমান ভূপাতিত করা নিয়ে তুরস্ক-রাশিয়ার সম্পর্কে অবনতি হলেও এ ঘটনার পর তা উল্টে যায়; দুই দেশ নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে উদ্যোগ নেয়।
বছরের শেষভাগে এসে তুরস্ক আরও একবার আলোচনায় এসেছে রাজধানী আংকারায় এক প্রদর্শনীতে রুশ রাষ্ট্রদূতকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ঘটনায়।
এ বছর বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি মিত্র দেশ চীনেরও সমালোচনা কুড়িয়েছে উত্তর কোরিয়া। দেশটির বর্তমান শাসক কিম জং উন ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকেই শুরু হয় সামরিক সক্ষমতার প্রদর্শনী। তবে এবারেরগুলো ছিল মাত্রার দিক থেকে অন্যবছরের তুলনায় ‘বেশি’।
বছরের শুরুতেই হাইড্রোজেন বোমা পরীক্ষার ঘোষণা দেয় দেশটি। এরপর ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের হুমকি উপেক্ষা করে মহাকাশে দূরপাল্লার রকেট নিক্ষেপ করে।
শেষপ্রান্তে এসে পঞ্চমবারের মতো পারমাণবিক বোমার সফল পরীক্ষা চালানোর কথা জানায় উত্তর কোরিয়া। এর বাইরেও বেশ কয়েকবার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়ে তারা।
উত্তরের অস্ত্রের এ ঝনঝনানিতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান; জানায় কড়া প্রতিক্রিয়া। পিয়ংইয়ং গুঁড়িয়ে দেয়ারও হুমকি আসে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে। দক্ষিণের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র জঙ্গি বিমান উড়িয়ে দেয় নিরাপত্তায় আশ্বাস।
বিরক্তি দেখায় চীনও। উত্তরকে রুখতে একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। শেষবারের পারমাণবিক পরীক্ষার পর দেশটিতে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে জাতিসংঘ।
নভেম্বরের ৮ তারিখ এক আচমকা সিদ্ধান্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতীয় ৫০০ রুপি ১০০০ রুপির নোট বাতিলের ঘোষণা দিলে শুরু হয় সাধারণের চরম দুর্ভোগ।
ব্যাংকে নোট সংকট আর পুরনো নোট বদলের জন্য অল্প সময় দেওয়ায় এবং দৈনিক বদলের সীমা বেঁধে দেওয়ায় ব্যাংক, এটিএম বুথ- সবখানে দেখা যায় দীর্ঘ লাইন। বিদেশি পর্যটকরাও পড়েন সঙ্কটে।
এরপর থেকে গঙ্গায় ভাসমান বস্তা বস্তা রুপির খবর য্নে পত্রিকায় এসেছে, তেমনি ব্যাংকের লাইনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবরও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে।
ভারত সরকারের আশা, নোট বাতিলের এই কৌশলে দুর্নীতি ও কালো টাকার দৌরাত্মে লাগাম টান যাবে। তবে ভারতের অর্থনীতিকেও এর জের বহুদিন টানতে হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন।
গত বছরের মত এবার বিশ্ব বেশ কয়েকটি প্রাণঘাতী বিমান দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে বছরের শেষ প্রান্তে এসে।
মে মাসে প্যারিস থেকে কায়রো যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে বিধ্বস্ত হয়ে ইজিপ্ট এয়ারের একটি বিমানের ৬৬ আরোহীর সবার মৃত্যু হয়। নভেম্বরে কলম্বিয়ার মেদেইনে ব্রাজিলের একটি ফুটবল ক্লাবের খেলোয়াড়দের বহনকারী উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে ৭১ জনের মৃত্যু হয়।
৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পাহাড়ি অঞ্চলে দেশটির রাষ্ট্রীয় বিমান পরিবহন সংস্থা পিআইএ-র একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হলে ৪৮ আরোহীর সবাই মারা যান। আর রাশিয়ার একটি সামরিক বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ৯২ আরোহীর মৃত্যু হয় ২৫ ডিসেম্বর।
এর বাইরেও নেপাল, কলম্বিয়া, একুয়েডরসহ বিভিন্ন দেশে আরও দুই ডজন বিমান ও হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে সারা বছরে।
বেশ কয়েকটি বড় ট্রেন দুর্ঘটনাও ঘটেছে এ বছর। ভারতের কানপুরে বগি লাইনচ্যুত হয়ে প্রায় দেড় শতাধিক যাত্রীর নিহত হয় ২০ নভেম্বর। ইরান ও ক্যামেরুনের দুটি ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যায় শতাধিক মানুষ।
কিউবা বিপ্লবের ‘মহানায়ক’ ফিদেল কাস্ত্রো ৯০ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় কোলের মধ্যে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে অর্ধশতক কাল শাসনের পর ২০০৮ সালে ছোট ভাই রাউলকে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে অবসর কাটানো ফিদেল সারা বিশ্বে সমাজতন্ত্রের আন্দোলনকারীদের চোখে ছিলেন বীর।
কাস্ত্রোর শেষকৃত্যে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেকগুলো দেশের সাবেক ও বর্তমান শীর্ষনেতারা উপস্থিত ছিলেন। নয়দিনের শোক পালন শেষে কাস্ত্রোর শবদেহ সান্তিয়াগোকে সমাহিত করা হয়।
চলতি বছর বিশ্ব আরও কয়েকজন আলোচিত ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছে। এর মধ্যে আছেন মুষ্টিযোদ্ধা মুহাম্মাদ আলি, চলচ্চিত্রকার আব্বাস কিওরোস্তামি, লেখক মহাশ্বেতা দেবী, তামিল নাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা জয়ারাম।
অক্টোবরের ১৩ তারিখ মৃত্যু হয় থাইল্যান্ডের রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদেজের।
‘আমেরিকার সংগীত ঐতিহ্যে নতুন কাব্যিক মূর্চ্ছনা সৃষ্টির’ জন্য গত অক্টোবরে বব ডিলানকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হলে শুরু হয় নতুন আলোচনা।
ষাটের দশকে এ মার্কিন গীতিকারের গণসঙ্গীত অধিকার আদায়ের কর্মীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে, যুদ্ধবিরোধী গান মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। নোবেল কমিটি তাকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছে গীতিকবিতার জন্যই, যদিও সমালোচকদের সবাই এর যৌক্তিকতা নিয়ে একমত নন।
ইতিহাসে প্রথম সুরকার ও গীতিকার হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পেলেও ডিলানের নাগাল পেতেই নোবেল কমিটির দীর্ঘদিন লেগে যায়। বারবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন নোবেল কমিটির সদস্যরা। সে সময় অনেকেই মনে করেছিলেন- ডিলান বোধ হয় নোবেল প্রত্যাখ্যান করতে যাচ্ছেন।
তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নিজেই নোবেল কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করেন কিংবদন্তী এ গায়ক; জানান, অভাবিত নোবেলপ্রাপ্তি তাকে বাকরুদ্ধ করেছিল। অবশ্য নোবেল পুরস্কার নিতে অক্টোবরে আর সুইডেনে যাননি তিনি।