সাম‌্যবাদের স্বপ্নচারীদের নায়ক ফিদেল কাস্ত্রোর জীবনাবসান

বিশ্বজুড়ে সাম‌্যবাদের স্বপ্নচারীদের নায়ক, কিউবা বিপ্লবের নেতা ফিদেল কাস্ত্রো আর নেই।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Nov 2016, 05:36 AM
Updated : 27 Nov 2016, 01:42 PM

৯০ বছর বয়সে শনিবার তার জীবনাবসান ঘটেছে বলে কিউবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে উদ্ধৃত করে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ‌্যমগুলো জানিয়েছে।

কিউবার বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ত্রো মৃত‌্যুসংবাদ নিয়ে টিভিতে এসে বলেন, “রাত ১০টা ২৯ মিনিটে আমাদের বিপ্লবের প্রধান কমান্ডার ফিদেল কাস্ত্রো রুস মারা গেছেন।”

ফিদেলের ইচ্ছা ছিল তার শব দাহ করা হোক। তার ইচ্ছাকে সম্মান জানানো হবে জানিয়ে ভাই রাউল বলেছেন, অন্তেষ্টিক্রিয়ার বিস্তারিত শনিবার জানানো হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় কোলের মধ‌্যে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে অর্ধশতক কাল দেশ শাসনের পর ২০০৮ সালে ক্ষমতা ছোট ভাই রাউলকে ছেড়ে দিয়ে অবসর কাটাচ্ছিলেন ফিদেল।

যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে ‘দানব’ ফিদেল সারাবিশ্বে সমাজতন্ত্রের আন্দোলনকারীদের চোখে ছিলেন বীর।

কিউবার অধিকাংশ মানুষ দেশটি দেশের মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার নায়ক হিসেবে দেখেন ফিদেলকে। অন‌্যদিকে বিরোধীদের চোখে তিনি হলেন ভিন্নমত দলনকারী।

ফিদেলের মৃত‌্যু সংবাদে কিউবার রাজধানী হাভানায় শোকের ছাড়া নেমে এলেও যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার মিয়ামিতে দেখা যায় উল্লাস। নির্বাসিত কিউবানদের বেশিরভাগের বাস এই এলাকাতেই।

প্রতিবেশী দেশে স্বদেশীদের এই উল্লাসের খবর শুনে ব‌্যথিত হাভানার ছাত্র সারিয়েল ভালদেসপিনো বলেন, “এটা ভীষণ হতাশার। আপনি যাই বলুন না কেন, তিনি একজন জনপ্রিয় ব‌্যক্তি, পুরো বিশ্ব তাকে সম্মান করে ভালোবাসে।”

২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল দলের কংগ্রেসে- ছবি: রয়টার্স

বাংলাদেশসহ স্বাধীনতাকামী বহু দেশের পক্ষে দাঁড়িয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকারীদের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন ফিদেল। বাংলাদেশ সরকার অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিন বছর আগে তাকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননায়’ ভূষিত করে।

একাত্তরে ফিদেলের অবদান স্মরণ করে তার মৃত‌্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা।

আদর্শিক পথ ভিন্ন হলেও শোকবার্তায় কিউবা বিপ্লবের নেতাকে বিংশ শতকের ‘প্রতীক’ অভিহিত করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

ভগ্নস্বাস্থ‌্য নিয়ে ২০০৮ সালে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার পর প্রকাশ‌্যে খুব একটা আসতেন না ফিদেল। তবে বেশ কয়েকবার মৃত‌্যুর খবর রটনার পর প্রকাশ‌্য হয়ে জানান দিতেন, তিনি এখনও বেঁচে আছেন।

দুই ভাই (২০১১ সালের ছবি)- ছবি: রয়টার্স

এ বছর দুই বার প্রকাশ‌্যে দেখা গিয়েছিল তাকে। গত এপ্রিলে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে ভাষণে তিনি নিজের শারীরিক অবস্থার কথা তুলে সমর্থকদের প্রস্তুত থাকার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন- “কিছু দিনের মধ‌্যে ৯০ পার করব, এটা আমি ভাবিনি।”

এরপর অগাস্টে নিজের ৯০তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এসে সবাইকে নিয়ে কেক কেটেছিলেন ফিদেল, দিয়েছিলেন বক্তৃতা।

রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে অবসর নিলেও লেখনীতে সক্রিয় ছিলেন ফিদেল। বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্টদের দুর্দিনের মধ‌্যেও সাম‌্যবাদের প্রতি তার আস্থায় অবিচল থাকার প্রকাশই ঘটত সেখানে।

স্বচ্ছল পরিবার থেকে ঝঞ্ঝাময় জীবন

কিউবায় স্পেনিশ বংশোদ্ভূত স্বচ্ছল একটি পরিবারে জন্ম ফিদেল কাস্ত্রোর। স্কুলে খেলাধুলায় তুখোড় ফিদেলের আইনজীবী হওয়ার পথ তৈরি ছিল, কিন্তু পরে বাঁক বদলে হয়ে যান তিনি বিপ্লবী।

১৯২৬ সালের ১৩ অগাস্ট কিউবার পূর্বাঞ্চলীয় ‍ওরিয়েন্তে প্রদেশে বিরান শহরের কাছে ধনী চিনিকল মালিক অ্যাঞ্জেল কাস্ত্রো রুস ও লিনা রুস গনজালেসের ঘরে জন্ম ফিদেলের।

ছয় ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় ফিদেল ভাই রাউল ও র‌্যামন ছাড়াও বড় হয়েছেন বোন অ্যাঞ্জেলা, এমা ও অগাস্টিনার সাহচর্যে।

ফিদেলের পড়াশোনা শুরু হয় প্রাইভেট জেসুইট বোর্ডিং স্কুলে; এরপর সান্তিয়াগোর ডলোরস কলেজ এবং হাভানার বেলেন কলেজ পেরিয়ে কাস্ত্রো ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব হাভানার ল’ স্কুলে।

খেলাধুলায় তুমুল আগ্রহ ছিল তার, বন্ধু চে গেভারার সঙ্গে গলফে- ছবি: রয়টার্স

হাভানায় এসে ফিদেল জড়িয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে। ওই সময়েই তার মনে কিউবান জাতীয়তাবোধ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা ও সমাজতন্ত্রের প্রতি পক্ষপাতের ছাপ পড়ে।

ফিদেলের বাবা অ্যাঞ্জেল তখন মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীন ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা করতেন। কিন্তু ফিদেল হাঁটেন উল্টো পথে।

১৯৪৭ সালে ডমিনিকান রিপাবলিকে তখনকার স্বৈরশাসক রাফায়েল ত্রুজিলোকে উৎখাতে এক বিদ্রোহে অংশ নেন ফিদেল। তাতে ব্যর্থ হলেও দমে যাননি তিনি। পরের বছর চলে যান কলম্বিয়ার বোগোতায়। সেখানে তাকে দেখা যায় সরকারবিরোধী দাঙ্গায়।

একই বছর কাস্ত্রো যোগ দেন সংস্কারপন্থি দল ‘পার্টি দো অর্তোদক্সোতে (অর্থোডেক্স)’ । কমিউনিস্টবিরোধী ওই দলের প্রার্থী এদুয়ার্দো চিবা ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে পরাজিত হলেও ফিদেল তাকে পুনরায় নির্বাচন করতে প্রেরণা জোগান।

রাজনৈতিক দলে যোগদানের সময়ই বিয়ে করেন ফিদেল। প্রথম স্ত্রী মিরতা দিয়াজ বালার্তের কোলে জন্ম নেয় তার সন্তান ফিদেল জুনিয়র।

ওই সময়ই মার্কসবাদে আকৃষ্ট হন ফিদেল; একইসঙ্গে কিউবান কংগ্রেস নির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৯৫২ সালে জেনারেল বাতিস্তা নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে পরবর্তী নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করলে কাস্ত্রো ও তার দলের কয়েক সদস্য মার্কিন মদতপুষ্ট স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন।

এজন্য তারা ‘দ্য মুভমেন্ট’ নামে একটি গ্রুপ গঠন করেন। ১৯৫৩-র ২৬ জুলাই দ্য ‍মুভমেন্টের ১৫০ সদস্য কিউবার সান্তিয়াগোতে থাকা মানকাদা মিলিটারি ব্যারাকে আক্রমণ করে।

ওই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে বাতিস্তা সরকার কাস্ত্রোকে বন্দি করে। এরপর এক ‘প্রহসনের’ বিচারে তাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

বিচারকালে ফিদেলের ভাষণ তাকে তুমুল জনপ্রিয় করে তোলে। ওই ভাষণে তিনি বলেছিলেন- ‘আমাকে অপরাধী বানাতে পার, কিন্তু ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে।”

বিচারে ফিদেলের জীবিত সহযোগীদেরও নানা মেয়াদে সাজা হয়, এর মধ্যে তার ছোটভাই রাউলও ছিলেন।

জেলে থাকার সময় ফিদেল তার দলের নাম বদলে রাখেন ‘টুয়েন্টি সিক্সথ অব জুলাই ‍মুভমেন্ট’। দুই বছর পর এক ‍চুক্তির বলে মুক্তি পেয়ে সহযোগীদের নিয়ে মেক্সিকোয় পাড়ি জমান ফিদেল।

৮১ সঙ্গীকে নিয়ে সফল বিপ্লব

মেক্সিকোতে ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে দেখা হয় আর্জেন্টাইন চে গেভারার সঙ্গে; চিকিৎসক গেভারাও তখন স্বপ্ন দেখছেন পুরো দক্ষিণ আমেরিকার বদলে দেওয়ার।

বন্ধু চে’র সঙ্গে ফিদেল, মাঝে ভাই রাউল- ছবি: রয়টার্স

মেক্সিকোতেই ফিদেল, রাউল ও চে পরিকল্পনা করেন কিউবায় পুনরায় ফিরে গিয়ে বাতিস্তা সরকার উৎখাত করবেন। ১৯৫৬-র ২ ডিসেম্বর ফিদেল আর তার ৮১ জন সহযোগী অস্ত্রশস্ত্রসহ ছোট্ট নৌকা ‘গ্রানমা’য় চেপে কিউবার উত্তরাঞ্চলের মানজানিলোতে নামার পরিকল্পনা করেন।

তাদের আসার খবর পেয়ে বাতিস্তা সেখানে বাহিনী পাঠান। ফিদেলরা নামার সময় গুলি চালানো হলে বেশ কয়েকজন নিহত হন। চে আর রাউলসহ বাকিদের নিয়ে সিয়েরা মায়েস্ত্রোর পার্বত‌্য জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেন ফিদেল, সেখানে ঘাঁটি গাঁড়েন।

সরকারি বাহিনীর সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধ শুরুর পর জনগণের তুমুল সমর্থন নিয়ে ১৯৫৮-র শেষ দিক থেকে ফিদেল বাহিনী একের পর এক শহর দখল করতে থাকে।

চূড়ান্ত লড়াইয়ে ১৯৫৯-র জানুয়ারিতে কিউবা দখলে নেয় ‘টুয়েন্টি সিক্সথ অব জুলাই ‍মুভমেন্ট’; বাতিস্তা পালিয়ে আশ্রয় নেন ডমিনিকান রিপাবলিকে।

ফিদেল কাস্ত্রোর সমর্থন নিয়ে ওই বছরই প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ম্যানুয়েল উরুতিয়া; হোসে মিরো কর্দোনা হন প্রধানমন্ত্রী। ফিদেলকে দেওয়া হয় সেনাপ্রধানের দায়িত্ব।

পরের মাসেই মিরো পদত্যাগ করলে প্রধানমন্ত্রী হন ফিদেল। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই কারখানা এবং খামারগুলোকে জাতীয়করণ করেন তিনি, করেন ভূমি সংস্কার।

‘৬৩৮ বার’ হত‌্যার চেষ্টা

জাতীয়করণের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক অবনতি ঘটতে থাকে কিউবার। কাস্ত্রোও ধীরে ধীরে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়েন।

যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলেও বারবার চেষ্টা করেও পরাশক্তি দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট আইজেন হাওয়ারের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি কাস্ত্রো। পরের মাসে কিউবাতে ফিরে করেন ‘ফার্স্ট এগ্রেরিয়ান রিফর্ম অ্যাক্ট’। ওই আইনের অধীনে ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয় এবং একইসঙ্গে কিউবায় বিদেশি কোম্পানির সম্পদ জাতীয়করণ করেন।

১৯৬১ সালে ক‌্যারিবীয় সাগরে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রটির কমিউনিস্ট-যাত্রা অস্বস্তিতে ফেলে যুক্তরাষ্ট্রকে। ফিদেল কাস্ত্রোকে উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের অসংখ‌্য তৎপরতার খবরও আসতে থাকে গণমাধ‌্যমে।

সিআইয়ের প্রশিক্ষণে ওই বছরই কিউবা থেকে পালিয়ে যাওয়া ১৪শ’ দেশত্যাগী কিউবার ‘বে অফ পিগে’ ফিরে ফিদেলকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। কিউবার বিপ্লবীবাহিনী ওই বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করে।

১৯৬১ সালে বে অফ পিগ অভ‌্যুত্থানকারীদের বিচার দেখতে ফিদেল কাস্ত্রো- ছবি: রয়টার্স

প্রথমদিকে যুক্তরাষ্ট্র এ বিদ্রোহের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করলেও পরে উন্মোচিত হয়- ওই বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল মার্কিনের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, হাতে তুলে দিয়েছিল মার্কিন অস্ত্র।

কিউবার গোয়েন্দাদের দাবি অনুযায়ী, কেবল সিআইএ ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার জন্য ৬৩৮টি চেষ্টা চালিয়েছে, যার মধ্যে আছে সিগারেটে বিস্ফোরক বা স্কুবা ডাইভিং স্যুটে বিষ মাখিয়ে; ছিল মাফিয়া স্টাইলে গুলি করে হত্যার চেষ্টাও।

যুক্তরাষ্ট্রের এই ধারাবাহিক চেষ্টাকে নিয়ে কৌতূকও করেছেন ফিদেল কাস্ত্রো। বলেছেন- “হত্যার চেষ্টা এড়িয়ে যাওয়ার যদি কোনো অলিম্পিক ইভেন্ট থাকত, তাহলে নির্ঘাত তাতে স্বর্ণপদক জিততাম আমি।”

ফিদেল কাস্ত্রো কিউবা শাসনকালে যুক্তরাষ্ট্রের ১০ জন প্রেসিডেন্টের বদল ঘটে। বলা হয়, ১০ জনের চেষ্টায়ও উৎখাত করা যায়নি এক ফিদেলকে।  

সোভিয়েত প্রভাব আর ওয়াশিংটনের টানাপড়েন

১৯৬০ সালেই তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং তেল কেনার চুক্তি করেন ফিদেল কাস্ত্রো।

যুক্তরাষ্ট্র মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো ওই তেল পরিশোধনে আপত্তি জানালে ফিদেল তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করেন। তখন যুক্তরাষ্ট্র কিউবা থেকে চিনি কেনার নির্ধারিত কোটা বাতিল করে; চাপিয়ে দেয় নিষেধাজ্ঞা।

ক্ষমতা নেওয়ার পর ১৯৬১ সালই ছিল ফিদেল কাস্ত্রোর জন্য সবচেয়ে সঙ্কটকালীন বছর। বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার সঙ্গে তাদের আনুষ্ঠানিক সম্পর্কে ছেদ টানে।

তারপর ওই বছরের এপ্রিলে ফিদেল কাস্ত্রো কিউবাকে ‘সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ ঘোষণা করেন। তার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র কিউবার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

১৯৬২ সালের অক্টোবরে তুরস্কে মার্কিন জুপিটার মিসাইল বসানোর পাল্টা হিসেবে কিউবায় সোভিয়েত মিসাইল বসানোর গোপন পরিকল্পনা করেন কাস্ত্রো ও রুশ নেতা নিকোলাই ক্রুশ্চেভ।

টান টান উত্তেজনায় ১৩ দিনের আলাপ-আলোচনার পর কিউবায় মিসাইল বসানোর পরিকল্পনা থেকে সরে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন। বদলে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক থেকে তাদের মিসাইল সরিয়ে নেয় এবং কিউবায় হামলা না চালানোর প্রতিশ্রুতি দেয়।

১৯৬৫ সালে কাস্ত্রো কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে নিজের দলকে একীভূত করেন, নিজে হন দলের প্রধান। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি আবির্ভূত হন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির একনিষ্ঠ সমালোচক হিসেবে।

১৯৯১ সালে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিউবার অর্থনীতি বড় ধাক্কা খায়। সোভিয়েতের দেশগুলোতেই সিগারেট এবং অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করত কিউবানরা; ওই জোটের কাছ থেকে কম মূল্যে পেত তেলও।

১৯৯৫ সালে জাতিসংঘে এক অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে- ছবি: রয়টার্স

ধস ঠেকাতে নতুন পন্থা নেন ফিদেল কাস্ত্রো। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে তার দেশের উপর চাপানো নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে চাপ দেওয়া শুরু করেন। এ সময় কিউবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুক্ত বাজার অর্থনীতি পদ্ধতি চালু হয়। উৎসাহ দেওয়া হয় বিদেশি বিনিয়োগকেও।

ডলারের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সঙ্গে স্বল্প আকারে পর্যটনও চালু করেন ফিদেল। প্রায় চার দশক পর ১৯৯৬ সালে আবারও যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান ফিদেল; এ সময় দেশত্যাগী কিউবানদের নিজ দেশে ফিরে ব্যবসা ও বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানান তিনি।

২০০১ সালে হারিকেন মিশেলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত কিউবায় যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য পাঠাতে চাইলেও তা ফিরিয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে নগদ টাকায় খাদ্য কেনার প্রস্তাব দেন ফিদেল।

এরপর বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ধীরে ধীরে রাউল কাস্ত্রো নেতৃত্বাধীন কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক বদলাতে থাকে। ওবামা এই বছরের মার্চে হাভানা সফরেও যান।

যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ মুক্ত না হওয়ায় ওবামাকে সাক্ষাৎ দেননি বলে পরে লেখেন ফিদেল কাস্ত্রো। তিনি বলেন- “সাম্রাজ্যের কাছ থেকে কোনো উপহার আমাদের দরকার নেই।”

নায়ক বনাম স্বৈরাচার

কিউবায় বিরোধীদের চোখে ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন ‘স্বৈরাচার’, কট্টর পুঁজিবাদী দেশগুলোর কাছে তার পরিচয় ‘একনায়ক’; বিপরীতে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে তিনি ‘আস্থার প্রতীক’, অনুসারীদের কাছে তিনি ‘এল কমান্দান্তে (দি কমান্ডার)’, মুক্তি সংগ্রামী সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘কিংবদন্তি’।

ফিদেল কাস্ত্রোর শাসনামলে কিউবাজুড়ে ১০ হাজার নতুন স্কুল খোলা হয়; শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া হয় পাহাড়ি, দুর্গম প্রত্যন্ত সব অঞ্চলে। এর ফলও মেলে হাতেনাতে; অল্প সময়ের মধ্যে কিউবার সাক্ষরতার হার হয়ে দাঁড়ায় ৯৮ শতাংশ।

১৯৭২ সালে রোমানিয়ায়- ছবি: রয়টার্স

কাস্ত্রোর হাত ধরেই কিউবা গড়ে তোলে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা; কিউবানরা এখন এমন এক সমাজব্যবস্থায় বসবাস করছেন যেখানে শিশুমৃত্যুর হার হাজারে মাত্র ১১ জন।

দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে ধূমপানের অভ‌্যাসটিও ছেড়ে দেন ফিদেল। তিনি বলেন, “অনেক আগেই আমি এই উপসংহারে পৌঁছেছি যে, কিউবার জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য আমাকে শেষ ত্যাগ- ধূমপান ছেড়ে দিতে হবে। আমি আসলে ওটাকে খুব একটা মিসও করছি না।”

কাস্ত্রোর সমালোচনায় মুখর পশ্চিমারা তাকে ‘অধিকার হত্যাকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে। তার আমলে বন্ধ হয়েছে পেশাজীবী আন্দোলন, শ্রমিক ইউনিয়নের ধর্মঘট করার অধিকার। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি গণমাধ্যম, বিপাকে পড়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিরোধী দলগুলোকে দমন-পীড়ন ও সেসব দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন এবং জোরপূর্বক দেশত্যাগ করানোরও অভিযোগ আছে ফিদেলের ‍বিরুদ্ধে।

বিপ্লবের স্বপ্নচারী

বিপ্লব করতে ফিদেল নিজে যেমন ঘুরেছেন নানা দেশ; কিউবায় সফল হওয়ার পর লাতিন আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিতেও বাড়িয়ে দিয়েছেন সহায়তার হাত।  

১৯৬৬ সালে কাস্ত্রো এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত করতে গড়ে তোলেন নানান সহায়ক প্রতিষ্ঠান। পরের বছর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন লাতিন আমেরিকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন, যার হাত ধরে এর পরের কয়েক দশকে ওই অঞ্চলের অনেকগুলো দেশেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়।

১৯৭০ এর দশকে কাস্ত্রো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সোভিয়েত বিপ্লব এগিয়ে নিয়ে যেতে সামরিক সহায়তাও পাঠান। তার পাঠানো সেনাবাহিনী যুদ্ধ করে অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া ও ইয়েমেনে।

ওই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবাকে সাহায্য করলেও বিভিন্ন দেশে সেনাসাহায্য পাঠাতে গিয়ে টান পড়ে কিউবার অর্থনীতিতে; পরে এ ধরনের অভিযান থেকে সরে আসেন ফিদেল।

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন‌্যাম) নেতা ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে ন‌্যাম সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক হয় কাস্ত্রোর।

গত আট বছর ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বে না থাকলেও দেশ এবং দেশের বাইরে ফিদেলের প্রভাব ছিল আগের মতোই। বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে ধারাবাহিক সাক্ষাৎ করে যাচ্ছিলেন ফিদেল।

২০০৫ সালে দিয়াগো ম‌্যারাদোনার সঙ্গে- ছবি: রয়টার্স

 

ভেনিজুয়েলার উগো চাবেস (প্রয়াত), নিকোলাস মাদুরো, বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসসহ লাতিন আমেরিকায় কিউবাঘনিষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে তার প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি।

ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে পোপ বেনেডিক্ট এবং পোপ ফ্রান্সিস কিউবার এ কিংবদন্তির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। ফুটবল কিংবদন্তি দিয়াগো মারাদোনাও ছুটে যেতেন এই কমিউনিস্ট নেতার সংস্পর্শ পেতে।