জ‌্যারেড কুশনার: যার কথা ট্রাম্প শোনেন

পুরো পৃথিবী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে উত্তরসূরী ট্রাম্পের প্রথম সাক্ষাৎ নিয়ে; ঠিক তখনই ক্যামেরা খুঁজে পেল হোয়াইট হাউজের সাউথ লনে প্রেসিডেন্টের চিফ অব স্টাফের সঙ্গে কথা বলা এক ধীরস্থির যুবককে- তার নাম জ‌্যারেড কুশনার।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Nov 2016, 01:23 PM
Updated : 17 Nov 2016, 04:43 AM

নির্বাচনের দুদিন পর গত ১০ নভেম্বর পালাবদলের আলোচনার বাইরে ওই ছবি সংবাদ মাধ‌্যমেও আলোচনার জন্ম দেয়।

ট্রাম্পের মেয়ে ইভাঙ্কার স্বামী কুশনারের বয়স ৩৫। শ্বশুরের মত তিনিও একজন আবাসন ব‌্যবসায়ী। ভোটের প্রচারের দিনগুলোতে ক্রমশ তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন ট্রাম্প শিবিরের একজন প্রভাবশালী ব‌্যক্তি হিসেবে। রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন পাওয়া থেকে শুরু করে ট্রাম্পকে নির্বাচনী বৈতরণী পার করা পর্যন্ত বহুমুখী দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন।

এর মধ্যে ছিল প্রচার শিবিরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োগ, কৌশল ও বক্তব্য ঠিক করে দেওয়া এবং তহবিল সংগ্রহের বিষয়টি তদারক করা।

রয়টার্স লিখেছে, ২০০৯ সালে ইভাঙ্কাকে বিয়ে করার পর থেকেই ব্যবসা ও রাজনীতিতে শ্বশুরকে ছায়ার মত সঙ্গ দেয়া কুশনারের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ওপর ট্রাম্পের আস্থা অগাধ।

গত মে মাসে ইন্ডিয়ানা প্রাইমারির সময় কুশনারকে পাশে রেখে পরিচয় করে দেওয়ার সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, “সত্যি কথা বলতে কি, জ‌্যারেড আবাসন ব্যবসায় বেশ সফল। যদিও আমার মনে হয়, আবাসন ব্যবসার চেয়ে রাজনীতি সে অনেক বেশি পছন্দ করে।... সে রাজনীতিতেও বেশ ভালো।”

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বজনপ্রীতি ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রে যে আইন রয়েছে, তার কারণে প্রেসিডেন্ট তার নিকটাত্মীয়দের প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে পারেন না। কুশনারকে কোনো পদে দেখা না গেলেও ঘরে-বাইরে ট্রাম্পজামাতার প্রভাব কমবে না।

এরই মধ্যে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তার তিন সন্তান ও অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে কুশনারকেও নতুন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি মনোনয়নের দলে স্থান দিয়েছেন। বলা হচ্ছে, কুশনারের কথা ট্রাম্প শোনেন।

এর আগেও ট্রাম্প-শিবিরে কুশনারের প্রভাব ছিল প্রশ্নাতীত। ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থিতা পাওয়ার আগে জুনে প্রচার ম্যানেজার কোরে লিওয়ানডোস্কিকে বহিষ্কারের সময়ও কুশনারের সঙ্গে তার বিবাদকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল বলে বিবিসির খবর।

অগাস্টে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্ব নেন ডানপন্থী সংবাদমাধ্যম ব্রাইবার্ট নিউজ নেটওয়ার্কের নির্বাহী চেয়ারম‌্যান স্টিভেন বেনন।

রয়টার্স লিখেছে, বেননের উপদেশ ও বিশ্লেষণে ট্রাম্প, তার সন্তান ও কুশনারের আস্থা আছে। তার প্রমাণ মিলেছে ট্রাম্পের নতুন প্রশাসনে চিফ স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে তাকে বেছে নেওয়ার মধ‌্য দিয়ে।

আর হোয়াইট হাউজের নতুন চিফ অব স্টাফ পদে নিয়োগ পাওয়া রাইনস প্রিবাস এনবিসি টেলিভিশনের ‘টুডে’ অনুষ্ঠানে বলেছেন, নতুন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে কুশনার ‘অবশ্যই’ থাকছেন।

বিবিসি লিখেছে, এমনিতে ক্যামেরার সামনে ‘লাজুক’ কুশনার পর্দার অন্তরালে সক্রিয় থাকতেই বেশি পছন্দ করেন। তিনি কেবল একজন ধন‌্যাঢ‌্য আবাসন ব‌্যবসায়ীই নন, সংবাদপত্র প্রকাশনার ব‌্যবসাও তার রয়েছে।

নিউ জার্সির লিভিংস্টোনে এক গোড়া ইহুদি পরিবারে জ‌্যারেড কুশনারের জন্ম। দুই বোন ও এক ভাইয়ের সঙ্গে সেখানেই তিনি বেড়ে ওঠেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কুশনারের দাদা-দাদি পোল্যান্ডের জার্মান বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে যান, ১৯৪৯ সালে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানেই কুশনারের বাবা চার্লস পরিণত হন ‘প্রোপার্টি মোগলে’।

‘দি প্রাইস অব অ‌্যাডমিশন: হাউ আমেরিকাস রুলিং ক্লাস বাইস ইটস ওয়ে ইনটু এলিট কলেজেস’ বইয়ের লেখক ড‌্যানিয়েল গোল্ডেনের তথ‌্য অনুযায়ী, পড়ালেখায় ভালো ফল দেখাতে না পারলেও বাবার টাকার জোরে হাভার্ডে পড়ার সুযোগ পান জারেড কুশনার। ছেলেকে সেখানে ভর্তি করতে প্রায় আড়াই মিলিয়ন ডলার দান করেছিলেন তার বাবা।

ট্রাম্পের বাবা ফ্রেডের মত চার্লস কুশনারের ব্যবসা নিয়েও বিতর্ক ছিল। কর ফাঁকি, অবৈধ প্রচারে অর্থ দান ও সাক্ষীকে প্রভাবিত করার অভিযোগে তাকে জেলও খাটতে হয়।

এক যৌনকর্মীকে নিজের বোনজামাইয়ের পেছনে লাগিয়ে দিয়ে সেই দৃশ‌্য ভিডিও করে চার্লস তা পাঠিয়েছিলেন নিজের বোনের কাছে। চার্লস পরে স্বীকার করেন, বোনজামাই যাতে আদালতে তার ‍বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দেন, সেজন্য ওই ঘটনা সাজান তিনি।  

যার কৃতিত্বে সে সময় চার্লস কুশনার দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন, তিনি নিউ জার্সির সাবেক অ‌্যাটর্নি জেনারেল ক্রিস ক্রিস্টি। এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়নপ্রত‌্যাশী ছিলেন। ট্রাম্প দলের মনোনয়ন পাওয়ার পর ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী হিসেবেও শোনা যাচ্ছিল ক্রিস্টির নাম। কিন্তু জ‌্যারেড কুশনারের পরামর্শেই ক্রিস্টির বদলে ট্রাম্প রানিংমেট হিসেবে মাইক পেন্সকে বেছে নেন বলে গুঞ্জন আছে।

হাভার্ডে পড়ার পাশাপাশি কুশনার নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি ও ব্যবসা প্রশাসনে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। এরপর হাল ধরেন কুশনার কোম্পানিজের।

২০০৬ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১.৮ বিলিয়ন ডলারে ম্যানহাটানের ৬৬৬ অ্যাভেনিউয়ের ৪১ তলা ভবনটি কিনে নেন তিনি। ওই ভবন থেকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরেই ট্রাম্পের বাড়ি, ট্রাম্প টাওয়ার।

দ্য রিয়েল ডিল ট্রেড ম্যাগাজিনকে কুশনার সে সময় বলেছিলেন, “নিউ ইয়র্কে আপনাকে দ্রুত তৎপরতা দেখাতে হবে, না হলে আপনার স্থান হবে আস্তাকুঁড়ে।”

ওই বছরই তিনি কিনে নেন প্রভাবশালী পত্রিকা নিউ ইয়র্ক অবজারভার। তার পর থেকেই পত্রিকাটির মান খারাপ হতে শুরু করে বলে সমালোচকদের ভাষ‌্য।

কুশনারের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে তিন বছরের মাথায় পদত্যাগ করেন ১৫ বছর ধরে নিউ ইয়র্ক অবজারভারের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসা পিটার কাপলান। গত ৭ বছরে পত্রিকাটি আরও ছয়জন সম্পাদক দেখেছে।

কুশনার অবশ‌্য দাবি করে আসছেন, মালিকানা কিনলেও পত্রিকার বিষয়বস্তু নির্বাচনে তিনি প্রভাব খাটান না।

“অনেকেই আমাকে নিয়ে মন্তব্য করে; কিন্তু বেশিরভাগই বুঝতে চায় না যে পত্রিকার বিষয়বস্তুর সঙ্গে আমি জড়িত নই।”

বিবিসি লিখেছে, কুশনার ও ডোনাল্ড ট্রাম্প দুজনেই তরুণ বয়সে তাদের বাবার ব্যবসার উত্তরাধিকারী হয়েছেন; একই রকম অভিজ্ঞতার কারণে তাদের মধ্যে বন্ধন ও বোঝাপড়া জোরদার হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

ছেলে কোলে ইভাঙ্কা ট্রাম্প, সঙ্গে জ‌্যারেড কুশনার

শ্বশুরের মত কুশনারেরও রাজনীতিতে অভিজ্ঞতা কম। নিউ ইয়র্ক অবজারভারে এক নিবন্ধে রাজনীতিকে তিনি ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

“ভুল এড়াতে সরকার অনেকগুলো স্তর তৈরি করে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এতে খরচ পড়ে বেশি, কাজ হয় কম। ব্যবসার ক্ষেত্রে আমরা বুদ্ধিমান লোকেদের কাজ শেষ করার দায়িত্ব দিয়ে থাকি এবং কীভাবে তা সম্পাদন করা যায় তার অধিকারও দেই।”

নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্পকে ‘সেমিটিক-বিরোধী’ তকমা দিয়ে যে সমালোচনা শুরু হয়েছিল, তার বিরুদ্ধেও কলম ধরেছিলেন তার জামাতা।

স্টার অব ডেভিড এবং বিপুল পরিমাণ অর্থের সঙ্গে হিলারির ছবি দিয়ে ট্রাম্প একট টুইট করেছিলেন, যেখানে সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ‘সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রার্থী’ আখ‌্যায়িত করা হয়। ওই ছবিতে স্টার অব ডেভিডের ছবি দেওয়ায় বিরোধীরা তাকে ‘এন্টি-সেমেটিক’ অ্যাখ্যায়িত করে।

এর জবাবে কুশনার অবজারভারের নিবন্ধে লেখেন, “তারা যদি তার রাজনীতি অপছন্দ করে, তাহলে তার মধ্যে অপছন্দের আরও উপাদান খুঁজে পাবে, যেমন বর্ণবাদ।

“অন্যদিকে যারা তার রাজনীতি পছন্দ করে, তারা তার কাছ থেকে এমন কিছু শুনতে চায় যা কখনো রাজনীতিবিদরা স্পর্শই করেননি। এ কারণে অনেকের কাছেই তার আবেদন রয়েছে।”

শ্বশুরের সঙ্গে বেশ কিছু বিষয়ে অমিলও আছে কুশনারের। ট্রাম্পের মত হৈ হৈল্লা নয়, শান্ত ও চুপচাপ থাকতেই বেশি পছন্দ করেন তিনি।

অবশ‌্য নির্বাচনী প্রচারে তার সরব উপস্থিতি এবং নতুন প্রেসিডেন্টে সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এরইমধ্যে তাকে ওয়াশিংটনের অন্যতম প্রভাবশালী ব‌্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে বলে প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যমগুলোর ভাষ্য।