কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতির বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জানুয়ারিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলে ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের ছাদের নিচে থাকা বিপুল ও জটিল ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক- যার মধ্যে রয়েছে বহু বিদেশি বিনিয়োগ ও দায় তা নজিরবিহীন স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের আইনে কংগ্রেস সদস্য ও নিচের দিকের কর্মকর্তাদের ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট রুলস’ মেনে চলার বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত ব্যবসায় জড়িত থাকতে বাধা নেই।
লিনডন জনসনের জীবনীকার রবার্ট কারো জানান, ষাটের দশকে দায়িত্ব পালন করা এই প্রেসিডেন্ট তার সম্প্রচার ব্যবসা থেকে দূরে থাকার ঘোষণা দিলেও বাস্তবে অন্তরালে তিনিই তা চালিয়ে গেছেন।
ওয়াশিংটনভিত্তিক অরাজনৈতিক পর্যবেক্ষক সংগঠন সিটিজেনস ফর রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড এথিকসের নির্বাহী পরিচালক নোয়াহ বুকবাইন্ডার বলেন, “এক্ষেত্রে কোনো আইনি বাধা, আইনি বাধ্যবাধকতা নেই।”
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সে পথে না হাঁটলেও তার বিনিয়োগ ছিল মূলত ইউএস ট্রেজারি নোটসহ বিভিন্ন বন্ডে, যেখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার সুযোগ কম।
ট্রাম্পের ব্যবসার মধ্যে রয়েছে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হোটেল, গলফ কোর্স ও ‘লাইসেন্সিং’ কোম্পানি। ভোটের প্রচারের সময় আইন অনুযায়ী ১০৪ পৃষ্ঠার একটি আর্থিক বিবরণী ট্রাম্প দাখিল করেন, যাতে দেখা যায়, পাঁচশ’র বেশি প্রতিষ্ঠানে তার আর্থিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে চায়না ট্রেডমার্ক এলএলসি এবং ডিটি মার্কস কাতার এলএলসি’র মতো প্রতিষ্ঠানের নাম থাকলেও ওই বিবরণীতে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়নি।
ব্লাইন্ড ট্রাস্ট
এর আগে অনেক ধনী ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হলেও ট্রাম্পের মতো আর কেউ সম্পদের এতো জটিল সাম্রাজ্য নিয়ে হোয়াইট হাউজে পৌঁছাননি।
হোয়াইট হাউজে থেকে ট্রাম্প কীভাবে তার ব্যবসা সামলানোর পরিকল্পনা করেছেন সে বিষয়ে তার মুখপাত্রের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প বলেছিলেন, ব্যবসার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড হয়তো তিনি সন্তানদের ওপরই ছেড়ে দেবেন।
কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবসায়িক স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে ট্রাম্পকে দূরে রাখতে তা সামান্যই কাজে দেবে।
ওয়াশিংটন ডিসির আইনজীবী কেনেথ গ্রস উচ্চ পর্যায়ে রাজনৈতিক পদে নিয়োগপ্রাপ্তদের ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ বিষয়ে আইনি পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
তিনি বলেন, ট্রাম্প যে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন তাতে হয়তো প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি কিছুটা সময় পাবেন। তবে তা স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে তাকে মুক্ত রাখতে পারবে না।
“তার পরিবার ও সন্তানদের স্বার্থ তার নিজের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত।”
আর ট্রাম্পের ব্যবসার যে ধরন, তাতে তা ‘ব্লাইন্ড ট্রাস্টের’ ওপর ছেড়ে দেওয়াও অর্থহীন হবে।
নিউ ইয়র্কেরই আরেক বিলিয়নেয়ার মাইকেল ব্লুমবার্গ যখন মেয়রের দায়িত্ব নেন তখন তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন গ্রস।
দায়িত্ব নেওয়ার সময় ডেটা ও মিডিয়া কোম্পানি ব্লুমবার্গ এলপির দৈনন্দিন কার্যক্রম থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন ব্লুমবার্গ। ফিন্যান্সিয়াল ডেটা সেবার জন্য তার কোম্পানির কম্পিউটার টার্মিনাল নগর কর্তৃপক্ষের যেসব প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করত সেগুলো তিনি তাদের দান করে দেন। জনগণের টাকা থেকে লাভ করছেন এমন ধারণা যাতে তৈরি না হয় সেজন্যই ব্লুমবার্গের এ পদক্ষেপ।
তবে ট্রাম্পের ক্ষেত্রে জটিলতা অবশ্যম্ভাবী। তার সর্বশেষ ব্যবসায়ী উদ্যোগগুলোর একটি হলো- হোয়াইট হাউজ থেকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরে বিলাসবহুল একটি হোটেল। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছ থেকে ওয়াশিংটনের পুরাতন পোস্ট অফিস ইজারা নিয়ে ওই হোটেল তিনি গড়েছেন। এখন প্রেসিডেন্ট হলে সরকার প্রধান হিসেবে ওই হোটেলের ক্ষেত্রে তিনি একদিকে হবেন ভূস্বামী, আরেকদিকে ভাড়াটে।
বহু দেশে ট্রাম্পের ‘লাইসেন্সিং’ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি আছে, আছে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলে সেসব কোম্পানি সংশ্লিষ্ট দেশের ভর্তুকি বা কর রেয়াত সুবিধা থেকে লাভবান হতে পারে।
তুরস্ক, উরুগুয়ে, ফিলিপিন্স, দক্ষিণ কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আয়ারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে হোটেলসহ নানা ব্যবসা রয়েছে ট্রাম্পের।
এগুলো থেকে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। যেমন, তার যে কোনো কোম্পানি বা সন্তানদের সঙ্গে ব্যবসার মাধ্যমে এসব দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা হতে পারে।
ট্রাম্পের মেয়ে ইভাঙ্কার ফ্যাশন পণ্যের ব্যবসা রয়েছে, যেগুলো অন্য অনেক ট্রাম্প-ব্র্যান্ডেড পণ্যের সঙ্গে চীনের মতো বিভিন্ন দেশে তৈরি হয়।
ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে কারেন্সি ম্যানিপুলেশনের অভিযোগ করেছেন এবং দেশটির আমদানিকারকদের ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন।
নির্বাচনে ট্রাম্পের কাছে হেরে যাওয়া হিলারি ক্লিনটন প্রচারের সময় সমালোচনার মুখে পড়েন ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের তহবিল সংগ্রহ নিয়ে। ওবামার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার আগে ২০০৯ সালে হিলারি এমন একটি অঙ্গীকারনামায় সই করেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি সংশ্লিষ্ট কারও অর্থ সেখানে নেওয়া হবে না। ওই চুক্তির আওতায় কোনো বিদেশি সরকারের যে কোনো অনুদান পর্যালোচনার সুযোগ ছিল পররাষ্ট্র দপ্তরের।
ট্রাম্পের ভোটের প্রচারের বিভিন্ন অনুষ্ঠান তার প্রতিষ্ঠানেই হয়েছে। বক্তৃতায় নিজের কোম্পানিগুলোর সুনাম করে গেছেন তিনি নিয়মিত।
বড় বড় সব হোটেল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান- যাদের নামের সঙ্গেই ‘ট্রাম্প’ শব্দটি জড়িয়ে আছে, সেসব সম্পদ ‘ব্লাইন্ড ট্রাস্টের’ অধীনে দিলেও স্বার্থের সংঘাত এড়ানো যাবে বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আইনজীবী রবার্ট কেলনার বলেন, একটি গলফ কোর্সকে যদি ব্লাইন্ড ট্রাস্টে দেওয়া হয়, তার কোনো অর্থ দাঁড়ায় না।
“ব্লাইন্ড ট্রাস্ট ধারণা মূল কথা হলো- এটা অন্ধ। আপনি জানবেন না, কী কী সম্পদ এর আওতায় আছে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের সব ব্যবসা বিক্রি করে দেওয়াই হতে পারে এর একমাত্র সমাধান। তবে সে প্রক্রিয়াও হতে হবে ব্লাইন্ড ট্রাস্টের মাধ্যমে।