রাজা ভূমিবলের মৃত্যুতে থাইল্যান্ডজুড়ে শোক

থাইল্যান্ডের জনগণ তাদের অভিভাবকতুল্য রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদেজের মৃত্যুতে শোক পালন করছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Oct 2016, 05:08 AM
Updated : 14 Oct 2016, 05:08 AM

মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার পর ব্যাংককের শোকার্ত মানুষ রাতভর জেগে সকালে কালো পোশাক পরে রাস্তায় জড়ো হচ্ছেন বলে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

দেশটির অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের পাতা সাদা-কালো করে রেখেছে; দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে থাই রাজার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বার্তা আসছে।

বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে রাজত্ব করা এ থাই রাজা ৮৮ বছর বয়সে বৃহস্পতিবার বিকালে ব্যাংককের সিরিরাজ হাসপাতালে  মারা যান।

শুক্রবার বিকালে ভূমিবলের মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে শহরের এমারেল্ড মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। মৃতদেহ ধোয়ার পর সেখানে ১শ’ দিনের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে শায়িত রাখা হবে। এরপর শুরু হবে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাহিত করার প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়াটি শুরু হতে একবছরও লেগে যেতে পারে।

৬৩ বছর বয়স্ক ক্রাউন প্রিন্স মাহা ভাজিরালঙকর্ন থাইল্যান্ডের নতুন রাজা হবেন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুথ চান ওচা।

রাজার মৃত্যুর পর টেলিভিশনে এক ভাষণে প্রায়ুথ চান ওচা বলেন, রাজার মৃত্যুর জন্য থাইল্যান্ড আগামী একবছর শোক করবে।

পরবর্তী ৩০ দিন রাষ্ট্রীয়ভাবে পতাকা অর্ধনমিত করে রাখা হবে। এসময় নাগরিকদের কালো পোশাক পরতে ও সব বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়।

৭০ বছর ধরে রাজার দায়িত্ব পালন করে আসা ভূমিবল থাইল্যান্ডে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব‌্যক্তি ছিলেন। থাইল্যান্ডের চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে তিনি অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালনকারী হিসেবেও বিবেচিত হয়েছিলেন।

সাম্প্রতিক সময়ে তিনি স্বাস্থ্যসমস্যায় ভুগছিলেন। কয়েকমাস ধরে তাকে জনসম্মুখেও দেখা যায়নি। গেল বছরের বেশিভাগ সময় তিনি হাসপাতালেই কাটিয়েছেন।

গেল রোববার মধ্যরাতে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে প্রাসাদ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদেজের শারীরিক অবস্থা ‘স্থিতিশীল নয়।”

যে হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছিল সেখানে ভিড় জমায় শত শত মানুষ। তার সৌভাগ্যে কামনায় গোলাপী পোশাক পরে সেখানে যায় বহু থাই নাগরিক।

কিডনি জটিলতায় ভুগতে থাকা রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদেজের হেমোডায়ালাইসিস করার সময় তার রক্তচাপ কমে যায়। পরে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে তার রক্তচাপ স্বাভাবিক করার পর তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল।

ছবি: রয়টার্স

রাজপ্রাসাদ বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে ভূমিবলের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে জানিয়েছে। এতে বলা হয়, “মহামান‌্য রাজা সিরিরাজ হাসাপাতালে স্থানীয় সময় বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে শান্তিপূর্ণভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন।”

তার মৃত্যুর খবর পেয়ে হাসপাতালের বাইরে জড়ো হয় হাজারো শোকার্ত মানুষ। এসময় অনেককে কাঁদতেও দেখা যায়। অনেকেই  রাজার জন্য প্রার্থনা করে; ফুল দিয়ে জানায় শ্রদ্ধা।

শুক্রবার সকালেও ব্যাংককের রাস্তায় কালো পোশাক পরে রাজার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দেখা গেছে অসংখ্য মানুষকে। এদের একজন গোয়েকর্ন ফুয়াংটং কাজে যাওয়ার পথে অন্য একটি সংবাদমাধ্যমকে তার মনের অবস্থা জানান।

“আমার অনুভূতি প্রকাশ করা যায় এমন কোনো শব্দ নেই। আমার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজনকে হারিয়েছি আমি। মনে হচ্ছে, তার জন্য তেমন কিছুই করিনি আমি; আরও অনেক কিছু করা উচিত ছিল।”

সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের দেশ হিসেবে থাইল্যান্ডে রাজার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা খুব কম হলেও থাইরা ভূমিবলকে তাদের ঐক্যের প্রতীক হিসাবে সম্মান করেছে। থাই জনগণের কাছ থেকে অনেকটা দেবতুল্য সম্মান পেয়েছিলেন রাজা ভূমিবল।

১৯৪৬ সালে ভাইয়ের মৃত্যুর পর রাজা ভূমিবল মাত্র ১৮ বছর বয়সে থাইল্যান্ডের সিংহাসনে আরোহণ করেন। চলতি বছরের জুনে তার সিংহাসনের আরোহনের ৭০তম বার্ষিকী পালন করা হয়।

সিংহাসনে রাজার সাত দশকে থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে বহু অস্থিরতা দেখা গেছে। সেনা অভ্যুত্থানও হয়েছে, তবে রাজা বেশিরভাগ সময়েই রাজনীতির ঊর্ধ্বে ছিলেন।

২০১৪ সালে দেশটিতে সেনাঅভ্যুত্থানের পর সামরিক শাসনের মধ্যে রাজার এ মৃত্যু থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে নতুন করে জটিলতার জন্ম দিতে পারে বলে মনে করছেন বিবিসির সাংবাদিক জোনাহ ফিশার।

ফিশার বলেন, ভূমিবল ছিলেন থাইল্যান্ডের সবার অভিভাবকতুল্য। দ্বিধাবিভক্ত ও ঝঞ্জাবিহ্বল এ দেশে তিনিই ছিলেন শেষ বাতিঘর। তার মৃত্যু দেশটিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেবে।

ছবি: রয়টার্স

রাজনৈতিক এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে নতুন রাজার দায়িত্ব হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা ক্ষমতাসীন সেনা সরকারের জন্যও চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে বলে মন্তব্য করেছেন বিবিসির আরেক সাংবাদিক জোনাথন হেড।

গেল একদশকে থাইল্যান্ডে রাজনৈতিক সহিংসতা ও সংকট তুমুল আকার ধারণ করেছিল। দীর্ঘদীন ধরে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও ধারাবাহিকভাবেই ছোট ছোট বোমা হামলার মাধ্যমে অস্থিরতা জিইয়ে রেখেছে।

সাংবিধানিকভাবে রাজার প্রভাব সীমিত হলেও সংকটকালীন মুহূর্তে দিকনির্দেশনার জন্য থাই জনগণের অধিকাংশই রাজার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তাদের ভরসা ছিল অসংখ্য ক্যু আর ২০বার সংবিধান পরিবর্তনের সাক্ষী রাজা সংকট উত্তরণের পথ বাতলাবেন।

অন্যদিকে রাজার সমালোচকদের ভাষ্য, বারবার সামরিক অভ্যুত্থানকে স্বীকৃতি দিয়ে রাজা দেশটিতে রাজনৈতিক সংকট চালু রেখেছেন। মানবাধিকার বিষয়েও তার কোনো সুস্পষ্ট অবস্থান ছিল না।

নতুন রাজা হিসেবে ক্রাউন প্রিন্স মাহা ভাজিরালঙকর্নের নাম ঘোষিত হলেও তার দায়িত্ব নেয়ার প্রক্রিয়া ‘দীর্ঘ হতে পারে’।

থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুথ চান ওচা জানিয়েছেন, ক্রাউন প্রিন্স রাজা হতে আগ্রহ জানালেও দায়িত্ব বুঝে নিতে সময় চেয়েছেন। এসময় তিনি তার বাবার জন্য শোক পালন করবেন।

বিবিসি বলছে, ৬৪ বছর বয়সী নতুন রাজা থাই জনগণের কাছেও খুব একটা পরিচিত নন। প্রয়াত রাজা ভূমিবলের মত তার ব্যাপক জনপ্রিয়তাও নেই। ক্রাউন প্রিন্স থাকাকালীন সময়েও তিনি থাইল্যান্ডের চেয়ে বিদেশে বিশেষ করে জার্মানিতে বেশি সময় কাটিয়েছেন।

থাইল্যান্ডের আইন দেশটির রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের যে কোনো ধরনের হুমকি ও অপমান থেকে রক্ষা করে। প্রাসাদের উত্তরাধিকার বিষয়ে প্রকাশ্যে যে কোনো ধরনের আলোচনা দেশটিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।