স্তম্ভিত জাপান

স্মরণকালের ভয়াবহ ‘রক্তাক্ত খুনের’ খবরে ঘুম ভেঙেছে জাপানিদের। হতাশা, ক্ষোভে স্তব্ধ পুরো জাপান। নিরাপত্তার চাদরে ঢেকেছে দেশটি।

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 July 2016, 06:49 AM
Updated : 26 July 2016, 07:50 AM

মঙ্গলবার দিনের প্রথম প্রহরে রাজধানী টোকিও’র অদূরে কানাগাওয়া প্রদেশের সাগামিহারার সুকুই ইয়ামারিতে হামলায় ১৯ জন নিহতের ঘটনা জাপানিদের কাছে অবিশ্বাস্য বলেই মনে হয়েছে। টেলিভিশন আর সংবাদপত্রের দিকে সবাই নজর দিলেও এই খুন তারা মেনে নিতে পারছেন না।

বিরল এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২৬ বছর বয়সী সাতোশি ইমাসুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও আতংক যেন পুরো জাপানেই ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রতিবন্ধীদের এই আশ্রয় কেন্দ্রের পাশের বাসিন্দা নাওকি তানাকা বলেন, মধ্যরাতে পুলিশের গাড়ির হর্ন আর চারিদিকে চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙে। আমার ৩০ বছর বয়সে এই ধরনের কোন পরিস্থিতি এখানে দেখিনি তাই কিছুটা বিচলিত হয়ে গিয়েছিলাম। যখন শুনলাম, আমাদের এই প্রতিবন্ধী শিবিরে খুন হয়েছে তখন তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। এ যেন অন্য রকম জাপান মনে হচ্ছে।

চলতি মাসের শুরুতে বাংলাদেশের গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলায় সাত জাপানি নিহত হওয়ার পর পুরো জাপানজুড়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। এই সতর্কতার মধ্যে ঘটে যাওয়া সাতোশি ইমাসুর ছুরির আঘাতে তাৎক্ষণিক ১৫ জন নিহত, পরবর্তী সময়ে ৪ জন হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার খবর ‘কাল্পনিক’ বলে মনে হয়েছিল ইয়োশিমাসা ইকের কাছে।

ঘটনাস্থল থেকে দুই কিলোমিটার দূরে সরকারি বাসায় অবস্থান নেয়া ইয়োশিমাসা বলেন, সকালে হেলিকপ্টার আর অ্যাম্বুলেন্সের অবিরল শব্দে ঘুম থেকে উঠি। মোবাইল ফোনে অনলাইন পত্রিকাগুলোর ব্রেকিং নিউজ দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাই। আমি ভাবতেই পারিনি এই খুন আমার সিটিতে ঘটেছে। এতোদিন বিদেশে সন্ত্রাসী হামলায় খবর দেখেছিলাম কিন্তু আমাদের দেশ কখনো সংবাদ শিরোনাম হবে তা ভাবিনি। 

সাগামিহারা এলাকায় ওই হামলায় আরও অন্ততপক্ষে ৪৫ জন আহত হয়েছেন, যাদের ছয়টি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।

মঙ্গলবার রাত ২ টা ৪০ মিনিটে সুকুই ইয়ামাউরি গার্ডেনে ছুরি হাতে এক ব্যক্তির ঢুকে পড়ার খবর পুলিশকে জানানোর পর সেখানে ১৫টি রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। টেলিভিশনগুলোর ফুটেজে দেখা যায়, প্রতিবন্ধী আশ্রয় কেন্দ্রের পাশে বেশ কিছু অ্যাম্বুলেন্স। পুলিশ রক্তাক্ত লাশ ওই অ্যাম্বুলেন্সগুলোতে তুলছেন।

শান্তিপ্রিয় এই জাতি, সারা বিশ্বে ভদ্রতার পরিচয় বহন করলেও মঙ্গলবার এই হামলার পর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে।

জাপানের কানাগাওয়া প্রদেশের সাগামিহারার প্রতিবন্ধী আশ্রয়কেন্দ্র সুকুই ইয়ামারিতে হামলার পর সেখানে পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি। ছবি: রয়টার্স

জাপানের কানাগাওয়া প্রদেশের সাগামিহারার প্রতিবন্ধী আশ্রয়কেন্দ্র সুকুই ইয়ামারিতে হামলার পর নিহতদের অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স

২০০১ সালে বাণিজ্যিক নগরী ওসাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮ শিশুকে খুন করা হয়। এই শহরের মিনু সিটির বাসিন্দা উতাও সাতো সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃভ্রমণে যাওয়ার অভ্যাস আমার রয়েছে। সেখান থেকে ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন মা এসে জানায় এই খবর। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ ছিল, নিঃশ্বাসও নিতে পারছিলাম না। এটা কীভাবে সম্ভব হলো? আমাদের ধৈর্যশীলতা কি হারিয়ে গেল? কীভাবে একজন ব্যক্তি এতোগুলো মানুষকে  খুন করতে পারে? এটা মেনে নেয়া যায় না। আমরা এই জঘণ্য ব্যক্তির উপযুক্ত শাস্তি চাই।

পুলিশকে উদ্ধৃত করে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম আশাহি শিম্বুন জানিয়েছে, সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তি থানায় গিয়ে ‘আমি এই পৃথিবীকে প্রতিবন্ধীমুক্ত করতে চাই’ বলেছিলেন।

এদিকে ঘটনার পরপরই জাপানের জাতীয় পুলিশ সংস্থা পুরো জাপানজুড়ে সর্তকতার বার্তা দিয়েছে বলে পুলিশের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “গ্রেপ্তার সাতোশির কাছে বেশ কয়েকটি ধারালো অস্ত্র পাওয়া গেছে। তার সাথে কোন উগ্রবাদী সংগঠনের যোগসাজশ আছে কিনা কিংবা কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার রহস্য উম্মোচনের চেষ্টা চলছে।”

তিনি আরো বলেন, “আমরা ৪৭টি প্রদেশেই ইতিমধ্যে বার্তা দিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের তাগদা দিয়েছি। এই ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যপারে সকলকে সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে।”

কানাগাওয়া প্রাদশিক সরকার ১৯৬৪ সাল থেকে মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য এই কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীসময়ে ২০০৫ সালে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কিওডাই কাই তার দেখভালের দায়িত্ব নেয়। প্রতিবন্ধী কেন্দ্রের এপ্রিলের হিসাব মতে সেখানে ১৪৯ জন ছিলেন যাদের বয়স ১৯ থেকে ৭৫ বছরের মধ্যে।

স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০ টায় স্থানীয় প্রশাসনের এক সংবাদ সম্মেলনে সমাজকল্যাণ বিভাগের প্রধানকর্মকর্তা শিনিয়া সাকুমা বলেন, আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে ২৬ বছর বয়সী সাতোশি ইমাসু এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। রাত ২ টা ১০ মিনিটে হামলাকারী সেবাকেন্দ্রটির জানালা ভেঙ্গে প্রবেশ করে হত্যাযজ্ঞ চালান।

এই হত্যাকারী গেল ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এখানে কাজ করেছিলেন, তাই তার এই কেন্দ্র বিষয়ে ভাল ধারণা ছিল। আমরা এই জঘণ্য হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই। প্রশাসন আইনগত সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।