বিশ্বজুড়ে প্রাণক্ষয়ী সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাক্রম

যুদ্ধ হচ্ছে না- এমন স্থানেও প্রাণক্ষয় থেমে নেই সন্ত্রাসী হামলার কারণে। ২০১৫ সালের পর থেকে এই পর্যন্ত এই ধরনের সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন এক হাজারের মতো মানুষ। হামলাগুলোর অধিকাংশই ঘটেছে মুসলিম দেশগুলোতে।

>>রয়টার্স
Published : 23 July 2016, 05:28 AM
Updated : 23 July 2016, 08:30 AM

এসব ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। আর বুরকিনা ফাসোতে হামলার ঘটনায় নাম আসে পশ্চিম আফ্রিকায় ক্রিয়াশীল আল কায়েদা ইন ইসলামিক মাগরেবের (একিউআইএম)।

ফ্রান্সের নিসে ৮৪ জন নিহত

২০১৬ সালের ২৪ জুলাই বাস্তিল দিবসের উৎসবে জড়ো হওয়া জনতার ওপর ট্রাক চালিয়ে দেন এক হামলাকারী, যাতে অন্তত ৮৪ জন নিহত হন। ঘটনাস্থলেই হামলাকারীকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে পুলিশ। আইএসের নামে হামলার দায় স্বীকারের বার্তা এলেও এখন পর্যন্ত হামলাকারীর সরাসরি জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ পায়নি ফ্রান্স কর্তৃপক্ষ।

সৌদি আরবে মদিনাসহ তিনটি স্থানে নিহত ৪

২০১৬ সালের ৪ জুলাই আত্মঘাতী তিন ব্যক্তি ইফতারের সময় মদিনার মসজিদে নববীর পার্কিং লট, জেদ্দায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ও কাতিফের একটি শিয়া মসজিদে বোমা হামলা চালায়। হামলার দায় কেউ স্বীকার না করলেও আগের বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র এ সুন্নি মুসলিম দেশে শিয়া সম্প্রদায় ও নিরাপত্তা বাহিনীর উপর আইএস একই ধরনের হামলা চালিয়েছিল বলে কর্তৃপক্ষের সন্দেহ ওই জঙ্গিগোষ্ঠীর দিকেই।

বাংলাদেশের ক্যাফেতে নিহত ২২

২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানের কূটনীতিকপাড়ায় হলি আর্টিজান বেকারিতে ঢুকে অস্ত্রধারী হামলাকারীরা অন্তত ৩৩ জনকে জিম্মি করে। এর মধ্যে নয় ইতালীয়, সাত জাপানি ও এক ভারতীয়সহ ২০ জনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। জঙ্গিদের হামলা ঠেকাতে গিয়ে বোমার স্প্লিন্টারে মারা যান দুই পুলিশ কর্মকর্তাও। ১২ ঘণ্টা পর কমান্ডো অভিযানে রেস্তোরাঁর নিয়ন্ত্রণ নেয় সশস্ত্রবাহিনী। এ ঘটনায় জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের নামে দায় স্বীকারের বার্তা এলেও ঘটনাটি ‘হোম গ্রোন’ জঙ্গিদের কাজ বলে জানায় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ।

ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে নিহত ৪৫

২০১৬ সালের জুন ২৮ ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক বিমানবন্দরে তিন হামলাকারী বিস্ফোরক ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়ে ৪৫ জনকে হত্যা করে। জঙ্গিদের দুজন যাত্রী লাউঞ্জের ভেতরে ঢুকে হামলা চালায়। অন্যজন বিমানবন্দরের একটি প্রবেশমুখে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিজেকে উড়িয়ে দেয়। হামলার জন্য সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আসা আইএস জঙ্গিদের দায়ী করে তুরস্ক।

ফ্লোরিডার নাইটক্লাবে নিহত ৪৯

২০১৬ সালের ১২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে সমকামীদের একটি নাইটক্লাবে হামলা চালিয়ে ৪৯ জনকে হত্যা করে এক অস্ত্রধারী, যে নিজেকে ‘আইএসের অনুগত’ হিসেবে ঘোষণা দেন। পুলিশ পরে গুলি চালিয়ে ওই হামলাকারীকে হত্যা করে।

ব্রাসেলসে নিহত ৩২

আইএসের তিন আত্মঘাতী হামলাকারী ব্রাসেলস বিমানবন্দর ও মালবেক স্টেশনের একটি মেট্রো রেলে বোমা হামলা চালালে ৩২ জন নিহত হন। হামলাকারী তিনজনই বেলজিয়ামের নাগরিক বলে পরে কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করে। আগের বছর নভেম্বরে প্যারিসের বাতাক্লঁ ও অন্যান্য এলাকায় ভয়াবহ হামলার ঘটনায়ও এদের সম্পৃক্ততা ছিল বলে বেলজিয়াম পুলিশ দাবি করে।

ইস্তাম্বুলে নিহত ৪

কেনাকাটার জন্য ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান ইস্তিকলাল স্ট্রিটে ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী নিজেকে উড়িয়ে দেন; এ ঘটনায় তিন ইসরাইলি ও এক ইরানি পর্যটক মারা যান। তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, হামলাকারী তুরস্কের নাগরিক ও আইএসের সদস্য ছিল।

বুরকিনা ফাসোতে নিহত ২৯

২০১৬ সালের ১৫ জানুয়ারি স্প্লেনডিড হোটেল, কাপুচিনো রেস্টুরেন্ট ও হোটেল ইবিতে হামলা হয়। ওউগাদোউগোউ হামলার দায় স্বীকার করে আল কায়েদা ইন ইসলামিক মাগরেব (একিউআইএম)। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসোয় হওয়া রক্তক্ষয়ী ওই হামলায় অন্তত ২৯ জন নিহত হন, নিহতরা ১৮টি দেশের নাগরিক বলে পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এ ঘটনা পশ্চিম আফ্রিকায় জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ দেয়।

জাকার্তায় নিহত ৪

২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মুসলিম দেশের রাজধানীর সারিনাহ শপিং মলে হামলার পর আইএসের নামে দায় স্বীকারের বার্তা আসে। একটি বিলাসবহুল হোটেল ও দূতাবাস এলাকার কাছে কেনাকাটার স্থানে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী ও অস্ত্রধারীদের চালানো এই হামলায় ৪ জন নিহতের পাশাপাশি ২৩ জন আহত হন।

ইস্তাম্বুলে নিহত ১৩

২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি ইস্তাম্বুলের সুলতান আহমেত স্কোয়ারে আত্মঘাতী হামলা চালান সিরিয়ার শরণার্থী হিসেবে তুরস্কে ঢোকা এক আইএস সমর্থক। আত্মঘাতী ওই বোমা হামলাকারী ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক স্কয়ারে একদল পর্যটকের মাঝে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেকে উড়িয়ে দেন; ঘটনাস্থলেই জার্মানির ১২ ও পেরুর এক নাগরিক নিহত হন।

ক্যালিফোর্নিয়ায় নিহত ১৪

২০১৫ সালের ২ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান বার্নাডিনোর একটি হলিডে পার্টিতে এক দম্পতি হামলা চালিয়ে ১৪ জনকে হত্যা করে; পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে পরে হামলাকারী স্বামী-স্ত্রীরও মৃত্যু হয়।

প্যারিসে নিহত ১৩০

২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর ফ্রান্সের রাজধানীতে কনসার্ট হল, স্টেডিয়াম ও রেস্তোরাঁয় একসঙ্গে অস্ত্র ও বোমা নিয়ে হামলা চালায় আইএসের সদস্যরা। হামলায় ১৩০ জন নিহত ও ৩৬৮ জন আহত হন। হামলায় জড়িত সন্দেহে ১০ জনকে শনাক্ত করে ফরাসি কর্তৃপক্ষ, যাদের মধ্যে ২ জন বেলজিয়াম ও ৩ জন ফ্রান্সের নাগরিক। বেলজিয়ামের দুই হামলাকারী পরে ব্রাসেলস বিমানবন্দর ও মালবেক মেট্রো স্টেশনে হামলার সঙ্গেও জড়িত ছিল।

সৌদি আরবের কাতিফে নিহত ৫

২০১৫ সালের ১৬ অক্টোবর আশুরা পূর্ববর্তী এক উৎসবের সময় অস্ত্রধারীরা কাতিফের সাইহাত গ্রামে হামলা চালিয়ে ৫ শিয়া মুসলমানকে হত্যা করে। আইএস এ হামলার দায় স্বীকার করে।

আঙ্কারায় নিহত ১০২

২০১৫ সালের ১০ অক্টোবর তুরস্কের রাজধানীতে প্রধান রেল স্টেশনের কাছে কুর্দিপন্থি রাজনৈতিক দলের সমর্থক ও নাগরিক সমাজের একটি সমাবেশে পরপর দুটি বোমা বিস্ফোরিত হয়; ওই ঘটনায় মারা যান ১০২ জন। ঘটনার জন্য আইএসের আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের দায়ী করে তুরস্ক।

সৌদিতে মসজিদে নিহত ১৫

২০১৫ সালের ৬ অগাস্ট দক্ষিণ-পশ্চিম সৌদি আরবে স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করা একটি মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ১৫ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে চারজন বাংলাদেশের নাগরিক। আইএস এ হামলার দায় স্বীকার করে।

কুয়েতে মসজিদে নিহত ২৭

২০১৫ সালের জুন ২৬ জুমার নামাজের সময় কুয়েত সিটির জনাকীর্ণ শিয়া মসজিদ ইমাম আল-সাদেকের ভেতরে ঢুকে আত্মঘাতী হামলাকারী নিজেকে উড়িয়ে দিলে ২৭জন নিহত হন। জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) এ হামলার দায় স্বীকার করে।

তিউনিসিয়ায় নিহত ৩৯

২০১৫ সালের ২৫ জুন বন্দুকধারী এক দল ছদ্মবেশ নিয়ে তিউনিসিয়ার ইমপেরিয়াল মারাহাবা হোটেলে ঢুকে লাউঞ্জে থাকা পর্যটকদের গুলি চালিয়ে ৩৯জনকে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে ব্রিটিশ, জার্মান ও বেলজিয়ামের নাগরিক ছিল বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম পরে জানিয়েছে। ইসলামিক স্টেট (আইএস) এ হামলার দায় স্বীকার করেছে।

সৌদির দাম্মামে নিহত ৪

২০১৫ সালের ২৯ মে দাম্মামের শিয়া মসজিদে ঢুকে আত্মঘাতী এক হামলাকারী বিস্ফোরক দিয়ে নিজেকে উড়িয়ে দেয়। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দায় স্বীকার করা এ ঘটনায় চারজন নিহত হয়।

সৌদির কাতিফে নিহত ২১

২০১৫ সালের ২২ মে কাতিফের কুদেহ গ্রামের শিয়া মসজিদে আত্মঘাতী হামলাকারী নিজেকে উড়িয়ে দিলে ২১ জন নিহত হন। জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট এ হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে বিবৃতি দেয়।

তিউনিসিয়ায় নিহত ২২

২০১৫ সালের মার্চ ১৮ বন্দুকধারী হামলাকারীরা সামরিক পোশাক পরে তিউনিসের পার্লামেন্ট ভবনের পাশে বার্দো মিউজিয়ামে ঢুকে পড়ে এবং একে একে ২২ জন দর্শনার্থীকে হত্যা করে; নিহতদের মধ্যে ১৭ জনই জাপান, ইতালি, কলম্বিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, পোল্যান্ড ও স্পেনের নাগরিক। ইসলামিক স্টেট (আইএস) হামলার দায় স্বীকার করলেও তিউনিসিয়ার সরকার জানায়, আলজেরিয়ার সীমান্তবর্তী চাম্বি পাহাড়কেন্দ্রীক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ওকবা ইবনে নাফা হামলার সঙ্গে জড়িত।

প্যারিসে সংবাদপত্র কার্যালয়ে নিহত ১২

২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি দুই ইসলামী জঙ্গি প্যারিসের রম্য সাপ্তাহিক শার্লি এবদো’র সম্পাদকীয় বৈঠকে ঢুকে গুলি চালিয়ে ১২ জনকে হত্যা করে। আরেক জঙ্গি পরদিন এক নারী পুলিশ সদস্য ও ৯ জানুয়ারি একটি সুপারমার্কেটে ঢুকে চার জিম্মিকে হত্যা করে। হামলাকারী নিজেও পরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। রক্তক্ষয়ী ওই হামলার পরপরই বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদবিরোধী সংহতি সমাবেশে ‘জে সুই শার্লি’ (আমিই শার্লি) স্লোগান জনপ্রিয় হয়ে উঠে।