‘ব্রেক্সিট’ ভোট ডেকে আনতে পারে যেসব ক্ষতি

বৃহস্পতিবারের গণভোটে পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ছাড়ার জন্য একটি আবেদন জমা দিতে পারে যুক্তরাজ্য।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 June 2016, 06:42 PM
Updated : 24 June 2016, 08:55 PM

এরপর অন্তত দুই বছর বিচ্ছেদ সংক্রান্ত আলোচনায় ঠিক হবে, যুক্তরাজ্য কোন প্রক্রিয়ায় ইইউ ছাড়বে।

ইইউ গঠনের পর যুক্তরাজ্যই প্রথম দেশ, যারা ২৮ জাতির এই জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের এই বেরিয়ে যাওয়াকে সংক্ষেপে বলা হচ্ছে ‘ব্রেক্সিট’।

বলা হচ্ছে, এর ফলে কেবল যুক্তরাজ্যের ভাগ্যই বদলাবে না, বদলে যাবে ইউরোপ এবং আগামী প্রজন্মের রাজনীতি। প্রভাব পড়বে বিশ্বজুড়েই।

ঐতিহাসিক এ সিদ্ধান্তের প্রথম বলি হয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। বিচ্ছেদের বিরোধিতা করে আসা ক্যামেরন ইতোমধ্যে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।

যুক্তরাজ্যের ইইউ ত্যাগের পর উভয় পক্ষের ভবিষ্যৎ কি হতে পারে তা নিচে তুলে ধরা হল।

অর্থনীতি

ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে যুক্তরাজ্যকে আর সংস্থাটির বাজেট আইন মেনে চলতে হবে না। ইইউ-র বাজেট আইন অনুযায়ী, কোনো সরকার জিডিপি-র ৩ শতাংশের বেশি ঘটতি বাজেট দিতে পারবে না। এছাড়া, সরকারি ঋণ জিডিপি-র ৬০ শতাংশের বেশি হবে না।

এতে করে ব্রিটেনের বাজেট ঘাটতির পরিমাণ অনেক বেশি বেড়ে যেতে পারে এবং তা পূরণ করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। ইউরোপীয় কমিশনের পর্যবেক্সণ এবং ভবিষ্যৎ পদক্ষেপের জন্য পরামর্শও তখন  ব্রিটেন আর পাবে না।

অর্থব্যবস্থা

যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে দেশটির ব্যাংক থেকে শুরু করে সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইইউ পাসপোর্ট-বাণিজ্য সুবিধা হারাবে। যে পদ্ধতিতে তারা কম খরচে ইইউ এর ২৮ টি দেশে সেবা বিক্রি করতে পারত।

এই পাসপোর্ট পদ্ধতির সুবিধার কারণেই লন্ডন বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।

এদিক দিয়ে ক্ষতি ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং ইউরোপের বাইরের অনেক দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের ইউরোপীয় প্রধান কার্যালয় লন্ডনে অবস্থিত। ব্রেক্সিটের পর তারা ইইউ ভূক্ত অন্যান্য দেশগুলোতে সেগুলো সরিয়ে নেওয়ার কথা বিবেচনা করবে। ফলে এটিও হবে একটি বড় ক্ষতি।

বাণিজ্য

ইইউ থেকে ব্রিটেন বের হয়ে গেলে দেশটির অর্থনীতিকে প্রায় ১০ হাজার কোটি ইউরোর ধাক্কা সামলাতে হবে।

ব্রিটেনের সঙ্গে ইইউভূক্ত অন্যান্য দেশগুলোর পণ্য বাণিজ্য উদ্বৃত্ত প্রায় ১০ হাজার কোটি ইউরো (১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। একইসঙ্গে যুক্তরাজ্য আমদানীর তুলনায় ২০ মিলিয়ন ইউরো সমমূল্যের সেবা বেশি রপ্তানী করে, যেগুলো মূলত অর্থনৈতিক সেবা।

যদিও ব্রেক্সিটের পক্ষের শিবির যুক্তি দিয়েছে যে, যুক্তরাজ্য ইইউ ত্যাগ করলেও  জোটটি নিজ আগ্রহে ব্রিটেনের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে রাজি থাকবে।

প্রতিযোগিতা

যুক্তরাজ্যের ওইসব কোম্পানি যারা ইইউ ভূক্ত অন্যান্য দেশ থেকে কর্মী নিয়োগ দিত তাদের এখনো ‘ইউকে কম্পিটিশন ওয়াচডগ’ ও ‘ইউরোপিয়ান কমিশনের’ অনুমতি নিতে হবে। এক্ষেত্রে আইনি ব্যয় বেশি হওয়া ছাড়াও দুই সংস্থার আলাদা আলাদা  রায়েরও ঝুঁকি থাকবে।

এখন থেকে রুগ্ন কোম্পানি ও কারখানাকে স্বাধীনভাবে সহায়তা করতে পারবে যুক্তরাজ্য সরকার। এক্ষেত্রে ইইউ-র চোখ রাঙ্গানির পরোয়া করতে হবে না।

তবে এখন থেকে ইইউ সদস্যভূক্ত দেশগুলোর অন্যান্য কোম্পানিকে ইইউ ভর্তুকি দিতে চাইলে যুক্তরাজ্য আর আপত্তি করতে পারবে না।

জ্বালানি খাত

ইইউ ত্যাগের ফলে যুক্তরাজ্যের জ্বলানি পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ আরও ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। সেইসঙ্গে নতুন প্রকল্পগুলোর কাজ নির্ধারিত সময়ের চেয়ে পিছিয়ে পড়বে।

অভিবাসীদের জন্য অনিশ্চয়তা

ইইউ দেশগুলোর মধ্যে অবাধে চলাফেরা জোটটির অন্যতম একটি বড় অর্জন। যে কোনও একটি ইইউ দেশের নাগরিক অবাধে সব দেশে যেতে পারেন। করতে পারেন কাজও। ব্রিটিশরাসহ বিদেশিরাও এ সুবিধা ভোগ করে এসেছে। ইইউ দেশগুলোতে যেমন বহু ব্রিটিশ আছে তেমনি ব্রিটেনেও অনেক অ-ব্রিটিশ ইইউ নাগরিক বাস করে। ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে তাদের অবাধ চলাচলের ওই সুযোগও আর থাকবে না। যুক্তরাজ্য নতুন করে এ ব্যাপারে নতুন করে চুক্তি করতে চাইলেও অভিবাসন সমস্যার কারণে বিশেষ করে তুলনামূলক দুর্বল অর্থনীতির দেশ পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া থেকে অভিবাসীদের আগমন  সমস্যার কারণে ব্রিটিশ সরকার এ ধরনের ব্যবস্থা না করার জন্য চাপে পড়বে।

তাছাড়া, অবাধ চলাচলের স্বাধীনতা হারালে ব্রিটেনে ঢোকা কিংবা ব্রিটেনের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে মানুষেরা পাসপোর্ট এবং রেসিডেন্সির নিয়ম কানুন নিয়ে উদ্বেগে পড়বে। ফলে তারা ব্রিটেনে থাকার এবং কাজ করার অধিকারও হারাতে পারে এবং াদেরকে দেশে ফেরত যেতে হতে পারে। ফলে বিসয়টি নিয়ে ব্যাপক অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।

যুক্তরাজ্য ভেঙে পড়তে পারে

ইইউ ত্যাগে যুক্তরাজ্য মৌলিক দিক থেকে আমূলভাবে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে।

চারটি ‘দেশ’ (ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড) এর সমন্বয়ে ব্রিটেনকে বলা হয় ‘ইউনাইটেড কিংডম’। ইইউ থেকে যুক্তরাজ্য বেরিয়ে গেলে এই একতা আর দীর্ঘদিন নাও থাকতে পারে।

জরিপে দেখা গেছে, স্কটল্যান্ডের নাগরিকরা ইইউয়ে থাকাকেই সমর্থন করে। তারা ব্রিটেনের সঙ্গে থাকাও পছন্দ করে না। ৪৪ শতাংশ স্কটিশই ২০১৪ সালে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়েছে।

জলবায়ু

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ইইউ-র পক্ষ থেকে সমস্যা সমাধানে একজোট হয়ে কাজ করার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল সেটাও বেক্সিটের কারণে বাধাগ্রস্ত হবে।

বিমান চালনা

বেক্সিটের কারণে উন্মুক্ত আকাশসীমা বিষয়ে ইইউ চুক্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

চুক্তি অনুযায়ী, ইইউ ভূক্ত দেশগুলোর বিমান কোম্পানি পরষ্পরের আকাশসীমায় অবাধে প্রবেশের সুযোগ পায়। যার ফলে ইইউ এবং যুক্তরাজ্য উভয় পক্ষের এয়ারলাইন্সগুলো লাভবান হচ্ছিল।

এছাড়া, ট্রান্সআটলান্টিক রুটে বিমান চলাচলও ব্যাহত হবে। ‘ইইউ-যুক্তরাষ্ট্র ওপেন স্কাইস’ চুক্তির কারণে ট্রান্সআটলান্টিক রুট দিয়ে ব্রিটিশ বিমানগুলো অবাধে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ সীমায় প্রবেশের অধিকার পেত।

বৈদেশিক নীতি

ইইউ-র বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ফ্রান্সের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এছাড়া, ইইউ-যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ মিত্র। ‍উভয়পক্ষ মিলে বড় ধরণের সামরিক সক্ষমতা অর্জন করেছে।

বেক্সিটের পর যুক্তরাজ্যের প্রভাব কমে যাওয়ার কারণে ওয়াশিংটন পরিষ্কারভাবেই বলে দিয়েছে, তারা লন্ডনের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক বজার রাখতে আর তেমন আগ্রহী নয়।

বৈদেশিক নীতি বিষয়ে ইইউ-র অবস্থান মেনে নেওয়ার বাধ্যবাধকতাও যুক্তরাজ্যের উপর থাকছে না।

বিচার এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি

ইইউ ভূক্ত থাকার সময়ও বিচার ও অভ্যন্তরীন বিষয়ে যুক্তরাজ্য আলাদা নীতি পালন করেছে। যেমন, তারা ইইউ’র ভিসা মুক্ত শেনজেন অঞ্চলে ছিল না।

তবে যুক্তরাজ্য ইইউ ভূক্ত অন্যান্য দেশের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা স্বীকার করত এবং পুলিশি তথ্য বিনিময় (এমনকি ব্যক্তিগত তথ্যও) করত। সেই সঙ্গে ইউরোপোলের সদস্যও ছিল।

কিন্তু ভবিষ্যতে ইইউ’র তথ্যভান্ডারে তাদের প্রবেশাধিকার সীমিত করা হবে। যার অর্থ অপরাধ দমন ও পুলিশি ব্যবস্থায় সহযোগিতা কমে আসবে।