জি-সেভেন সম্মেলনে যোগ দিতে জাপান সফররত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শুক্রবার হিরোশিমায় ঐতিহাসিক সফরে যাচ্ছেন। তার এ সফরকে ঘিরে হিরোশিমাসহ পুরো বিশ্ব তাকিয়ে আছে।
৭০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ছুড়ে দেওয়া ‘লিটল বয়’ আর ‘ফ্যাটবয়’ নামের পারমাণবিক বোমায় বিধ্বস্ত হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরের ধ্বংসলীলা দেখতে বারাক ওবামা যাওয়ার কথা স্বীকার করলেও ক্ষমা তিনি চাইবেন না বলে আগেই জানিয়েছেন।
আর এই ক্ষমা কোন সমাধান হতে পারে না উল্লেখ করে পারমাণবিক বোমায় আক্রান্ত শসো মুনেতো বলেন, হিরোশিমাকে মনে রাখা নয়, আমরা চাই হিরোশিমার মতো আর কোন শহর যাতে দ্বিতীয় বারের মতো আক্রান্ত না হয়।
তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা নয়, আর কখনও যুদ্ধে এ ধরনের ধ্বংসলীলা দেখতে চাই না।”
৮৮ বছর বয়সী শসো মুনেতো যুদ্ধের সময় হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এক কারিগরি স্কুলে পড়াশোনা করতেন।
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে এনোলা গে নামে একটি বি-২৯ বোমারু বিমান ‘লিটল বয়’ নামের পারমাণবিক বোমাটি নিক্ষেপ করে হিরোশিমা শহরের ঠিক কেন্দ্রে।
বিস্ফোরণের পর কেন্দ্রের তাপমাত্রা ছিল ১০০০ ফারেনহাইট। শহরের ৪ বর্গমাইল এলাকা মুহূর্তেই ভষ্মীভূত হয়ে মাটিতে মিশে যায়।
বোমা হামলার কেন্দ্রস্থল থেকে ২ দশমিক ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন তশিকু তানাকা।
আক্রান্ত ৭৭ বছর বয়সী এ নারী বলেন, ২০০৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্যারাগুয়েতে এক বক্তৃতায় ‘পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন বিশ্ব’ গড়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন, এর বাস্তবায়ন আমরা চাই।
আজ ক্ষমা চাইলে কাল মানুষ হয়ত ভুলে যাবে, কিন্তু একটি পারমাণবিক বোমার আঘাত আমরা ৭০ বছরেও ভুলতে পারিনি।
পারমাণবিক বোমার ধ্বংসলীলা বর্ণনা করে তশিকু তানাকা আরও বলেন, আমরা আর কালো বৃষ্টি চাই না, এবার নীল আকাশের সবুজ বিশ্ব দেখার সাহস যুগাতে চাই।
১৯৩৯ সালের আগে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, বেলজিয়াম, জাপান উপনিবেশ বিস্তার করেছিল। এরই প্রেক্ষিতে শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। জাপানের আক্রমনে কোরিয়া ও চীনে ধ্বংসযজ্ঞ চলে।
এই অপবাদ আর গ্লানি মুছতে গত বছর ৬ অগাস্ট হিরোশিমার সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের ভূমিকার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এর কয়েক মাস পর গত অক্টোবরে দক্ষিণ কোরিয়ার তৎকালীন জাপানি সেনাদের জন্য যৌনদাসীদের ক্ষতিপূরণের জন্য ১শ’ মিলিয়ন ডলার দেয়ার ঘোষণাও আসে।
জাপান ক্ষমা চাইলেও এককালের শত্রু বর্তমানে মিত্র রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া দাবিটিও দীর্ঘদিনের।
ওবামা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এনএইচকে’কে কয়েকদিন আগে এক বিশেষ স্বাক্ষাৎকারে ‘জাপানের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, যেকোন যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সেই সময়ের নেতারা নিয়ে থাকেন আর তাদের স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের দায়িত্বও বটে।
আর আমার হিরোশিমার সফর মূলত অতীতে ফিরে যাওয়া নয়। ইতিহাসবিদদেরও চাওয়া ছিল হিরোশিমায় যাওয়ার। গত সাড়ে সাত বছর ধরে একজন নেতা হওয়ার পরও এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে আমার অনেক সময় লেগেছে।
ওবামার এই কথায় হিরোশিমাবাসীর পাশাপাশি ওবামার নিজ দেশের একদল ইতিহাসবিদ, চলচ্চিত্র পরিচালক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
সোমবার ৭৪ জন বিশিষ্ট মার্কিন নাগরিক হোয়াট হাউজে লিখিত এক বার্তায় ওবামাকে হিরোশিমায় ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানান। এই দলে রয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ওলিভার স্টোন, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক পেটার কুজনিক রয়েছেন।
ক্ষমা চাওয়া সমাধান নয় উল্লেখ করে আরেক বোমা আক্রান্ত সাদাও ইমামতো বলেন, আমেরিকা বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পারমাণবিক বোমা ব্যবহার বন্ধ করার তাগিদ দিতে পারছে না।
৮৮ বছর বয়সী সাদাও আরো বলেন, আমার মৃত্যুক্ষণ কাছে আসছে, আমি আশা রাখবে যুক্তরাষ্ট্র হিরোশিমা সফর করে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে যেন পৃথিবীতে আর কোন পারমাণবিক বোমার বিপর্যয় না হয়।
হিরোশিমায় অঙ্গহানি হওয়া সেইজি তাকাতো বলেন, বিশ্ববাসী হিরোশিমা থেকে শিক্ষা নিয়েছে। আমরা চাই অচিরেই ‘পারমাণবিক অস্ত্র’ প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়ে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবাই একযোগে কাজ করুক।