গণতন্ত্রের সংলাপে শান্তির নোবেল

‘জেসমিন বিপ্লবের’ পর গৃহযুদ্ধের দুয়ারে থাকা তিউনিসিয়াকে শান্তিপূর্ণ জাতীয় সংলাপের মধ্য দিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নেওয়ার স্বীকৃতি হিসেবে শান্তির নোবেল পুরস্কার পেল আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী চার সংগঠন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Oct 2015, 09:18 AM
Updated : 9 Oct 2015, 04:38 PM

নরওয়ের নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান পঞ্চম কাচি কুলমান শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে চলতি বছরের পুরস্কার ঘোষণা করেন।

তিউনিসিয়ার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী এই চার সংগঠন হল- তিউনিসিয়ান জেনারেল লেবার ইউনিয়ন (ইউজিআইটি); দি তিউনিসিয়ান কনফেডারেশন অব ইন্ডাস্ট্রি, ট্রেড অ্যান্ড হ্যান্ডিক্র্যাফটস (ইউটিআইসিএ); তিউনিসিয়ান হিউম্যান রাইটস লিগ (এলটিডিএইচ) এবং তিউনিসিয়ান অর্ডার অব ল’ইয়ারস। 

নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান বলেন, ২০১১ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর তিউনিসিয়াকে একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে প্রধান ভূমিকা রাখে এই চতুষ্টয়। 

“এই চতুষ্টয় গঠিত হয় ২০১৩ সালের গ্রীষ্মে, যখন সামাজিক অস্থিরতা আর রাজনৈতিক হত্যার ঘটনায় গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রক্রিয়া পণ্ড হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছিল। তিউনিসিয়া যখন গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল, এই চতুষ্টয় তখন বিকল্প একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করতে পেরেছিল। আর এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তিউনিসিয়ায় একটি সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়, যে সরকার ধর্ম, লিঙ্গ, রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বেশেষে সবার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলে।”     

নোবেল কমিটির এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে জাতিসংঘের মুখপাত্র আহমাদ ফাওজি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, “শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টায় সুশীল সমাজের সহযোগিতা আমাদের দরকার।”

আর নোবেলজয়ী চতুষ্টয়ের সদস্য ইউজিটিটির প্রধান হুসেইন আব্বাসি এই পুরস্কারকে উৎসর্গ করেছেন সেইসব তিউনিসীয়দের উদ্দেশে, যারা ‘গণতন্ত্রের আন্দোলনে শহীদ’ হয়েছেন।  

“তরুণদের সেই প্রচেষ্টা আমাদের ইতিহাস থেকে স্বৈরশাসনের পাতা উল্টে সামনে এগোনোর পথ করে দিয়েছে।”

হিউম্যান রাইটস লিগের প্রধান আবদেসাত্তার বেন মুসা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, তিউনিসিয়া যখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সন্ত্রাসী হুমকির একটি সময় পার করছে, তখন এই পুরস্কার জনগণের জন্য আনন্দের সুবাতাস নিয়ে এল।

ইসলামপন্থি ও সেকুলার জোটের মধ্যে ওই সংলাপের পর গত বছর তিউনিসিয়ার ইতিহাসে প্রথম ‘অবাধ, নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক’ নির্বাচন হয়, যাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন বেজি সেইড ইসেবসি।

পুরস্কারের খবরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, নোবেল কমিটির এই সিদ্ধান্ত তার দেশের জনগণের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন বলেই তিনি মনে করেন।

ফেইসবুকে পোস্ট করা এক ভিভিও বার্তায় তিনি বলেছেন, “আদর্শিক দ্বন্দ্বের মধ্যে সংলাপ ছাড়া সমাধানে পৌঁছানোর আর কোনো পথ তিউনিসিয়ার সামনে খোলা ছিল না।”  

আরব বসন্তের ‘একমাত্র ফুটন্ত ফুল’

২০১০ সালের ১৮ ডিসেম্বর পুলিশের দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে মোহাম্মদ বোয়াজিজি নামের এক তরুণের আত্মাহুতির মাধ্যমে তিউনিসিয়ায় আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের রূপ পায় এবং ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি দেশটির প্রেসিডেন্ট জিনে আল আবিদিন বেন আলির ২২ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।

তিউনিসিয়ার জাতীয় ফুলের নামে যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক এন্ডি কারভিন এই গণআন্দোলনের নাম দেন ‘জেসমিন বিপ্লব’। পশ্চিমা গণমাধ্যমের কল্যাণে দ্রুত ওই নাম বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পায়।  

‘জেসমিন বিপ্লবের’ পথ ধরে উত্তর আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শুরু হয় দীর্ঘ দিনের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের দাবিতে গণআন্দোলনের ঝড়, যা ‘আরব বসন্ত’ নাম পায়। তিউনিসিয়ার পর মিশর আর লিবিয়াতেও স্বৈরশাসকের পতন দেখে বিশ্ব।

নোবেল কমিটি বলছে, এসব দেশের প্রায় সবগুলোই এখনও ভুগছে; তাদের গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের দাবি এখনও থমকে আছে। তবে নাগরিক সমাজের স্বতঃস্ফূর্ততায় তিউনিসিয়ায় একটি গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে।

“এই চতুষ্টয় তিউনিসিয়ার সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। আইনের শাসন ও মানবাধিকারের মৌলিক ধারণা নিয়ে তারা মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে কাজ করে। এর ভিত্তিতেই তারা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় এগিয়ে আসে এবং তিউনিসিয়াকে শান্তি ও গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নেওয়ার নৈতিক দায়িত্বটি পালন করে।”  

পঞ্চম কাচি কুলমান বলেন, “আলাদা সংগঠন হিসেবে নয়, সেই যৌথ প্রচেষ্টার জন্যই এই চতুষ্টয়কে ২০১৫ সালের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।”

এ পুরস্কারের প্রবর্তক আলফ্রেড বার্নার্ড নোবেল তার উইলে যে শান্তি সম্মিলনের কথা বলে গেছেন, এই চতুষ্টয়ের কাজ ‘সরাসরি তার সঙ্গে তুলনীয়’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন। 

বিস্ময়

এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারের মনোনয়নে ২০৫ জন ব্যক্তি ও ৬৮টি প্রতিষ্ঠানের নাম আসে, যাদের মধ্যে জার্মানির চ্যান্সেলার আঙ্গেলা মের্কেল, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, পোপ ফ্রান্সিস, কঙ্গোর চিকিৎসক ডেনিস মাকোয়েজ ও রাশিয়ার সংবাদপত্র নভোয়া গেজেটাও ছিল।

শেষ পর্যন্ত সব আলোচনার বাইরে থেকে তিউনিসিয়ার গণতন্ত্রের সংলাপের নোবেল পেয়ে যাওয়ার খবর অনেকের জন্যই বিস্ময় নিয়ে এসেছে।

জনতার বিপ্লবের পর উগ্র ইসলামপন্থিদের উত্থান এবং বহু বছর ধরে চলে আসা তিউনিসিয়ার ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের মধ্যে সংঘাত গুরুতর আকার ধারণ করার পর আলোচনার বার্তা নিয়ে দৃশ্যপটে আসে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি চার সংগঠন।

এই চতুষ্টয় বিবদমান পক্ষ দুটিকে এক টেবিলে আনার পর প্রাথমিকভাবে রাজপথের উত্তাপ কমে এলেও সেই সংলাপের সাফল্য অনেক আগেই ফিকে হয়ে এসেছে বলে সমালোচকদের ভাষ্য।

যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ার সঙ্গে লাগোয়া তিউনিসিয়ার জন্য নিরাপত্তা একটি বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। চলতি বছরই দুটি বড় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় অন্তত ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে সেখানে।   

বিবিসির তিউনিসিয়া প্রতিবেদক রানা জাওয়াদ লিখেছেন, “অনেকেই আজ এখানে নোবেল বিজয় উদযাপন করবে। কিন্তু নোবেল কমিটির ঘোষণায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করেন, সংলাপের সমঝোতা তিউনিসিয়ায় উগ্রপন্থার উত্থানের পথ খুলে দিয়েছে; সামাজিক ন্যায়বিচার চাইলে আরও অনেক পথ যেতে হবে।”

শিশু ও তরুণদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে গত বছর শান্তিতে নোবেল পান তালেবান হামলায় বেঁচে যাওয়া পাকিস্তানি কিশোরী মালালা ইউসুফজাই এবং ভারতের শিশু অধিকারকর্মী কৈলাস সত্যার্থী।

পুরস্কার বাবদ একটি সোনার মেডেল ও ৮০ লাখ সুইডিশ ক্রোনার (১২ লাখ ৫০ হাজার ডলার) পাবেন চলতি বছরের বিজয়ীরা। আগামী ১০ ডিসেম্বর অসলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে এ পুরস্কার।