বলা হচ্ছে, হার্ডওয়্যার, ডিজাইন, ফিচার সব দিক থেকেই প্রথম দেখাতেই চমকে দিয়েছে অ্যাপল ওয়াচ। অন্তত প্রযুক্তিবোদ্ধা আর ফ্যাশনগুরুদের প্রাথমিক অভিব্যক্তি তাই বলে।
তবে, নান্দনিক ব্যখ্যা আপাতত তোলা থাক। এই লেখায় আমরা বোঝার চেষ্টা করব অ্যাপল ওয়াচের কারিগরি বিষয় নিয়ে, যতটুকু অ্যাপল জানাচ্ছে তাদের সর্বশেষ চমক সম্পর্কে।
প্রতিটি মডেলের কেসিং তৈরিতেই ব্যবহার করা হয়েছে আলাদাভাবে তৈরি শংকর ধাতু। ‘অ্যাপল ওয়াচ’ মডেলটির কেসিং আর চেইন তৈরি হয়েছে স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে। স্পোর্ট মডেলটির কেসিংয়ে ব্যবহার করা হয়েছে অ্যালুমিনিয়াম অ্যালয়, আছে কয়েক রঙের রাবার স্ট্র্যাপ।
আর এডিশন মডেলটির কেসিং ১৮ ক্যারেটের সোনায় মোড়ানো। ‘ইয়ালো গোল্ড’ আর ‘রোজ গোল্ড’ দুটি রঙে কিনতে পাওয়া যাবে এটি। স্ট্র্যাপ বানানো হয়েছে চামড়া দিয়ে।
তিনটি মডেলই কিনতে পাওয়া যাবে দুটি ভিন্ন আকারে। যারা একটু ছোট আকারের ঘড়ি পছন্দ করেন তাদের জন্য ৩৮ মিলিমিটার (দেড় ইঞ্চি) কেসিং আর বড় ঘড়ি যাদের পছন্দ, তাদের জন্য ৪২ (১.৬৫ ইঞ্চি) মিলিমিটারের কেসিং।
‘নিখুঁত’ সময়!: একটা ঘড়ির মূল কাজই সঠিক সময় জানান দেওয়া, আর অ্যাপল ওয়াচে ঘড়ির এই মূল ফিচারটিকেই নিয়ে গেছে নতুন এক উচ্চতায়। স্মার্টওয়াচটি যে আইফোনের সঙ্গে কাজ করবে সেটা পুরানো খবর। নতুন খবর হচ্ছে আইফোনের সঙ্গে জোট বেঁধে ‘আন্তর্জাতিক সময়’ জানান দেবে অ্যাপল ওয়াচ। অ্যাপল সিইও টিম কুক দাবী করলেন, অ্যাপল ওয়াচে সময়ের হেরফের হতে পারে বড়জোর সেকেন্ডের ২০ ভাগের এক ভাগ। এক টাইম জোন থেকে আরেক টাইম জোনে পা দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপডেট হয়ে যাবে অ্যাপল ওয়াচের সময়। দৈনন্দিন রুটিন আর জীবনের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনা মনে করিয়ে দিতে অ্যালার্ট সার্ভিস তো আছেই।
স্পর্শেই যোগাযোগ: না, এটা কেবল ‘টাচ স্ক্রিনে’র বিষয় নয়। স্মার্টওয়াচ থেকে মেসেজিংয়ের ব্যাপারটাও আমূল পাল্টে দিয়েছে অ্যাপল। ব্যবহারকারীর হাতের ত্বক স্পর্শ করে থাকবে অ্যাপল ওয়াচের ৪টি সেন্সর। ইনকামিং মেসেজ বা নোটিফিকেশন এলে ত্বকে হালকা ‘ট্যাপ’ করে ব্যবহারকারীকে জানিয়ে দেবে অ্যাপল ওয়াচের সেন্সরগুলো।
কাছের মানুষের কাছে হৃদস্পন্দন পৌছে দিতে চান? আক্ষরিক অর্থেই তার উপায় করে দিয়েছে অ্যাপল। অ্যাপল ওয়াচের স্ক্রিনে দুই আঙ্গুল চেপে রাখলেই বিল্ট-ইন হার্টরেট সেন্সর রেকর্ড করবে আপনার হৃদস্পন্দন, পাঠিয়ে দেবে প্রিয় মানুষের কাছে। তবে হ্যা, তার কাছেও থাকতে হবে অ্যাপল ওয়াচ।
অবশ্য সবাইতো আর চিকিৎসাবিজ্ঞানে পারদর্শী নন, রেকর্ড করা হৃদস্পন্দনের মর্ম উদ্ধারই বা কয় জন করতে পারবেন! সমাধান আছে সে সমস্যারও। অ্যাপল ওয়াচের ডিসপ্লেতে আঙুল ঘুরিয়েই একে নেওয়া যাবে যা ইচ্ছে তাই। সেটা ‘হার্ট শেইপ’ হোক বা ‘অ্যাংরি ফেইস’ যাই হোক না কেন, এক প্রান্ত থেকে ব্যবহারকারী আঁকবেন আর আরেক প্রান্ত থেকে অ্যাপল ওয়াচের ডিসপ্লেতেই সেই আঁকাআঁকি দেখতে পারবেন পছন্দের (বা অপছন্দের!) মানুষটি।
এখানেই শেষ নয়, প্রিয় মানুষকে নিজের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যেও আছে ‘ট্যাপ’ ফিচার। অ্যাপল ওয়াচের ডিসপ্লেতে ছোট্ট একটা ট্যাপ, আর প্রিয় মানুষটির হাতে থাকা অ্যাপল ওয়াচের বিল্ট-ইন সেন্সরগুলো তার ত্বকে ট্যাপ করে জানিয়ে দেবে, আপনি ভাবছেন তার কথা। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রিদমও প্রোগ্রাম করা যাবে স্মার্টওয়াচটিতে।
ওয়াকি-টকি ফিচারটি অবশ্য বেশি কাজে আসবে বন্ধুদের সঙ্গে দুষ্টুমি করতে চাইলে। বিল্ট-ইন স্পিকার আর মাইক্রোফোন দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সেরে নেওয়া যাবে ছোট ছোট কথপোকথনগুলো।
আর টেক্সট মেসেজ লিখতে না চাইলে আছে থ্রিডি ইমোজি। নিজের প্রয়োজনমতো ইমোজিগুলোকে এডিটও করতে পারবেন ব্যবহারকারী। অ্যাপল ওয়াচের ডিসপ্লেতে হলুদ ইমোজিগুলোর বিভিন্ন অংশ স্পর্শ করেই সেরে নেওয়া যাবে এডিটিংয়ের কাজটা। ধরুন, বন্ধুর কোনো মেসেজ রিতিমতো বিস্মিত আপনি, সেটা প্রকাশ করতে ফিরতি মেসেজের হলুদ ইমোজির মুখটা না হয় একটু টেনে ধরলেন, বন্ধুর কাছে যখন মেসেজটা পৌঁছাবে, মুখ হা করে নড়েচড়ে আপনার বিস্ময় বন্ধুকে জানিয়ে দেবে ছোট্ট ইমোজি।
ফোন কলের জন্য এতে আছে বিল্ট-ইন স্পিকার আর মাইক্রোফোন। লম্বা সময় ধরে কথা বলতে চাইলে কল ট্রান্সফার করে দেওয়া যাবে আইফোনে। এমনকি কল ট্রান্সফার করা যাবে গাড়ির স্পিকার আর ব্লুটুথ হেডফোনেও। আর ইনকামিং কল সাইলেন্ট করতে চাইলে শুধু হাত দিয়ে ঢেকে ফেলতে হবে অ্যাপল ওয়াচের ডিসপ্লে।
মেইল এলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারকারীকে জানিয়ে দেবে অ্যাপল ওয়াচ। হাত ঘড়িতেই মেইল পড়ে ‘রিড’ বা ‘আনরিড’ হিসেবে মার্ক করে রাখা যাবে, ফ্ল্যাগ করা যাবে, ডিলিটও করা যাবে সহজেই। মেইলের উত্তরটা বেশ লম্বা হবে? এতেও সমস্যা নেই আইফোনে ট্রান্সফার করে লিখে ফেলা যাবে উত্তরটা।
ফিটনেসে অ্যাপল ওয়াচ: বাজারের প্রচলিত স্মার্টওয়াচগুলোর নির্মাতারা তাদের পণ্যগুলো বাজারজাত করার সময় একটা বড় ফিচার হিসেবে বিবেচনা করছে ফিটনেস এবং হেলথ ট্র্যাকিং প্রযুক্তি। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই অ্যাপলও। ব্যবহারকারীর প্রতিদিনকার কাজের উপর নজর রাখবে অ্যাপল ওয়াচের বিল্ট-ইন সেন্সর আর অ্যাপগুলো। প্রতিদিন শারিরীক অবস্থা, হৃদস্পন্দন, কতটুকু শরীরচর্চা প্রয়োজন-- এর সব কিছুই থাকবে অ্যাপল ওয়াচের নজরে।
ডিজিটাল ক্রাউন!: স্মার্টওয়াচটির ব্যবহার সহজ করতে চেষ্টা কম করেনি অ্যাপল। অ্যানালগ হাতঘড়ি পরে যারা অভ্যস্থ তারা তাদের কাছে ‘ক্রাউন’ বা ‘ঘড়ির চাবি’ একেবারেই সহজ বিষয়। ঘড়ির সেই অনুভূতি রাখতে অ্যাপল ওয়াচেও আছে ‘ডিজিটাল ক্রাউন’। তবে এটার কাজ শুধু সময় বা তারিখ ঠিক করা নয়। অ্যাপল ওয়াচের স্ক্রিনের আইকনগুলো জুম করা বা স্ক্রল করা অনেক সহজ করে দেবে এই ‘ডিজিটাল ক্রাউন’।
হোম বাটন হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে এটি। অ্যাপল ওয়াচে টাচস্ক্রিন আছে বৈকি, তবে স্মার্টওয়াচের ছোট্ট স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে স্ক্রিন স্পর্শ করে কাজ করতে গেলে স্ক্রিনের অনেক কিছু চোখের আড়াল হয়ে যায়। স্মার্টওয়াচের দৃষ্টিসীমার এই সীমাবদ্ধতা অনেকটাই কাঁটবে ডিজিটাল ক্রাউনের ফলে।
আর স্ক্রিনে ট্যাপ করে প্রিয় মানুষকে জানান দেওয়া, হৃদস্পন্দন রেকর্ড করা বা স্কেচিং ফিচারগুলোকে সম্ভব করেছে নমনীয় রেটিনা ডিসপ্লের চারপাশে বসানো ইলেকট্রোডগুলো। ব্যবহারকারী আলতো করে ডিসপ্লেতে স্পর্শ করছেন নাকি জোরে চেপে ধরছেন সেটা চিহ্নিত করতে পারে ইলেকট্রোডগুলো। অ্যাপল ওয়াচের টাচকেন্দ্রিক অনেক ফিচারের মূলেই এই ইলেকট্রোডগুলো।
বাদ যায়নি সিরিও: অ্যাপল ওয়াচে উপস্থিত ফিচারগুলোর মধ্যে আছে অ্যাপলের ‘ইন্টেলিজেন্ট ভয়েস অ্যাসিসট্যান্ট’ সিরিও। স্মার্টওয়াচটি মুখের কাছে নিয়ে ‘হেই সিরি’ বললেই সাড়া দেবে সিরি। ডিজিটাল ক্রাউন ব্যবহার করেও দেওয়া সম্ভব ডিকটেশন। নেভিগেশনেও সাহায্য করবে অ্যাপল ওয়াচের সিরি। গন্তব্যে পৌছানো দিকনির্দেশনা তো মিলবেই, ভুল পথে এগোলে ত্বকে ট্যাপ করে অ্যাপল ওয়াচ সাবধান করে দেবে আপনাকে।
কাস্টম ডিজাইনড চিপ: অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো যখন স্মার্টফোনকেন্দ্রিক প্রযুক্তিগুলোই কাটছাট করে স্মার্টওয়াচে ব্যবহার করছে, অ্যাপল তখন কেবল অ্যাপল আইওয়াচের জন্যেই বানিয়েছে নতুন মডেলে ‘এস ওয়ান’ মাইক্রোচিপ। অ্যাপলের ভাষায় ‘পুরোদস্তুর একটা কম্পিউটার আর্কিটেকচার’ নিয়ে আসা হয়েছে এই এক চিপে। আর বিষয়টি ‘ইন্ডাস্ট্রি ফার্স্ট’ বলে মন্তব্য অ্যাপলের।