বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: প্রায় দেড় যুগ আগে ১৭ জন সদস্য নিয়ে যাত্রা শুরু করা বেসিস এখন প্রায় সাড়ে চারশ’ সদস্যের এক বিশাল পরিবার। অনুমান করা হয়, এর বাইরেও অনেক ক্ষুদ্র সফটওয়্যার নির্মাতা রয়েছেন। বাংলাদেশে সফটওয়্যার নির্মাতাদের এই জগৎটি আসলে কত বড় এবং কতখানি বৈচিত্র্যময়? মানবসম্পদ সম্পৃক্ততা এবং আর্থিক বিচারে এর বর্তমান অবস্থান কেমন?
শামীম আহসান: ১৯৯৭ সালে তখনকার তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায়ের শীর্ষ ১৭টি প্রতিষ্ঠান নিয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) যাত্রা শুরু করে। সময়ের পরিক্রমায় এর ব্যাপ্তি দেশব্যাপী ছড়িয়ে গেছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে বেসিসের সদস্য সংখ্যা ৭৪১। বেসিস এখন শুধু বিশাল পরিবার নয়, দেশের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসায়ের শীর্ষ সংগঠন। দেশের তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে বেসিস। আবার ফ্রিল্যান্স-আউটসোর্সিং মার্কেটপ্লেসে সফটওয়্যার এবং অ্যাপ ডেভেলপমেন্টের কাজ করছেন প্রায় ১ লাখ ফ্রিল্যান্সার। শুধু সফটওয়্যার কিংবা অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট নয়, তথ্যপ্রযুক্তির এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ওয়েব ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, বিজনেস প্ল্যানিং, ই-কমার্স, ডোমেইন-হোস্টিংসহ নানা ব্যবসা করছেন। শুধু দেশে নয়, দেশেই বাইরের কাজও করছেন তারা। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বলা চলে, বিশাল ও বৈচিত্র্যময় এই সেক্টরে বর্তমানে প্রায় দুই লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে আমরা ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয়ের মাইলফলক পার হয়েছি। এছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ১৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে রপ্তানি ক্ষেত্রে এই খাতের অবস্থান দেশের শীর্ষ ১৫টি খাতের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। স্বল্প খরচ এবং রপ্তানিতে খুব সহজেই প্রবেশগম্যতার কারণে সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট সেবায় বাংলাদেশ একটি পছন্দনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। যে কারণে এ দুই ক্ষেত্রে রপ্তানিতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ।
বিডিনিউজ: বেসিস যখন যাত্রা শুরু করে তখন এদেশে এই শিল্প অনেকের জন্যই একেবারে নতুন কনসেপ্ট ছিল। কার্যক্ষেত্রে এই সেক্টরের একজন প্রতিনিধি হিসেবে সফটওয়্যার শিল্পকে দেশে প্রচলিত অন্য শিল্পের চেয়ে কতটা আলাদা বা ইউনিক বলে মনে করেন? এবং এ জন্য সফটওয়্যার শিল্প আলাদা কোনো সুবিধা দাবি করে কি না?
গবেষণা প্রতিষ্ঠান গার্টনার উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশ আইটি আউটসোর্সিংয়ে শীর্ষ ৩০ গন্তব্যের তালিকায় একটি। ইউরোপিয়ান কমিশন জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ২০ আইটি আউটসোর্সিং গন্তব্যের একটি। ফলে বলার অপেক্ষা রাখে না, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনার সুনাম বাড়ছে। ফলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃষ্টি এদিকে। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে বেসিস।
বিডিনিউজ: মোটা দাগে ধরে নেওয়া হয় প্রচলিত অন্য শিল্পের তুলনায় সফটওয়্যার শিল্পে স্থাননির্ভরতা কম। আসলেই কি তাই? বাংলাদেশে একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বাজারে কি স্রেফ বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে কোনো বাড়তি সুবিধা বা অসুবিধার মুখে পড়ে? এক্ষেত্রে বেসিসের করণীয় কী?
শামীম: সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে স্থান নির্ভরতা অনেকটাই কম। আর আন্তর্জাতিক বাজারে স্রেফ বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে তেমন কোনো অসুবিধার মুখে পড়ে না। বরং তুলনামূলক কম বাজেটে ভালো কাজ করিয়ে নিতে পারার কারণে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। ভারত, চীন এবং ফিলিপাইনের মতো দেশের তুলনায় এ দেশ ব্যয় সাশ্রয়ী। রয়েছে অসংখ্য প্রতিভাবান ও কর্মোদ্যম তরুণ প্রকৌশলী। নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ও হালনাগাদ থাকা, আকর্ষণীয় সরকারি প্রণোদনা এবং সুবিধা সবার জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্র উন্মুক্ত করেছে। একই সঙ্গে দেশব্যাপী বিস্তৃত ইন্টারনেট সংযোগ, অন্যতম অগ্রাধিকার খাত হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তিকে সরকারের অগ্রাধিকার এবং এই খাতের উন্নয়নে নানা ধরনের সুবিধাজনক নীতিমালা গ্রহণ, প্রযুক্তি আমদানির ক্ষেত্রে ভর্তুকি ও বিশেষ শুল্ক ব্যবস্থা প্রবর্তন, সর্বোপরি এই খাতে অগ্রগতির পরিসংখ্যান ও সাফল্য টানছে পুরো বিশ্বকে। এ দেশে বিনিয়োগে এখন দারুণ আগ্রহী অন্য দেশগুলো। তবে বিদেশে বিশেষ করে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে বাংলাদেশকে সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে আরও প্রতিষ্ঠিত করতে কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনীয়তা বোধ করে বেসিস ইউএস-বাংলাদেশ টেক ইনভেস্টমেন্ট সামিট, ইউরোপ-বাংলাদেশ টেক ইনভেস্টমেন্ট সামিট ইত্যাদি আয়োজন করে থাকে। এছাড়া ইন্টারনেট সংযোগ, কারিগরি দক্ষতা সম্পন্ন জনবলসহ বেশকিছু অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা রয়েছে। বেসিস এসব দুর্বলতা চিহ্নিত করে সেগুলো উত্তরণের কাজ করে যাচ্ছে।
বিডিনিউজ: আপনার বিবেচনায় গত ১৭ বছরে বেসিসের সবচেয়ে বড় অর্জন কী ছিল? এই মুহূর্তে বেসিসের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী এবং এ বিষয়ে আপনাদের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি কী?
তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে বেসিস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিআইটিএম) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যেখানে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ পান।
বাংলাদেশকে তথ্যপ্রযুক্তির পরবর্তী গন্তব্যস্থল হিসেবে পরিচিত করতে বিশ্বের প্রায় ৩০ দেশে ‘বাংলাদেশ নেক্সট’ ব্র্যান্ডিং করেছে বেসিস। পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ইকুউটি অ্যান্ড এন্টারপ্রেওনারশিপ ফান্ড (ইইএফ) এর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিডিনিউজ: বাংলাদেশে সফটওয়্যার ডেভেলপারদের একটি বড় অংশ ফ্রিল্যান্সার। ব্যক্তি উদ্যোগে কাজ করা এই ফ্রিল্যান্সারা কাজের মাধ্যমে সফটওয়্যার শিল্পে সরাসরি অবদান রাখছেন, কিন্তু সাংগঠনিকভাবে নয় বলে ধারণা করা হয়। এটা কতটুকু সঠিক? এ বিষয়ে বেসিসের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?
শামীম: শুধু সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট নয়, দেশের অনলাইন আইটি সেবা রপ্তানিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে লক্ষাধিক ফ্রিল্যান্সার। হাজার হাজার ডলার আয় করছেন তারা। তুলনামূলকভাবে কম বাজেটে এসব ফ্রিল্যান্সাররা ভালো কাজ করছেন। আর এ কারণে বিদেশিরা বাংলাদেশ থেকে কাজ করাতে আগ্রহী হচ্ছে, যা দেশের তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এতে রপ্তানি আয় বাড়ছে। বেসিস মনে করে, আজকের ফ্রিল্যান্সাররা আগামী দিনের আইটি উদ্যোক্তা। তাছাড়া স্বনির্ভরতা বাড়াতে ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রসার ও ফ্রিল্যান্সারদের উৎসাহ বাড়াতে বেসিস কাজ করছে।
বিডিনিউজ: নতুন মেয়াদে আপনার নেতৃত্বে বেসিসের কার্যতালিকায় প্রধান ফোকাস কী। নতুন কার্যনির্বাহী কমিটির অগ্রাধিকার তালিকায় কী কী আছে?
শামীম: নতুন মেয়াদে আমাদের প্রধান ফোকাস হচ্ছে - বেসিসের ‘ওয়ান বাংলাদেশ’ ভিশনকে সামনে রেখে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করা। আগামী ৫ বছরের মধ্যে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ১০ লাখ আইটি প্রফেশনাল তৈরি এবং প্রতিবছর এক কোটি করে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। একইসঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ২-৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হবে। যার মাধ্যমে আগামী ২০১৮ সালের মধ্যে জিডিপিতে সফটওয়্যার ও এ খাতের অবদান হবে এক শতাংশ (১%)। এছাড়া সরকারের ক্রয়নীতি, ইইএফ তহবিলের নীতিমালা সহজীকরণের ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে। সার্বিকভাবে পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এ কর্মসূচীর মাধ্যমে ইন্টারনেটের ব্যবহার এবং বিশ্বব্যাপী তথ্যসূত্র ও কমিউনিটির সঙ্গে সমভাবে যুক্ত হওয়া।