ডিএনএ-তে ‘ভিডিও সেইভ’ করলেন গবেষকরা

১৮৭৮ সাল ব্রিটিশ চিত্রগ্রাহক এডওয়ার্ড মাইব্রিজ ধারণ করেন একটি ভিডিও। একটি ঘোড়ার দৌড়ানোর এই ভিডিও বিশ্বের প্রথম দিককার ধারণকৃত ভিডিওগুলোর মধ্যে একটি।  সময়টা এখন ২০১৭। ১৩৯ বছর পর ওই ভিডিও ক্লিপকে এবার অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে যুক্ত করা হল। এই ক্লিপ এখন কোনো জীবন্ত কোষের ডিএনএ-তে এনকোড করা প্রথম ভিডিওতে পরিণত হয়েছে।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 July 2017, 02:34 PM
Updated : 14 July 2017, 02:34 PM

এ নিয়ে বুধবার জার্নাল নেচার-এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল-এর গবেষকরা। এই গবেষণাকে বিশাল স্টোরেজ ডিভাইস হিসেবে জিনোম-এর সম্ভাবনার সর্বশেষ ও সবচেয়ে বিস্ময়কর উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস। 

ইতোমধ্যে ব্রিটিশ নাট্যকার শেক্সপিয়ার-এর সব সনেট ডিএনএ-তে রাখতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। নতুন এই গবেষণার একজন গবেষক ও হার্ভার্ড-এর প্রজননবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ জর্জ চার্চ সম্প্রতি তার নিজের লেখা বই ‘রিজেনেসিস’ ডিএনএ-তে এনকোড করেছেন ও এর নয় হাজার কোটি কপি বানিয়েছেন। 

এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, “এটি প্রকাশনা খাতে একটি রেকর্ড।”

নতুন গবেষণায় তিনি ও অন্যান্য বিজ্ঞানীরা ভাবতে শুরু করেন আরও বিস্ময়কর কিছু করা সম্ভব হবে কিনা- ব্যাকটেরিয়াকে মানবদেহের কোষে জড়িয়ে প্রোগ্রাম করে দেওয়া আর তারা কী করছে তা রেকর্ড করা। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি কোষের জীবন নিয়ে একটি ‘সিনেমা’ বানানো সম্ভব হতে পারে। 

কোনো কিছু ভুল হয়ে গেলে, ধরা যাক, একজন মানুষ যদি অসুস্থ হয়ে যান, চিকিৎসকরা হয়তো ওই রেকর্ড প্লে করে দেখতে পারবেন।

ইউরোপিয়ান বায়োফরম্যাটিকস ইনস্টিটিউট-এর পরিচালক ইওয়ান বার্নি বলেন, এই মূহুর্তে সবই হচ্ছে “বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর এক পাশ।”

“আর ডিএনএ-তে তথ্য জমা রাখাটাই হচ্ছে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর আরেক পাশ”, যোগ করেন তিনি।

ড. চার্চ ও আরেক প্রজনন বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ সেথ শিপম্যান আর তাদের সহকর্মীরা প্রতি পিক্সেল সাদাকালো ফিল্মে ধূসর ছাপের ডিএনএ কোড আরোপের মাধ্যমে এই কাজ শুরু করেন। প্রতিটি কোষে ডিএনএ’র বিশাল শেকলগুলো চারটি উপাদান নিয়ে গঠিত-  অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, থাইমিন, সাইটসোসিন। এই উপাদানগুলো বিভিন্নভাবে সাজানো থাকে।

প্রজননবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা ডিএনএ উপাদানগুলোর একটি ধারা পেয়েছেন, যা পুরো ফিল্মটিএ প্রতিনিধিত্ব করে। তারপর তারা ‘ক্রিসপার’ নামের নতুন একটি শক্তিশালী জিন এডিটিং কৌশল প্রয়োগ করেন। এই কৌশলের মাধ্যমে ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়ার জিনোমে এই ধারা নিয়ে কাজ করেন।

এই পরিবর্তন সত্ত্বেও, ব্যকটেরিয়াটি কয়েকগুণ সৃষ্টি হয়। এ থেকে সৃষ্ট প্রতিটি নতুন প্রজন্মের জিনোমেও এই ফিল্ম সম্পূর্ণ সুরক্ষিত অবস্থায় সংরক্ষিত থাকে,গবেষণায় এমন তথ্য পেয়েছেন গবেষকরা।

ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটা’র গণিত অধ্যাপক ও ডিজিটাল প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রি ওডলাইজকো এই গবেষণাকে ‘মুগ্ধকর’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

সুপরিচিত পদার্থবিদ রিচার্ড গেইনম্যান প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে প্রস্তাব করেছিলেন, ডিএনএ কোনো উপায়ে স্টোরেজ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ১৯৫৯ সালে তিনি বলেন, “জীববিজ্ঞান শুধু তথ্যই জমা করছে না, এটি আরও বেশি কিছু করছে।”

১৯৯৪ সালে ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া এর গণিতবিদ ও সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পাবলিক ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবস্থা আরএসএ-এর সহ-উদ্ভাবক লিওনার্ড অ্যাডলম্যান বলেন, তিনি ডিএনএ-তে ডেটা জমা করেছেন আর এটিকে একটি গাণিতিক সমস্যা সমাধানে কম্পিউটার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তখন তিনি বলেন, ডিএনএ একটি কমপ্যাক্ট ডিস্ক-এর সমান জায়গায় এর চেয়ে লাখ লাখ গুণ বেশি ডেটা রাখা সম্ভব। 

ডেটা সংরক্ষণ একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা। শুধু উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ডেটা উৎপাদনই হবে না, সেই সঙ্গে জমা করার প্রযুক্তিও ধীরে ধীরে অপ্রচলিত হতে থাকবে। যেমনটা এখন ফ্লপি ডিস্ক আর সিডি, ডিভিডি অপ্রচলিত হয়ে গিয়েছে।

ড. অ্যাডলম্যান বলেন, “অঙ্গাণুগুলো শতকোটি বছর ধরে ডিএনএ-তে তথ্য জমা করে রাখছে, আর এটি এখনও পড়ার যোগ্য। তিনি বলেন লাখ লাখ বছর ধরে জমে থাকা মৃত পোকামাকড়গুলো থেকেও জিনগুলো পুনরুদ্ধার করে সেগুলো পড়তে পারে আধুনিক ব্যাকটেরিয়াগুলো। 

ড. শিপম্যান ও ড. চার্চ-এর জন্য প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মস্তিষ্ক। এতে ৮৬০০ কোটি নিউরন রয়েছে আর এগুলো কী করছে তা জানার জন্য কোনো সহজ উপায় নেই। ড. চার্চ বলেন, “এই মূহুর্তে, আমরা ইলেকট্রোড দিয়ে একবারে একটি নিউরন মাপতে পারি, কিন্তু ৮৬০০ ইলেকট্রোড আপনার মস্তিষ্কে স্থাপন করা যাবে না।”

এখন বিজ্ঞানীদের ভাবনা হচ্ছে, তারা বিশেষ প্রযুক্তির ব্যাকটেরিয়াকে রেকর্ডিং ডিভাইস হিসেবে মস্তিষ্কে স্থাপন করবেন। পরবর্তীতে ব্যাকটেরিয়াগুলো থেকে এগুলোর ডিএনএ নিয়ে সেগুলোর উপর পরীক্ষা চালানো হবে আর মস্তিষ্কের নিউরনগুলো কী করছে তা পর্যবেক্ষণ করা হবে।  

ড. চার্চ আর তার সহকর্মীরা ইতোমধ্যে তাদের আগের গবেষণাগুলোতে দেখিয়েছেন যে, ব্যাকটেরিয়া কোষের মধ্যে থাকা ডিএনএ রেকর্ড করতে পারে।

জীববিজ্ঞানীরা প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছেন বলেই মন্তব্য ড. চার্চ-এর। তিনি মানুষের জিনোমের একটি উদাহরণ দিয়েছেন। প্রথম প্রচেষ্টায় সময় লেগেছে কয়েক বছর আর খরচ হয়েছে তিনশ’ কোটি ডলার। এখন ধারণা করা হচ্ছে সামনের ছয় দশকে প্রতিটি ধাপে হাজার ডলার করে খরচ হবে।

তিনি বলেন, “এটি, ছয় দশকের জায়গায় ছয় বছরে হয়ে গিয়েছে।”