যুদ্ধশিশুর ‘নগ্নতা’, জাকারবার্গ ও সম্পাদনা

অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমগুলো অবস্থান নেবে সেটাই স্বাভাবিক। আর অশ্লীলতার বেলায় নগ্নতা একটি বড় বিষয়। তবে বিষয়টি এমনও নয় যে নগ্নতা মানেই অশ্লীল। কিন্তু কোনটা নগ্নতা আর কোনটাই বা অশ্লীলতা তা কে ঠিক করবে? মানুষের বিচারে তা প্রায় সময় সম্ভব হলেও, অ্যালগরিদমের পক্ষে কতটা সম্ভব? কেন এসব প্রশ্ন তা বোঝা যাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক মাধ্যম ফেইসবুকের এই অ্যালগরিদম বিচারের এক ঘটনায়।

রিয়াদ মোর্শেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Sept 2016, 11:03 AM
Updated : 10 Sept 2016, 11:03 AM

সম্প্রতি নরওয়ের বহুল প্রচলিত প্রত্রিকা অফেনপোস্টেন-এর প্রথম পৃষ্ঠায় ফেইসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গকে উদ্দেশ্য করে একটি খোলা চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিটি লিখেছেন অফেনপোস্টেন-এর প্রধান নির্বাহী এবং প্রধান সম্পাদক এসপেন এগিল হান্সেন।

এই চিঠিতে মার্ক ‘চিন্তাশুন্যভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন’ বলে অভিযোগ আনা হয়েছে, জানিয়েছে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান।

ঘটনার সূত্রপাত ঘটে ফেইসবুক কর্তৃপক্ষের একটি পোস্ট মুছে দেয়ার সিদ্ধান্তে। টেরর অফ ওয়ার নামের পোস্টটি নরওয়েইয়ান লেখক টম ইগিল্যান্ড-এর রচিত আর পোস্টের বিষয়বস্তু ছিল ভিয়েতনামিয়ান আলোকচিত্রকর নিক উট-এর পুলিৎজার পুরস্কার অর্জিত একটি আলোকচিত্র। সেখানে দেখানো হয়, ভিয়েতনাম যুদ্ধে নাপাম হামলা থেকে কিছু শিশু পালাবার চেষ্টা করছে, তার মধ্যে নয় বছরের একটি কন্যাশিশু কিম ফুক পুরো খালি গায়ে রাস্তায় দৌড়াচ্ছে।

পোস্টটি শুধু মুছে দেওয়াই নয় ইগিল্যান্ডকে ফেইসবুক থেকে সাময়িকভাবে বাতিল করা হয়েছে। বাতিলকরণের জন্য রিপোর্ট পাঠানো হলে পত্রিকাটি ফেইসবুক থেকে মেসেজ পায় যে, পোস্টটি মুছে দিন বা ছবিটি সংস্কার করুন।

ফেইসবুকের এই সিদ্ধান্তকে উদ্দেশ্য করে অফেনপোস্টেন-এর ওই খোলা চিঠিতে বলা হয় “শিশু পর্নোগ্রাফি এবং বিখ্যাত যুদ্ধ আলোকচিত্রের মধ্যে পার্থক্য করুন।”

মার্ককে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, “নরওয়ের সবচেয়ে বড় সংবাদ প্রতিষ্ঠানের প্রধান সম্পাদক হওয়া সত্বেও আমি অনুভব করছি আমাকে আমার সম্পাদকীয় দায়িত্ব পালনে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হচ্ছে।"

আবার তিনি মার্ক জাকারবার্গকে ‘মাস্টার এডিটর’ উপাধি দিয়ে বলেন, “সম্পাদকরা তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না।”

অন্যদিকে, গার্ডিয়ান জানায়, অনলাইনে পাঠকদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের ফেইসবুকের ওপর নির্ভরশীলতা সুখকর নয়। কেননা সামাজিক বিষয় নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার –এর মতে, ২০১৬ সালের গবেষণা অনুযায়ী, ৪৪ শতাংশ মার্কিনি ফেইসবুকের মাধ্যমে সংবাদ দেখে। ফেইসবুকের জনপ্রিয়তা মানে মানুষের মন্তব্যের উপরে বিশাল ক্ষমতাধর অ্যালগোরিদম প্রয়োগ করা।

প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানবিষয়ক ওয়েবসাইট গিজমোডো-এর ২০১৬ সালের মে মাসের একটি গবেষণায় বলা হয়, ফেইসবুকের প্রবণতা হচ্ছে সাধারণ প্রচলিত সংবাদগুলোকে মুছে দেওয়া এবং প্রচলিত সেরা খবরটিকে আরও প্রচারিত করা।

ফেইসবুক সম্প্রতি সম্পাদকের একটি দলকে চাকরিচ্যুত করেছে যারা প্রচলিত বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করত। এই দলটির বদলে স্থান পেয়েছে অ্যালগরিদম, যা দ্রুত খবরের সম্পাদকীয় বিবেচনা পরিচালনা করে। মানুষের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে অ্যালগরিদম আনার পেছনে মূল কারণ ছিল- পক্ষপাতমূলক আচরণ বিসর্জন, সময় কমানো আর কোনো ভুল থেকে মুক্তি পাওয়া। অ্যালগরিদমে যদি বলে দেওয়া থাকে কোনো বিশেষ অঙ্গের ছবি থাকলে তা সরিয়ে ফেলা হবে, তবে ছবিটি যতোই গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করুক না কেন, অ্যালগরিদম দিয়ে রাখা নির্দেশনা অনুযায়ীই কাজ করবে।

ইতালির রাজধানী রোমে কিছুদিন আগের সফরে মার্ক সংবাদমাধ্যমের প্রতি তার দ্বায়িত্ব এবং তার সম্পাদকিয় দ্বায়িত্ব নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, “আমরা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, কোনো সংবাদমাধ্যম না।"

সেই সঙ্গে তিনি এও বলেন, “বিশ্বের আরও সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, কিন্তু এর সঙ্গে প্রযুক্তি প্ল্যাটফোর্মগুলো দরকার যা আমরা করছি, আমরা আমাদের কাজ গুরুত্বের সাথেই নিয়েছি।”

অফেনপোস্টেন সম্পাদক ফেইসবুকের উদ্দ্যেশে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। “নিয়মকানুন এবং প্রকাশনার ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক ভিন্নতা করুন। সম্পাদক এবং ফেইসবুক ব্যবহারকারীর পার্থক্য নির্ধারণ করুন। আপনারা কীভাবে পরিচালনা করবেন তা বিশদভাবে পর্যালোচনা করুন”- বলেন তিনি।

 “আমরা যখন বুঝতে পারি এই ছবিটি একটি স্মৃতির প্রতিমা, ঠিক তখন সেই সময়ে আলাদা করে এই ‘নগ্ন’ ছবিকে অনুমতি দেওয়া এবং অন্যান্যগুলোকে না দেওয়ার পার্থক্য করা কঠিন ছিল।” – দাবি ফেইসবুকের।

তাই এই ছবিটি নরওয়ে এর প্রেসিডেন্ট এনলা সালবার্গসহ কিছু নওরয়েইয়ান রাজনীতিবিদ শেয়ার করেন, কিন্তু এক ঘণ্টা পর আবার এই ছবিটি সরিয়ে নেয় সামাজিক মাধ্যমটি, জানান অফেনপোস্ট।

সম্পাদকের ওই চিঠি নিয়ে তোলপাড় পড়ে যায় বিশ্বব্যাপী বড় বড় গণমাধ্যমগুলোতে। আলোচনার ঝড় উঠে সামাজিক মাধ্যমগুলোতেও। শেষ পর্যন্ত নিজেদের অবস্থা থেকে সরে আসে ফেইসবুক। নতুন করে আবার বিবৃতি পাঠায় এই সোশাল জায়ান্ট। এবার বলা হয়, "আমাদের সম্প্রদায় থেকে শোনার পর, আমরা আবারও এই ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড-এ তাকাই।"

"ওই সময়ের বিশেষ মূহুর্ত ধারণে এই ছবির ঐতিহাসিক ও বৈশ্বিক গুরুত্ব" বুঝতে পারার কথাও জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

যাই হোক, ফেইসবুক শেষ পর্যন্ত তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সড়ে এসেছে; ছবিটি সহ পোস্ট ফিরে এসেছে। বলা চলে টিম জাকারবার্গ ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে। িএই ঘটনা মনে করিয়ে দেয় জাকারবার্গের নিজের একটি উক্তি যেটি তিনি অনেক আগে বলেছিলেন এবং এই ঘটনার সঙ্গে তা ভালভাবেই মিলে যায়-

“আপনি অসংখ্য ভুল করবেন…এতে কিছু যায় আসে না। ভুল দিয়ে আপনার মূল্যায়ন হবে না। লোকজন কয়েক বছর পর এইসব মনেও রাখে না। আপনার মূল্যায়ন হবে আপনার ভাল কাজগুলোর মাধ্যমে।”