সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ কনভার্টার তৈরি হল দেশেই

প্রযুক্তির আশীর্বাদে এবার হয়তো বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে স্বাভাবিক মানুষের যোগাযোগের প্রতিবন্ধকতা কিছুটা হলেও কমবে। আর এ গবেষণা হচ্ছে আমাদের দেশেই।

আজমল বশির শিহাববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 August 2016, 11:59 AM
Updated : 27 August 2016, 11:59 AM

বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানে, বিশেষ করে খবর প্রচারের সময় দেখা যায় পর্দার এক কোণে একজন ইশারায় কিছু একটা দেখাচ্ছেন। অনেকেই হয়তো জানেন, এই বিশেষ ইশারা হচ্ছে শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য। একটি বিশেষ মেথড ব্যবহার করে এখানে কিছু ইঙ্গিত করা হয়, শ্রবণ প্রতিবন্ধী যারা ওই মেথডের ভাষা জানেন তারা নিমিষেই বুঝে যান কী বলা হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ যারা এসব মেথড সম্পর্কে জানেন না তারা কীভাবে বাক ও শ্রবণ  প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে মনের ভাব প্রকাশ করবেন?

এ সমস্যার সমাধান নিয়ে এসেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়-এর একদল শিক্ষার্থী।

তারা বানিয়েছেন বিশেষ এক গ্লাভ, সঙ্গে একটি অ্যাপ। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ-জানা কেউ এই গ্লাভ হাতে পরে বিভিন্ন ইশারা করতে থাকলে, যিনি এই ভাষা বোঝেন না তিনি তার হাতে থাকা স্মার্টফোনে ওই অ্যাপ চালু করে তা গ্লাভটির সঙ্গে ব্লুটুথ দিয়ে সংযুক্ত করে স্মার্টফোনের ডিসপ্লে-তে ওই ইশারায় বোঝানো ‘কথা’ দেখতে পাবেন।

তরুণ এই গবেষক দলটিতে রয়েছেন- জাহিদ হাসান তুষার, নিলয় সিদ্দিক, তানভীর আহমেদ আর রেজওয়ান আহমেদ নাজিব। জাহিদ আর নাজিব কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে পড়ছেন, আর বাকি দুজন পড়ছেন তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বিভাগে। গ্লাভ হাতে নিয়ে ইশারায় বিভিন্ন প্রতীক দেখান তানভীর, এর সঙ্গে সংযুক্ত স্মার্টফোনে অ্যাপে ওই ইশারা অনুযায়ী বর্ণ উঠতে থাকে।

একাডেমিক একটি কোর্সের প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করতে গিয়েই মাথায় আসে এই ধারণা। শুরুতে ধারণাটা ছিল ভিন্ন। তারা চেয়েছিলেন বিভিন্ন ইশারাকে লিখিত রূপে প্রকাশ করা হবে এমন একটা ডিভাইস বানানো হবে, কিন্তু সেখানে কোনো নির্দিষ্ট মেথড দেওয়া হবে না, ব্যবহারকারীর জন্য সম্পূর্ণ আলাদা একটি মেথড ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া যাবে। এর ফলে এই গ্লাভ আর স্মার্টফোন অ্যাপের মধ্যে তৈরি করা যাবে একটি এনক্রিপটেড যোগাযোগ ব্যবস্থা। "এই যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়তো সামরিক বাহিনী বা কোনো সংস্থার গোপন বার্তা আদান-প্রদানে ব্যবহার করা যেতে পারে, প্রথমে এটা নিয়েই এগুবো ভাবছিলাম, কিন্তু কীভাবে কী করব তা তখনও ঠিক করা হয়নি"- বলেন নাজিব।

কিন্তু সেই ধারণা থেকে সরে এলেন কেন?- বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর বার্তাকক্ষে প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে নাজিব জানান, সমাজে মনের ভাব প্রকাশে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়া শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের দিকে নজর দেওয়ার কৃতিত্বটা প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. খলিলুর রহমান-এর। "স্যার এই আইডিয়াটা দিলেন, বললেন তোমরা যদি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ-এর কোনো একটা বিশেষ মেথড দিয়ে দাও, তাহলে ওই মেথড জানা শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য সবার সঙ্গে ভাষা প্রকাশ করাটা সহজ হয়ে যায়"- বলেন নাজিব, যিনি বিডিনউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর প্রযুক্তি বিভাগে একসময় নিয়মিত লিখেছেন। খলিলুর রহমান-এর সঙ্গে এই প্রকল্পে একই বিভাগের প্রভাষক সারোয়ার মোহাম্মদ শাহরিয়ার খান ও নাজমিন নাহার সহায়তা করেন বলেও জানায় দলটি।

'সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ কনভার্টার' নামের এই ডিভাইসে ইশারাগুলো বুঝতে তারা বিভিন্ন সেন্সর ব্যবহার করেন। এই ক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের ভাষা প্রকাশের মেথড আমেরিকান সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ (এএসএল)। এই মেথড অনুযায়ী কেউ এই গ্লাভ পরে বিভিন্ন ইশারার মাধ্যমে ইংরেজি ২৬টি বর্ণ, স্পেইস বাটন আর সংখ্যাগুলো প্রকাশ করতে পারেন। সেই সঙ্গে নিজেরাও কিছু আলাদা সংকেত যোগ করেছেন এতে। এই সংকেতগুলো দিয়ে কী প্রকাশ করা হবে তা চাইলে তারা পরিবর্তন করতে পারবেন বলেও জানান নাজিব। অ্যাপের মাধ্যমে ডিসপ্লে-তে সংকেতগুলো প্রকাশে কোনো তারের সংযোগ দরকার হবে না।

যদি শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের এই ইশারা থেকে লিখিত ভাষার রূপ প্রকাশ করা যায়, তবে অন্য কেউ অ্যাপে লিখছেন সেখান থেকে শ্রবণ প্রতিবন্ধীরা এই গ্লাভ-এর মাধ্যমে বুঝতে পারবেন, এমন কিছু করা যাবে কি না? এমন প্রশ্নে নিলয় জানান, এই ধারণার উপর ভিত্তি করে কাজ করলে, হয়তো সেটাও সম্ভব। তবে, তারা এই গ্লাভে তারা এই পদ্ধতি নিয়ে কাজ করেননি, সায় দেন তানভীর আর জাহিদও। 

"এই গ্লাভ দিয়ে শুধু যে ভাষা প্রকাশ তাই নয়, এর সঙ্গে আপনি চাইলে ইশারায় কোনো রিমোর্ট কনট্রোলড গাড়ি বা অ্যাপও চালাতে পারবেন, এ ক্ষেত্রে এতে আরও নতুন কিছু যোগ করা যায় কি না তা নিয়েও ভাবছি আমরা"- যোগ করেন জাহিদ।

কেন বাংলায় নয়? নির্মাতাদের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয় এমন প্রশ্নও। জবাবে নাজিব বলেন, "আমরা আসলে প্রটোটাইপে শুধু ইশারার প্রকাশটাকেই জোর দিয়েছি, আর এখন বিষয়টা এমনভাবে করে নেওয়া হয়েছে যে, চাইলে আমরা এতে এএসএল-এর বদলে বাংলাদেশে ব্যবহৃত মেথড ব্যবহার করতে পারব।"

দলের অপর সদস্য তানভীর বলেন, "এখন আমরা প্রটোটাইপ বানিয়েছি, সামনে যদি এটা নিয়ে আরও কাজ করা যায়, তবে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা অফিসগুলোতে শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের যোগাযোগের প্রতিবন্ধকতা অনেকটাই দূর করা সম্ভব হবে বলে মনে করি। যদি সরকার বা কোনো সংস্থা এটি নিয়ে কাজ করতে চায়, আমরা তাদের এ নিয়ে সমর্থন দিতে পারি।"

কাজের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে অর্থ সংকটের কথা জানান নিলয়। "আমরা সেন্সর বা অন্যান্য যন্ত্রপাতি কিনতে গিয়ে কিছুটা ঝামেলায় পড়েছি", বলেন তিনি। পুরো ডিভাইসটি বানাতে তাদের পাঁচ-ছয় হাজার টাকা খরচ হলেও, বাণিজ্যিকভাবে এটি বানাতে গেলে খরচ অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আশা তার।